Advertisement
E-Paper

সি, জি, আর কসমেটিক কাশী

ব্রিজে উঠলেই ট্রেনের মেজাজটা ভারিক্কি হয়ে যায়। আমারও। খোলা দরজায় এসে দাঁড়ালাম। পর পর সরে যাওয়া লোহার থামের ফাঁক দিয়ে প্রথমে অনেকটা নদীর চর। তার পর পুরো গঙ্গাটা দেখা গেল। রোদ উঠে গেলেও কুয়াশা থাকায় বেশি দূর অবধি দেখতে পেলাম না।

শুভময় মিত্র

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০৬
ছবি: শুভময় মিত্র।

ছবি: শুভময় মিত্র।

ব্রিজে উঠলেই ট্রেনের মেজাজটা ভারিক্কি হয়ে যায়। আমারও। খোলা দরজায় এসে দাঁড়ালাম। পর পর সরে যাওয়া লোহার থামের ফাঁক দিয়ে প্রথমে অনেকটা নদীর চর। তার পর পুরো গঙ্গাটা দেখা গেল। রোদ উঠে গেলেও কুয়াশা থাকায় বেশি দূর অবধি দেখতে পেলাম না। আন্দাজ করলাম দশাশ্বমেধ ঘাটের পজিশনটা। আমার সঙ্গে যে আছে সেও মনে হল খুশি, সাতসকালে ঝাপসা বেনারস দেখে। যাবতীয় অস্পষ্ট ব্যাপার নিয়েই তার কারবার। এই মালব্য ব্রিজটা ডবল ডেকার, বলতেই সে বলল, ‘এখানে গল্পের ট্রেন গাড়ির মাথায় চড়ে, দারুণ জায়গা, মার্ক টোয়েন তো বলেই গেছেন, দিস ইজ ওল্ডার দ্যান হিস্ট্রি।’ ব্রিজ ফুরোতেই অন্য প্যাসেঞ্জাররা সিটের তলা থেকে মালপত্র বের করতে লাগল। আমরা নেমে রিকশওয়ালাকে বললাম— গোধুলিয়া। রিকশ থেকে নামার সময় পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম। পিছনের রিকশ এসে আমাদেরটাকে ধাক্কা মেরেছে। এখানে এমন মারে। নতুন কিছু নয়। বুঝে গেলাম, সব ঠিক আছে।

সামনেই হলুদ রঙের বাদাম শরবতের দোকান। হেভি ড্রিংক। মেরে দিলাম বড় এক গ্লাস। সন্ধের পর আবার হবে, ভাং দিয়ে। ওই করতেই তো আসা। খেয়েই খুব চার্জড লাগল। দৃপ্ত পায়ে হাঁটতে লাগলাম ভিড়ের মধ্য দিয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে মুখ করে। রাস্তাটা একটু ভাল হয়েছে, নতুন আলো বসেছে, আর কোনও পরিবর্তন হয়নি। বাঁ দিকে বিশ্বনাথ গলিতে ঢোকার মুখে গেটের সামনে ষাঁড় দাঁড়িয়ে আছে মিষ্টির দোকানের দিকে মুখ করে। উলটো পারে পান-মশলার দোকানের মালিক, আমার অনেক কালের চেনা, হাসিমুখে ছোট্ট এক চামচ চুরন এগিয়ে দিলেন, বললেন, ‘এই এলেন?’ ডান দিকের গলিতে ঢুকে পড়লাম, বাঙালিটোলার দিকে, ওর ভেতরে সস্তায় থাকার আস্তানা আছে অনেক। মদনপুরার রাস্তা আর গঙ্গার ঘাটগুলোর মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে দোকান, মন্দির, পুরনো বাড়ি ঠাসা সরু গলিটা। সব সময় গমগম করছে। থাকার জায়গা খুঁজে বের করে উঁচু ধাপের সিঁড়ি ভেঙে, তিন তলায় ঘরে পৌঁছেই মন খুশ হয়ে গেল, একদম চুপচাপ। আলো, জল, পাখা— ফার্স্ট ক্লাস। ‘একটু হোক’ বলেই আমার বন্ধু তার গুপ্তধনের পাউচটা বের করে ফেলল। তার মধ্যে অত্যন্ত যত্ন করে সাজানো আছে তামাকের প্যাকেট, কাগজ, রোলার, জি এবং সি। জি হল গাঁজা। সি হল চরস। এ সব নাকি ঝাড়খণ্ড থেকে আনায়। কোয়ালিটি ভাল, দামও ন্যায্য। আমি ও সব খাই না, মাথা ধরে। একটা সিগারেট সেজে সে দু’টান দিতেই ঘরের মধ্যে একটা হালকা গন্ধ ভাসতে লাগল, অনেকটা পাইন বনের মতো। শুনলাম, ‘মন খুলে যায়। শরীরের সব ভাইরাস মরে যায়। মশাও আসে না।’ তার পর ঠিক হল ঘাটে যাওয়া হবে। কাছেই।

নৌকো চলছে এ দিক ও দিক, ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা পাখিরা উড়ছে তার আশেপাশে, বোধ হয় খাবার দেয়। স্থানীয়দের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, চান করা, বহু সময় নিয়ে। আমার ধারণা, ওই সময়ে অনেক অফিসের কনফারেন্সও সেরে নেওয়া হয়। ঘাটের বাড়ির দেওয়ালে নানা রকম উদ্ভট ছবি আঁকা, পাশেই চায়ের দোকান, জাপানি চেহারার রোগা লোক বাঁশি বাজাচ্ছে মন দিয়ে, পায়ের কাছে বসে দুটো ছাগল শুনছে। ওখানে পৌঁছে আমার বন্ধু কোনও ভনিতা না করেই বলল, ‘হবে?’ তার পরের কথাবার্তা আর শুনলাম না। শুধু বুঝলাম, যা চাইছে তা পাওয়া যাবে, অরিজিনাল মাল, দাম আছে। এখানে নয়, নিতে হবে গলি থেকে। লোক আছে। বিকেলে আসবে। আগে অল্প টেস্ট করা হবে, ঠিক হলে বেশি নেওয়া যাবে। এই জায়গাটা কেদার ঘাটের কাছে, দ্বারভাঙা বা মণিকর্ণিকা থেকে কিছুটা দূরে, বেশ নিরিবিলি। ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব, হাওয়া দিচ্ছে। মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। দুম করে বললাম, ‘আমি খাব, কিছু হবে?’ আমার পার্টনার আমাকে একটু দেখল, বলল, ‘কী আর হবে? ভালই হবে।’

দেওয়ালের মধ্যেই দোকান। কাচের বাক্স, ভেতরে মিষ্টি আছে। পিতা, প্রপিতামহের ছবিও আছে মালা দেওয়া। পাশে স্টেশনারি দোকান, সবই আছে, বিদেশি সিগারেটও রয়েছে। বসে আছেন এক বয়স্কা মহিলা, বিধবা, বাঙালি। এ সবের পাশ দিয়ে আর একটা অন্ধকার গলি। মুখে হলুদ আলো জ্বলছে, দেওয়ালে নানা রকম গেস্ট হাউসের বিজ্ঞাপন, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার হরফে। উদ্ভট তারযন্ত্রের দোকানে মেমসায়েব টুংটুং করছে। ঢুকলাম গলিতে। লোক এল। কথাবার্তা হল। ছোট প্যাকেট হাত বদল হল। বেশ গা ছমছমে ব্যাপার। বললাম, ‘এক্ষুনি চাই, ঘাটে যাওয়া যাক।’ চলে এলাম পাঁড়ে ঘাটে। শহরটা দেখা যাচ্ছে অনেক দূর পর্যন্ত। সামনে সারি দিয়ে খালি নৌকো বাঁধা আছে, একটু দূর হরিশ্চন্দ্র ঘাটে শ্মশানের আগুন জ্বলছে। বসে পড়লাম একটা চবুতরার ওপর। সময় নিয়ে, তরিবত করে তৈরি হল সিগারেট। ধরিয়ে ফেললাম। প্রথম টানটা মারতেই বুঝলাম অন্য রকম স্বাদ, একেবারেই অচেনা। শহরের ঘাটের আলো পড়ছে কালো জলে, কিছু দূর পর্যন্ত। এক-আধটা প্রদীপ ভাসছে এ দিক ও দিক। এক সময় শেষ হয়ে গেল আগুন টানা, মুখের ভেতরের স্বাদটা বদলে গেল। আর কিছু হল না। শুধু মনে হল, পিছনে একটা মস্ত কালো ষাঁড় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মুখ ঘুরিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না। দ্বিতীয় রাউন্ড চাইলাম। বানিয়ে দিল। এই মাঝের সময়টায় মনে হল দূরের আলো-জ্বলা ঘাট থেকে আরো প্রদীপ ভাসতে ভাসতে আসছে আমাদের দিকে।

দুটো শট শেষ হয়ে গেল। সঙ্গী জিজ্ঞেস করল, ‘কী বুঝছ?’ বললাম, ‘একেবারে দু’নম্বরি, বেনারসের বারোটা বেজে গেছে একেবারে। দুপুরে একটা ছাগল গাঁদা ফুলের মালা ভেবে এক গাদা বোঁদে খেয়ে ফেলল, দেখলে?’ মনেপ্রাণে নেশা করতে চাইলাম, না হওয়ায় বিরক্ত লাগছিল। আগে ঘাটের আলোগুলো হলুদ ছিল, ভাল লাগত পুরনো জায়গাটাকে, এখন ফ্যাটফেটে সাদা হয়ে গেছে, বললাম। ‘আরে এখন তো এলইডি আলো লেগেছে’, শুনলাম। বুঝতে পারছিলাম ভেতরে ভেতরে উদ্বেল হয়ে উঠছি, শহরের বদলগুলো খেয়াল করছি, আগে মাথা দিইনি। ঠিক কেন বেনারস আগে ভাল ছিল আর কেনই বা এখন খারাপ হয়ে গেছে সেগুলো জোর করে ভাবতে লাগলাম। জোরে জোরে বলতেও থাকলাম। ‘আরে বাবা, সব শহরের একটা কসমেটিক চেঞ্জ তো হয়ই, হয়ে নতুন ক্যারেকটার তৈরি হয়, রুটটা তো আর বদলায় না’— শুনেও শান্ত হতে পারছিলাম না। তা হলে সিন্ধিয়া ঘাটে জায়গা আছে, জায়ান্ট হুইল লাগালেই হয়, উঠলে ফুল কাশী দর্শন হয়ে যাবে। নীচে বেনারসের ছাতাগুলো ফুটে থাকবে ব্যাঙের ছাতার মতো।

বেনারস বদলাচ্ছে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে, আমি নিজেকে বদলাতে পারছি না। চাইছিও না বোধহয়। স্রেফ পালানোর চেষ্টা করছি ক্ষণিকের জন্য। দোষী লাগছে। অসহায় লাগছে। জলের দিকে তাকালাম। দেখি আরও প্রদীপ ভেসে আসছে। খুব ধীরে ধীরে, নিভছে না কেউ। এক সময় সব এক হয়ে গেল একই জায়গায়, সকালের সাদা পাখিগুলোর মতো। এ বার ওরা এগিয়ে আসছে আমার দিকে। একটা আলোর নকশা তৈরি করছে। গোল মালার মতো ফর্মেশন হল প্রথমে। যেন হাত ধরাধরি করে অনেকগুলো মেয়ে নাচছে। বদলে, নৌকোর চেহারা নিল। দাঁড় আর জলের আওয়াজও শুনছি যেন। অদৃশ্য মাঝিও আছে নিশ্চয়ই। নিতে এসেছে আমাকে।

suvolama@gmail.com

subhamoy mitra varanasi just jachchi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy