সুভাষ চক্রবর্তী: কেন পালটাব রে ভাই? এই যে আমি নেই, সেই পাঁচ বছরে রাজ্যে কিছু পালটেছে? হ্যাঁ, ডালহৌসি পাড়ার লালবাড়িটার বদলে রাজ্যটা এখন গঙ্গাপাড়ের চোদ্দো তলা থেকে চালানো হয় আর সেখানে আমাদের পার্টির কেউ বসে না! তা ছাড়া আর কী পালটেছে? আগে যেমন ও-পাড়ার স্কুল কমিটি থেকে এ-পাড়ার ক্লাব কমিটি, সব জায়গায় আমাদের লোকই থাকত, এখন ওদের লোক থাকে। আগে লোকসভা থেকে পঞ্চায়েত, পুরসভা থেকে বিধানসভা, সব ভোট আমরা ‘করাতাম’, এখন ওরা ‘করায়’। আগে বেশির ভাগ পুরসভার বেশির ভাগ ওয়ার্ডেই আমাদের দখল থাকত, এখন ওদের থাকে। সব কিছু যেমন ছিল, তেমন রইল, আর সগ্গে গিয়ে শুধু আমার টাকে সল্টলেক স্টেডিয়ামের মতো অ্যাস্ট্রোটার্ফ গজাবে?
প্রতি: স্বর্গ? আপনি স্বর্গে? মার্ক্সবাদীরা স্বর্গ-ফর্গ মানেন?
সুভাষ: আমি তো ভাই কোনও দিনই ও-সব কেতাবি বুলি-ফুলির ধার ধারি না। আমার হল ফলিত মার্ক্সবাদ! সেখানে কাস্তে, হাতুড়ি, তারা, তারাপীঠ, জবাফুল, পুজো, স্বর্গ, নরক সব আছে। আমি তো কবেই বলেছি, ‘আমি আগে হিন্দু ঘরের বামুনের ছেলে, তার পর মার্ক্সবাদী পার্টি নেতা!’
প্রতি: কিন্তু আপনি ডালা হাতে তারাপীঠে পুজো দিচ্ছেন, সে ছবি বাজারে বেরনোর পর আপনার প্রিয় নেতা জ্যোতিবাবু তো আপনাকে বকেছিলেন?
সুভাষ: দ্যাখো জ্যোতিবাবুর চেয়ে বড় নেতা আমাদের পার্টিতে আগেও কেউ ছিল না, পরেও কেউ আসবে না! উনি আমার ‘ভগবান’। তবে একটাই কথা। আমার পুজো দেওয়া নিয়ে এত কথা হল। কিন্তু পার্টির এক মস্ত ব্যারিস্টার নেতা-এম.পি যখন ঘটা করে নাতির পৈতে দিলেন, তাই নিয়ে জ্যোতিবাবু কিছু বলেছিলেন বলে তো শুনিনি। আসলে এই একচোখোমি ব্যাপারটা কমিউনিস্ট পার্টি ভাগাভাগি হওয়ার আগে থেকেই আছে— এলিট-নেতাদের জন্য এক নিয়ম, আর আমার মতো উদ্বাস্তু কলোনির ছেলের জন্য আলাদা ব্যবস্থা! ও সব নিয়ে ভাবি না! আসল কথা হচ্ছে, ধর্ম নিয়ে আমাদের পার্টি যে বিধবা পিসিমার মতো শুচিবাইপনা করে বেড়ায়, সেটার মানেই হয় না! আরে তৃণমূলকে দ্যাখো! ওদের কলকাতার বড় নেতারা আগে পাড়ার পুজোর সেক্রেটারি, ট্রেজারার এ সব হচ্ছে, তার পর এলাকার নেতা। জনসংযোগের কাজটা পুজোমণ্ডপেই হয়ে যাচ্ছে। ওই জন্যেই কলকাতা কর্পোরেশনের বেশ ক’টা ওয়ার্ডে আমরা ৩৪ বছরে দাঁত ফোটাতে পারিনি।
সুভাষ চক্রবর্তী, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত ভয়ে, শ্রদ্ধায় ও রোমাঞ্চে নড়ে যাওয়ায়, ছবিটা কেঁপে গেছে।
প্রতি: আপনার মন্ত্রশিষ্য সুজিত বসুও তো বিশাল পুজো করেন...
সুভাষ: পার্টি তো তাকে রাখতে পারল না! মমতা কোল পেতে দিল! সিপিএম ছেড়ে সুজিতের ক্ষতি হয়েছে ঘণ্টা! যা গেছে পার্টির গেছে!
প্রতি: সুজিত বসু তো আপনার ফলিত মার্ক্সবাদের একটা এক্সপেরিমেন্ট, তাই না? এমন ‘এক্সপেরিমেন্ট’ তো আপনার আরও আছে?
সুভাষ: তোমার কথায় একটু চুলকুনি আছে বুঝতে পারছি! শোনো, ‘দুষ্টু’ ছেলেদের আমার ভাল্লাগে। ওরা কাজেও লাগে। আমাদের তত্ত্বের ভাষায় ওদের ‘লুম্পেন প্রোলেতারিয়েত’ বলে। বলশেভিক বিপ্লবের সময় লেনিনও তো ওদের কাজে লাগিয়েছিলেন!
প্রতি: হাতকাটা দিলীপ-রা তা হলে বিপ্লবের যন্ত্র?
সুভাষ: ও সব একটা-দুটো নাম ভাসিয়ে লাভ নেই, বুঝলে! আমরা কিন্তু বিপ্লব করে ক্ষমতায় আসিনি। এখানে আপাতত লড়াইটা ছিল ভোট। আর সেই লড়াইটা জিততে লাগে ‘মেশিনারি’।
প্রতি: মেশিনারি না ‘মার্সেনারি’? ভাড়াটে সৈনিক, যারা ক্ষমতার হয়ে ভাড়া খাটে! কাল আপনাদের হয়ে খেটেছে, এখন তৃণমূলের জন্য খাটছে, গল্পটা তাই তো?
সুভাষ: আরে, মিডিয়ার লোক সরল পাটিগণিত ছাড়া কিস্যু বোঝে না! ওই ছেলেগুলো আসলে ভালবাসার কাঙাল! আমি ওদের ভালবেসেছিলাম, তাই ওরা আমায় ভালবেসেছে। আমায় ভালবেসেছে বলে আমার পার্টিকে ভালবেসেছে। আর পার্টিকে ভালবেসেছে বলেই ভোটের লড়াইয়ে জান দিয়ে ঝাঁপিয়েছে!
প্রতি: হ্যাঁ, পার্টিকে ভালবেসেছে বলেই ভোটারদেরও ভালবেসেছে। আর সেই ভালবাসা থেকেই তাদের রোদে পুড়ে-ঘেমে-নেয়ে লাইনে দাঁড়াতে দেয়নি! নিজেরাই ভোটটা দিয়েথুয়ে তাদের সানস্ট্রোক থেকে বাঁচিয়েছে।
সুভাষ: আরে বলছি না, রাজনীতিতে দুয়ে দুয়ে চার হয় না! ভোট-মেশিনারি মানেই কিন্তু বুথ-দখল আর ছাপ্পা ভোট নয়! ও সব ‘বাহাত্তুরে কংগ্রেসি কালচার’! টিএমসি সেটা ইনহেরিট করেছে। আমাদের মেশিনারি, বা বলতে পারো আমার মেশিনারি, ভোটে জেতাটাকে মসৃণ আর নিশ্চিত করত শুধু। জেতার জন্য কাছাখোলা হয়ে ৮০০ ভোটারের বুথে ৮৪৬টা ভোট দিয়ে মুখ পোড়াত না। হ্যাঁ, খুব ‘মার্জিনাল’ এলাকায় কখনও ভোটার ঠেকাতে হয়নি, তা নয়। তবে আমার ছেলেরা কখনওই আরামবাগ, গোঘাট, গড়বেতা বা বোলপুরের কমরেডদের মতো আহাম্মকি করেনি! এমন ভোট ‘করালো’ যে এখন বুথে বসার লোক পাওয়া যায় না। আরে বাবা, পাবলিকের পাল্স’টা বুঝবি না? জল মেশাতে মেশাতে পুরো দুধটাই জল করে ফেলবি?
প্রতি: ‘বহিরাগত’রা কি আর দুধ-জলের হিসেব-অনুপাত রাখতে পারে? বাড়াবাড়ি তো হবেই!
সুভাষ: এই বহিরাগত থিয়োরিটাই মিডিয়ার বাড়াবাড়ি! বহিরাগত আবার কে? সব কি ভিয়েতনাম-কিউবা-কোরিয়া থেকে ভোট করাতে আসত! উত্তর ২৪ পরগনার কমরেডরা ভোটের দিন কলকাতা পার্টির পাশে দাঁড়াতে পারবে না? হাওড়ার পার্টিজানদের কোলাঘাটে আটকে দেওয়া হবে? এ কি ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ না জরুরি অবস্থা? মিডিয়ার কাছে ভাল ছেলে সাজতে আমাদের পার্টির দু-এক জন ধোপদুরস্ত আদর্শবাদী নেতাও বহিরাগত ঠেকাতে নেমে গিয়েছিলেন। আমার সরকারের পুলিশ আমার ছেলেদের মাথায় লাঠি মারল। ফলটা কী হল? জেতা সিটে হেরে গেলাম। ছেলেরাও পার্টির ওপর অভিমান করে বসে গেল!
প্রতি: তা হলে এই যে এপ্রিলে পুরভোটে তৃণমূল সরকারের পুলিশ গুলি খেয়ে হজম করে গেল, রা-টি কাড়ল না, এটাই ‘আইডিয়াল’ পরিস্থিতি বলছেন?
সুভাষ: দূর দূর! ওদের কে নিজের লোক, কে বাইরের লোক তার হিসেবই নেই! নিজেদের ভোটারদেরই পিটিয়ে দিচ্ছে! আসলে পুলিশ-ভোটার-ক্যাডার আর ওই যারা পার্টিকে ভালবেসে আসছে, তাদের সবাইকে নিয়ে একটা ‘ফিল গুড’ পরিবেশ তৈরি করতে হয়— যাতে যে লোকটার ফল্স ভোট পড়ে গেছে, সে অবধি হাসি-হাসি মুখে বাড়ি ফেরত যাবে। এটা একটা আর্ট। তৃণমূলের আনাড়িরা ও সব বুঝবেই না।
প্রতি: কিন্তু যে আপনি ‘মরা মানুষ বাঁচানো ছাড়া’ সব পারেন, সে-ই আপনার এলাকাতেই আপনাদের হেভিওয়েট ক্যান্ডিডেট হেরে গেছেন, এমনও তো হয়েছে?
সুভাষ: ওটাও ওই ভালবাসার খেলা রে ভাই! যারা আমায় ভালবেসে, পার্টিকে ভালবেসেছে, পার্টির যে ‘অফিশিয়াল’ ক্যান্ডিডেটকে আমি ভালবাসছি না, ওরাই বা তাকে ভালবাসবে কী করে? আর এক দিন এসো, এ ব্যাপারে লেনিন কী বলেছেন, বলে দেব।
sanajkol@gmail.com
ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকেরবার্গের ছোট নাতনি স্টেটাস জুকেরবার্গের ভারতে সফর এবং তাঁদের ‘ফেসবুক-ফ্রেন্ডলি’ মাইক্রোওভেন, ক্যালকুলেটর ও পাপোশ উদ্বোধনের খবরে সারা দেশ মেতে থাকলেও বাংলা বাঁচাও অ্যাসোসিয়েশন (বিবিএ)-এর মনে আশংকার কর্কশ রিংটোন বেজে উঠেছে। শেষ পাঁচটি বাংলা মিডিয়াম স্কুলের একটি পরবর্তী শিক্ষাবর্ষে ইংরেজিতে ‘ইভলভ্’ করার কথা জানিয়েছে। বাকি চারটিকে সরকার ‘ভিন্টেজ’ ঘোষণা করেছে। সিলেবাসের আমূল পরিবর্তন, গদ্য-পদ্যগুলিকে আরও ছোট করা, টেক্সটবইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে ‘ঝিঙ্কু’, ‘ল্যাদ’, ‘ঘাপলা’ প্রভৃতি শব্দ ও ‘পাগলা ক্ষীর খা’, ‘লে পচা, কোমর নাচা’-র মতো ফ্রেজ-এর ব্যবহার যথেচ্ছ বাড়িয়েও আখেরে লাভ হয়নি। ছাত্রদের বাংলা ভাষার প্রতি বিতৃষ্ণা, সাহিত্যচর্চার চেয়ে ফেসবুক, হোয়াট্সঅ্যাপ, অনলাইন মারপিট-এর প্রতি ঝোঁককেই এই ভরাডুবির জন্যে দায়ী করা হচ্ছে। ‘বাবা-মায়েরা যে ভাবে তাদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মিডিয়ামান্তরিত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়’, টুইট করেছেন এক ভাষাবিদ। ক’দিন আগেই ‘বাংলা ভাষা ফুরিয়ে গেছে’ বলে কলেজগুলি থেকে যে রব উঠেছিল, তাকে ‘ইমপেটাস্’ জুগিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ‘সে নো টু বেঙ্গলি’ আন্দোলন। বাংলা শিক্ষকদের বহিষ্কার এবং সাবজেক্টটিকে উচ্চশিক্ষার মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমে তারা বিবিএ-র কর্মসূচিতে জোর ধাক্কা দিয়েছে। বিবিএ দু’বছর আগে অবশ্য কয়েকটি বাংলা সংবাদপত্রের লক-আউট রুখে দিয়েছিল, কিন্তু এখন ব্যাপার আরও ঘোরালো। বাংলায় কঠিন শব্দ প্রয়োগ করলেই সংবাদপত্র অফিসে ইংরেজি গালির টাইফুন ধেয়ে আসছে। সদ্যসমাপ্ত কলকাতা বইমেলা ঘুরে বিবিএ কর্তাদের মুখ ছিল বাংলার পাঁচের মতো, কারণ মেলার বাংলা বইয়ের স্টল সংখ্যাও ছিল সেই ‘৫’।
স্বর্ণাভ দে, নবপল্লি, গড়িয়া
লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
চোলি কে পিছে অপসংস্কৃতি হ্যায়
১৯৯৩ সাল। উদারীকরণের ঢেউ ভারতের বুকে আছড়ে না পড়লেও, নোনা জল সবে ঢুকতে শুরু করেছে। ক্লাস সেভেন। বাবা হঠাৎ এক দিন বলল, বিকেল চারটে থেকে ছ’টা ডিডি মেট্রো যেন খোলা না হয়। বাবা কমল মিত্রের মতো আদেশ দিলেই আমি তা উত্তমকুমারের মতো ‘যে আজ্ঞে’ বলে মেনে নেব, তা তো হয় না। বললাম, কেন? বাবা বলল, ‘তখন এমটিভি দেখানো হবে।’ আমি তো অবাক। তখনও আমরা অবাক হতাম। এখনকার ছেলেপুলের মতো সবজান্তা ছিলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, দেখানো হলে দেখব না কেন? হাতে ধরা খবরকাগজ থেকে বাবার সদ্যলব্ধ জ্ঞান অনুযায়ী: ওটা মার্কিনি মিউজিক চ্যানেল, তাই। আমার প্রতিবাদ ও প্রতিপ্রশ্ন, তো? দেখলে ক্ষতি কী? বাবা যুক্তি-তর্কের ধার না ধেরে সটান বলল, ‘বারণ করেছি, দেখবি না। কারণ ওটা অপসংস্কৃতি।’
অপসংস্কৃতি? সেটা আবার কী? সংস্কৃতি মানে তো জানি, পঁচিশে বৈশাখ। অপসংস্কৃতিটা ত্রৈরাশিক না ভগ্নাংশ? এটুকু বুঝলাম, অপসংস্কৃতি একটি নিষিদ্ধ বস্তু। যুক্তি-তক্কে না গিয়ে তার স্বাদ ভক্ষণই আশু কর্তব্য। চুপিচুপি ১০-১৫ মিনিট করে বছরখানেক কি মাসছয়েক দেখেছিলাম বোধহয়। তাতে মাইকেল জ্যাকসন-ম্যাডোনা প্রমুখ মার্কিনি গন্ধর্বের নাচগান দেখাত। তাতে সত্যি কথা বলতে কী, আমি সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতি কোনওটাই খুঁজে পাইনি, এমনকী নিষিদ্ধ মজাও পাইনি।
অপসংস্কৃতি-স্বরূপ সেই নিষিদ্ধ মজা ক’দিনের মধ্যেই আদ্ধেক ভারতকে নাড়িয়ে দিল, সৌজন্যে ‘খলনায়ক’ বলে একটি সিনেমা। যার একটি গান ‘চোলি কে পিছে’। যে গানে নীনা গুপ্তা মাধুরী দীক্ষিতকে জিজ্ঞেস করছেন, মাধুরীর চোলির পিছনে এবং চুনরির নীচে কী আছে। আমি তো উৎকর্ণ হয়ে রইলাম, উত্তরে মাধুরী কী বলেন। মাধুরী বললেন, চোলির পিছনে আর চুনরির নীচে ওঁর হৃদয় আছে মাত্র। বাঘা আমিষ প্রশ্নের জবাবে এ হেন রাম-নিরামিষ উত্তরে আমি ভারী বিরক্ত হয়েছিলাম। যা-ই হোক, ‘চোলি কে পিছে’ মারাত্মক রকম যৌন-ইঙ্গিতপূর্ণ এবং অপসংস্কৃতি বলে কুখ্যাত হল।
১৯৯৩-এর ব্লকবাস্টার হিট ছবি ‘খলনায়ক’-এর সেই বিখ্যাত গানের দৃশ্য।
মাধুরী দীক্ষিতের নাচ কাঁপিয়ে দিয়েছিল সারা দেশ।
তখন এন্তার টিভি চ্যানেলে সন্ধেবেলা চণ্ডীমণ্ডপ বসত না। তবে হরেক কাগজে হরেক তর্কবিতর্ক বেরত আর ‘অপসংস্কৃতি’ শব্দটি নিয়ে প্রচুর কচলাকচলি হত। তাতে কেউ ‘অপসংস্কৃতি! অপসংস্কৃতি!’ রব তুললে, পালটা কেউ হয়তো ‘অপসংস্কৃতির সংজ্ঞা কী’, ‘কার মেসো তা ঠিক করবে’, ইত্যাদি প্রশ্ন তুলত। কেউ যদি বলত, ‘আমরা কি এই চোলিসংস্কৃতির কাছে নিজেদের মাথা বিকিয়ে দেব?’ তবে পালটা লেখা হত, চোলি ভারতীয় পোশাক, শকুন্তলা পর্যন্ত পরতেন। এটা আমাদের সংস্কৃতিরই অঙ্গ।
চোলির বছরই ‘আঁখে’ বলে আর একটি সিনেমার গান অপসংস্কৃতির ঝড় না তুললেও আলোড়ন তুলেছিল। যে গানে নায়ক গোবিন্দাকে তাঁর প্রেমিকা ‘বাবা-মা কেউ ঘরে নেই, তুমি এসো প্রিয়... বিছানা গরম করো’ ইত্যাদি বলে আহ্বান করছিল। এই গানটিও যৌনতাদোষে দুষ্ট এবং অপসংস্কৃতির ফল-ফসল হিসেবে বদনাম কিনেছিল। মাঝখান থেকে যেটা হল, যৌনতা ও অপসংস্কৃতি দুই নিয়েই ধোঁয়াশা থাকলেও আমি বুঝলাম, ভারতীয় অভিধানে এই দুটি একই শব্দের ভিন্ন রূপ।
চোলিসংস্কৃতির পরের বছরই আর একটি গান সাইক্লোনের মতো আছড়ে পড়ল। আলিশা চিনয়-এর খুকি-খুকি গলায়, নায়িকা করিশ্মা কপূর জানতে চাইলেন, ওঁকে কেন সবাই ‘সেক্সি’ বলে, ওঁকে দেখতে সুন্দর, ওঁর চুল, হাসি সুন্দর, তাতে ওঁর কী দোষ। গানটা হিট করল খালি ওই লিরিক্সের মধ্যে ঘুরেফিরে ‘সেক্সি’ শব্দটির পুনরাবৃত্তির জন্য। আপামর ভারতবাসীর মনের গহনে এই ইনফর্মাল ইংরেজি শব্দটি পৌঁছে গেল। এইট-এ পড়ি তখন। ত্রিকোণমিতি শুরু হতে দেরি, কিন্তু এই গানের বদৌলতে শিখে গেলাম ত্রিকোণমিতির প্রথম পাঠ, 1/CosC= SecC. এ বারও ‘অপসংস্কৃতি! অপসংস্কৃতি!’ বলে অনেক বাদ-বিসংবাদ হয়েছিল। সেন্সরের প্রবল চাপে ‘সেক্সি’র জায়গায় ‘বেবি’ বসিয়ে নতুন করে গানটি বাজারে ছাড়াও হয়েছিল। তাতে কী, জনমানসে ‘চোলি কে পিছে’র গায়ে গায়েই জায়গা করে নিল ‘হাই সেক্সি হ্যালো সেক্সি’।
সে সময় মধ্যবিত্ত বাঙালি-মানসে এই সব গানের শো-রুম ‘সুপারহিট মুকাবলা’কেও অপসংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে গণ্য করা হত। ’৯৪-তেই আর একটি গান এবং সে গানের কল্যাণে সিনেমা— দুটোই সুপারহিট হয়। ‘মোহরা’ ছবির ‘তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত্ মস্ত্’। গানটি যেন ভোগবাদের হাত ধরে আসা সামাজিক অবক্ষয়কেই সূচিত করে, যেখানে প্রিয়তমা নারী আর অর্ধেক আকাশ-টাকাশ নয়, বরং নিছকই একটি যৌনবস্তু, মস্ত্ চিজ। এর অনুসারী শিল্প হিসেবে এ রকম কতশত গান তখন রচনা হয়েছে। আজও হয়ে চলেছে।
যাই হোক, মুক্ত বাজারের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও সাবালক হলাম। আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ও অপসংস্কৃতির ধাক্কা সামলাতে সামলাতে এক দিন দিব্যি লায়েক হয়ে গেল। পরের বছর, ১৯৯৫-তে রিলিজ-হওয়া ফিল্ম ‘রঙ্গিলা’য় ঊর্মিলা মাতন্ডকর শরীরী লাস্যের ঢেউয়ে আমাদের ভাসিয়ে দিলেও, কেউ আর ‘অপসংস্কৃতি!’ বলে চেঁচাল না। খালি একটা গোলের মধ্যে একটা বড় হাতের ‘A’ এঁকে দিল। বোঝা গেল, যৌনতা আর অপসংস্কৃতির সমার্থক শব্দ রইল না। আস্তে আস্তে ‘অপসংস্কৃতি’ টার্মটাই তামাদি হয়ে গেল বছর কয়েকের মধ্যে। নব্বইয়ের দশকেই তার ভবলীলা সাঙ্গ হল।
নির্মাল্য দাশগুপ্ত, বেলঘরিয়া, কলকাতা
nirmalyadg@gmail.com
নইয়ের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 90’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy