Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
উদ্দালক নামে ডাকো

আমার প্রথম বই

প্রথম বই তো কবিতার বই। তা ছাড়া কী-ই বা হতে পারত আর? কিন্তু প্রথম কবিতা লেখা, আর প্রথম কবিতার বই তো সম্পূর্ণ ভিন্ন শিরঃপীড়া। কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম, মনে হয়, মায়ের পেটের ভিতর থেকেই। কেবল তখন ওগুলোর নাম জানতাম না। প্রায় শিশুবয়সে আমাদের সেই বড় পরিবারের বিরাট বাড়িতে কখনও কখনও বড়দের মধ্যে এমন চাপা চাপা রাগ, কখনও মায়ের চোখে কি অন্য কারও, জল দেখতাম— যা আমাদের ছোটদের জানার কথা নয়।

জয়া মিত্র
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

প্রথম বই তো কবিতার বই। তা ছাড়া কী-ই বা হতে পারত আর? কিন্তু প্রথম কবিতা লেখা, আর প্রথম কবিতার বই তো সম্পূর্ণ ভিন্ন শিরঃপীড়া। কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম, মনে হয়, মায়ের পেটের ভিতর থেকেই। কেবল তখন ওগুলোর নাম জানতাম না। প্রায় শিশুবয়সে আমাদের সেই বড় পরিবারের বিরাট বাড়িতে কখনও কখনও বড়দের মধ্যে এমন চাপা চাপা রাগ, কখনও মায়ের চোখে কি অন্য কারও, জল দেখতাম— যা আমাদের ছোটদের জানার কথা নয়। তখন আমি মাটিতে বসানো জলের কলসিগুলোর সমান উঁচু। কী অনির্দিষ্ট ভয় যে গ্রাস করে নিত! তার পর সাত-আট বছর বয়সে যখন পাহাড়ে থাকি, এক এক দিন দূরে সামনাসামনি পাহাড়ের মাঝখানের ভাঁজ দিয়ে চমকানো বিদ্যুৎ বুকে নিয়ে বালাসন নদীর খাত ধরে সরাসরি এগিয়ে আসে ঘন মেঘ, শীতকালে কোন সময়ে দিনরাত্রি সমান ভাবে আকাশের গায়ে ঝকঝক করে কাঞ্চনজঙ্ঘা, সেই বয়সের গলার কাছে কী যেন আটকে যায়, কিন্তু তার নাম বলা যায় না। লিখে রাখার চেষ্টা করি অদ্ভুত যে সব লাইন মনে আসে তাই দিয়ে।

যে লাইন আমি নিজে বুনেছি, আর যা করিনি কিন্তু বেশ মনের মতো ভাল লেগেছে— দুটো যে খুব আলাদা এমন খুব স্পষ্ট ধারণাও নেই। একসঙ্গেই লিখে রাখি। কেবল মা’কে দেখাই খাতা। মা শুধু বলেন ‘ভাল হয়েছে’। আর কিছু নয়। তাই, এ রকম যে সকলের মনে হয় না, সবাই লিখে রাখে না— সে কথা জানা যায়নি। স্কুলে কাউকে বলবার বিষয় তো নয় এটা।

উঁচু ক্লাসে উঠে কলকাতা শহর। সেখানে সব কিছুতেই ভয় আর অস্বস্তি। স্কুলের হোস্টেল। বাইরে থেকে এসে উঁচু ক্লাসে ভর্তি হওয়া মেয়ে। ভাল করে বাংলা লিখতে জানে না। আরও বেশি চুপ করে থাকা। একা হয়ে থাকা আরও। কলেজ হোস্টেল। তারই মধ্যে ১৯৬৬ সাল। বাংলায় ভুখামিছিল, গুলি। হোস্টেলের, বাড়ির, নিরাপত্তার সব পাঁচিল টপকে বাইরেটা লাফিয়ে পড়ল ঘরের ভেতর। বড়দের রাগ, মায়ের কষ্ট, পুরুষদের— বয়স্ক পুরুষদের বিদ্বেষ, গ্রাম বস্তি জেলখানা। ফিরে আসা। সমাজের গোল গর্তে নিজেদের অস্তিত্বের চৌকো খুঁটিটাকে কিছুতেই ঠিকমত বসাতে না পারা। আর তখনই আবার— কবিতা। এ বার সচেতনে, সমগ্র চৈতন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রাস করে নেওয়া কবিতা। সব বুঝতে-না-পারা, বোঝাতে-না-পারা, সব ভয়, সব লুকনো রক্তপাত আড়াল করে দাঁড়ানো শব্দরাজি। নতুন করে শুরু হচ্ছে জীবনবাস্তবতার অর্থ বোঝা। নতুন পারিবারিক সামাজিকতা, নতুন অধ্যয়ন, নতুন একাকিত্ব।

এক-দুই জন করে বাড়ছে আমার কবিতা পাঠকের সংখ্যা। ছোট আড্ডায় বন্ধুদের মধ্যে পড়ি, শুনি। কবিসভায় যাই না। কবিতার শব্দদের সঙ্গে সম্পর্ক এত ব্যক্তিগত, এত বেশি নিজের সব কথা ওখানে রাখা থাকে, মাইকে সে সব কথাকে জোরে জোরে বাজানো যায় নাকি! আসানসোল-কলকাতার দু-তিন জন কবিবন্ধু না বলে টুকে আনা দশটা কবিতা নিউজপ্রিন্টে বড় কাগজ ভাঁজ করে ফোল্ডার ছেপে তৃতীয় বছরের বইমেলায় লিট্ল ম্যাগাজিন কর্নারে হাতে হাতে বিলি করেন। একটা ভাঁজে তার কভারও তৈরি করেছিলেন পৃথ্বীশ। পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়। অমিতাভ দাশগুপ্ত বলার চেষ্টা করেন ‘কবিতা লেখা তো অন্যদের পড়ানোর জন্যই। কবিতা ছাপা হওয়া আনন্দের কথা, রেগে যাচ্ছ কেন?’ কনভিন্সড হইনি। এখনও হইনি ঠিক।

তবু ভিক্টোরিয়ার মাঠে বিকেল পড়ে আসা বাতাসে লিট্ল ম্যাগের টেবিলগুলোর সামনে ‘ভূতগুলো সব গেল কোথায়?’ লেখা চওড়া কালো কাপড়ের ফেস্টুন, বেশি ক্ষণ কি রেগে থাকা যায়?

সেই সময়ে লেখা মৃত্যুভাবনায় ভরপুর সব কবিতা। ভাবনার নতুন আশ্রয়ের খোঁজে তখন ভূগোল পড়ছি, সমাজতত্ত্ব, পুরাণ, প্রত্নতত্ত্ব আর মহাভারত। মনে হচ্ছে মহাভারত যেন এ দেশের সব কবিতার আকরভূমি। মহাভারতে মৃত্যুর জন্মবৃত্তান্ত যে পড়েছে তাদের প্রত্যেককে সৃষ্টি করতেই হবে আপন আপন মৃত্যু। সেই সময়কার কবিতা ‘বিষাদ যে মহাধনু, রুদ্র করে ধরে আছে...’ এত কাল পর অর্থ পালটে সে আমার পঞ্চম কবিতার বই ‘কালো ময়ূর...’ এর প্রস্তাবনা। কিন্তু পঞ্চম বইয়ের অনেক আগে তো ছিল এক প্রথম বই। প্রথম কবিতার বই, ‘উদ্দালক নামে ডাকো’।

কিছু বন্ধুজন, সেই ১৯৮৮’তে, নিয়মিত আড্ডা দেন ‘বসন্ত কেবিন’-এ। অঞ্জন সেন প্রদীপ ভট্টাচার্য বীরেন্দ্র চক্রবর্তী-সহ কয়েকজন মিলে কবিতা বাছছেন, বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করার জন্য। ‘প্রমা’র সুরজিত ঘোষ ছাপাবেন। আমি এক বার রাজি হচ্ছি, এক বার হচ্ছি না। কারণ সেই একই, সংকোচ। কবিতা কি খুলে মেলে অন্য কাউকে পড়তে দেওয়ার জিনিস? তখন এমনকী কোনও পত্রিকায় কবিতা ছাপতে দিতেও আপত্তি ছিল। নিজের হাতে লেখা শব্দ/ লাইন যখন ছাপার অক্ষরে ফিরে আসে, কী রকম নৈর্ব্যক্তিক নীরক্ত দেখায় সেগুলোকে। যেন আমার লেখাই নয়। তারই মধ্যে এক দিন অঞ্জন সেন, অমিতাভ গুপ্ত হইচই করে বললেন, ‘উদ্দালক নামে ডাকো’ কবিতাটা পড়ে গণেশ পাইন একটা ছবি এঁকে দিয়েছেন। সেটা দিয়ে বইয়ের কভার হতে পারে। শুনে তো একেবারে অভিভূত! কোথাকার কে এক কবি, তার কবিতা পড়ে নিজে থেকে ছবি আঁকলেন গণেশ পাইন! যাঁর ছবির, রঙের, রহস্যঘনতার আমি যাকে বলে কিনা ‘কায়ল’— সেই কবে থেকে। কলকাতা চলে গেলাম সেই ছবি দেখতে। বসন্ত কেবিনেই দেখা হল। পোস্টকার্ড আকারের কাজ, হাতে দিয়ে বললেন, ‘দেখুন, চলবে?’ আর কী হবে দ্বিধা রেখে! এই কভার ছাপাবার জন্য একটা বই তো হতেই হবে।

১৯৮৯, এপ্রিল মাস। ঝাঁ ঝাঁ গরম দুপুরে তখনকার ‘রক্তকরবী’ প্রকাশনার ছোট অফিস। গণেশ পাইনের কভার ছাপা হচ্ছে— এই উত্তেজনায় ছটফট করছি পনেরো দিন ধরে। কেমন দেখতে হল? সবুজাভ কাজ। ঘাসে কাদায় পাশ ফিরে শুয়ে থাকা এক জন। তার কাঁধে আর ভাঁজ করে রাখা ঊরুর ওপর একটু আলো। সম্পূর্ণ সমর্পণের এলায়িত অবয়ব। মনে হয় হাত দিলে আঙুল ভিজে যাবে। কিন্তু সে দিন ‘রক্তকরবী’র টেবিলে সেই বান্ডিল বাঁধা বাঁধা সব বই সাজানো দেখে একটা জোর ধাক্কা লাগল আবার। মাথায় স্পষ্ট ঝাঁকানি দিয়ে ঢুকল ব্যাপারটা। এই যে টেবিলভর্তি এত এত বই, এ তো কেবল গণেশ পাইনের আঁকা মলাট নয়, তার সঙ্গে তো আছে অতগুলো কবিতা। এ বার যেগুলো ওই যান্ত্রিক ছাপানো হরফের নৈর্ব্যক্তিকতা বেয়ে চলে যাবে আমার সমস্ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সম্পূর্ণ অচেনা লোকেদের হাতে। তারা নানামত করে এই সব কবিতার ছানবিছান করবে। যত করবে, এই সব শব্দ হয়তো ততই নিজেদের শক্ত করে বন্ধ করে ফেলবে। ‘অসমান মাটিতে পা ফেলে/ দৌড়ে যায় জল/ তুই সেইখানে গালে ঠোঁটে হিম/ তোকে ছোঁয় অন্ধকারে সমস্ত নক্ষত্র হাওয়া...’ কিংবা ‘সাইরেনে চিৎকার করে লাল/ গাঢ়, রক্ত লাল/ ছুটে চলে যায়/ কোমল গান্ধারে/ আর্টারির মুখ ছিঁড়ে/ ছিটকে ওঠে শব্দের ফোয়ারা’— কেন যে রাজি হলাম ছাপাতে। নাটক দেখে ফেরার সময় রাস্তা আর নদীর মাঝখানটুকুতে ঘন অন্ধকারে ঘাসমাটির ওপর সেই এক মিনিট শুয়ে থাকা— মুখের ওপর তারা-ঝমঝমে আকাশ যেন কোনও তীব্র আঘাতের মতো, পিঠের নীচে কয়েক মুহূর্তের স্পর্শময় শুকনো ঘাস, অসমান মাটির অলৌকিকতা, বালি রঙের প্রান্তরজোড়া ‘কিছুই না’র চুড়োয় বসে থাকা একমুঠি নীল পাখিটি— অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এর ক্যাটালগের ছবিতে নিমগ্ন অন্যমনস্কতার পাশ দিয়ে আমার ব্যাগ নিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যেতে থাকা বাড়ি ফেরার ট্রেন— সেই সব অনুভূতির সাক্ষী এই শব্দগুলো, অনাথের মতো এরা কেবল নিজেদের ছাপা চেহারা নিয়ে শুকনো মুখে অজানা, অচেনা পাঠকদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে, কী করে খুলে দেখাবে নিজেদের প্রাণ?

সামনে উপস্থিত বন্ধুটি, যিনি আমাকে অবাক করে দেওয়ার জন্য সমস্ত ঝক্কি পুইয়ে একেবারে বাঁধাইখানা থেকে সমস্ত বই আনিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন, নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন আমি উচ্ছ্বসিত খুশি হব, তিনি আমার মুখ দেখে হয়তো একটু অপ্রস্তুত। আমার অবস্থা খানিক সেই মেয়েটির মতো, যাকে ডাক্তার তক্ষুনি বলেছেন, ‘আপনি মা হতে চলেছেন’। সব বিখ্যাত স্নেহ ও বাৎসল্যময় উচ্ছ্বাস ইত্যাদিরও আগে প্রথম তার যে নিজের শরীর থেকে ছুটে পালিয়ে যাওয়ার, পরিত্রাণ পাওয়ার জান্তব ইচ্ছার কথা সে পরে আর কোনও দিন নিজের কাছেও স্বীকার করবে না, ঠিক সেই রকমই ওই বইগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম মুহূর্তটি।

তার পর একে একে অন্য বন্ধুরা এলেন।

তার পর তো কালে কালে সবই সয়ে গেল। এমনকী সাহস করে এক দিন শঙ্খ ঘোষ-এর বাড়িও যাওয়া হল। তাঁকেই উৎসর্গ করা ছিল তো সেই প্রথম বই।

তারও এক বছর পরে ‘হন্যমান’ গদ্য লেখা। কোনও কিছুই আর আড়াল রইল না।

joyamitra@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

joya mitra rabibasariya anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE