Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২

জা স্ট যা চ্ছি

ঠান্ডা পড়লেই আমার ভয় করে। কারণ ওই সময়েই ঝপ করে একটা বছর শেষ হয়ে যায়। রাতারাতি একটা নববর্ষ হাজির হয় ঠিকই, কিন্তু সেই দিনটার কোনও তাপ-উত্তাপ থাকে না।

শুভময় মিত্র
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৯
Share: Save:

ঠান্ডা পড়লেই আমার ভয় করে। কারণ ওই সময়েই ঝপ করে একটা বছর শেষ হয়ে যায়। রাতারাতি একটা নববর্ষ হাজির হয় ঠিকই, কিন্তু সেই দিনটার কোনও তাপ-উত্তাপ থাকে না। তাই গরমকালের বাংলায় বছর শুরুর দিনটার অপেক্ষায় থাকি। ভাবতে ভাল লাগে যে এই দিনটা থেকেই সবাই ভাল হয়ে যাবে, সব সমস্যা মিটে যাবে, আমিও সেরে যাব। আমার আর কোনও অসুখই থাকবে না। দুপুরবেলা রোদ্দুরের মধ্যে হাজরা মোড়ে কাচ তুলে এসি চালিয়ে রাখা একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দটা চাপা গালাগালের মতো শোনাচ্ছিল। কাচটা ভেঙে দিতে ইচ্ছে করল। পারলাম না। কারণ সিগনাল সবুজ হয়ে গেল। সন্ধেবেলা চৈত্রের সেল দেখছিলাম, বেশ লাগছিল। সরু ফুটপাতে ঘেমো লোকের গুঁতোগুঁতি সত্ত্বেও রাগ হচ্ছিল না। নীল জলে চোবানো বেলফুলের মালা কিনলাম একটা। গন্ধটা তো আসল, ওতে কোনও ভেজাল নেই। টিভিতে বলছিল পরের সকালেই নতুন বছর শুরু হবে। শহরের নানা জায়গায় গানটান হবে, ধুতি পাঞ্জাবি, নতুন তাঁতের শাড়ি পরে সেজেগুজে লোকজন ভাল খাবার খাবে। আমার ও সব জায়গায় যাবার উপায় নেই। তাই সকাল সকাল কালীঘাটেই যাব, প্রত্যেক বছরেই যাই। মন্দিরে নয়, এক জনের বাড়িতে, খুব যত্ন করে কচুরি-চা খাওয়ায়, অনেকে আসে। যারা আসে তাদের সবার ভাল ক্যামেরা আছে। এক জন বলল,‘তোমার মোবাইলে তো ছবি ওঠে, চলো আমাদের সঙ্গে।’

মেলা বসে গেছে রাস্তায়। হন্তদন্ত হয়ে লোকজন চলেছে, পান্ডারা তাদের ধরছে যারা ফিরছে, তাদের হাতে বা মাথায় ঝুড়ির মধ্যে পুজোর ফুল প্রসাদ, লাল খাতা, গণেশ ঠাকুর। রাস্তার মাঝখানে কতগুলো লাল খাতা ফুলের মতো গোল করে সাজিয়ে বসে আছে একটা বাচ্চা ছেলে। কেউ নিচ্ছে না তার কাছ থেকে। তাই তার ছবি তুললাম একটা। মন্দিরের কাছে লম্বা লাইন পড়েছে, এগোচ্ছে একটু একটু করে। এক জন ভিখিরিকে কেউ অনেক সন্দেশ দিয়েছে, সে রাস্তায় ছুড়ছে, কুকুররা কাড়াকাড়ি করছে। এক জন ফোটোগ্রাফার ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই ছবি তুলে নিল।

কালীঘাট মন্দিরের পাশের গলি দিয়ে পিছনে যাওয়া যায়, সরু জায়গা, খুব ভিড়। লোকজন অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। এর পরের চত্বরেই পর পর সবাই পুজোয় বসেছে। সিঁদুর মাখানো পয়সা দিয়ে ছাপ ফেলা হচ্ছে হালখাতায়, স্বস্তিকার পাশে। পুরোহিতের মাথায় ঘাম চকচক করছে রোদ্দুরে, সেখানে গাঁদা ফুলের পাপড়ি আটকে গেছে। তার দু’ইঞ্চি দূর থেকে সেই ছবি তুলে এক জন আমাকে দেখিয়ে দিল। বলল, ‘আমি এখন রেড অ্যান্ড ইয়েলো নিয়েই কাজ করছি।’ একটা দেওয়ালে জ্বলজ্বলে লাল আর কালোতে ভোটের লেখা, পাশের দরজায় এক বৃদ্ধ। ছবিটা তুলতে গেলাম, হল না। উনি ভেতরে চলে গেলেন। ও দিকে সবাই এগিয়ে গেছে, ভিড়ের মধ্যে এক জন চেঁচিয়ে বলল,‘গঙ্গা, গঙ্গায় আছি।’ আমিও ওদের সঙ্গে সঙ্গে গেলাম।

জোয়ার এসে গেছে। কালো পাঁক ভরতি জলে ভাসতে ভাসতে চলেছে ঝলমলে ফুলের মালা। নৌকো আছে, পারাপার চলছে। ও-পারে টালির ঘর, গাছপালা। যেন একশো বছর আগের একটা ছবি। ঘাটে ছোট ছেলেমেয়েরা হাতে লম্বা সুতোয় ম্যাগনেট লাগিয়ে তাকিয়ে আছে গঙ্গার দিকে। পুজো দিয়ে, ফুল পয়সা ফেললেই তারা ঝাঁপাচ্ছে পয়সাগুলোকে টেনে নেবার জন্য। মৃত্যুর চেয়েও কালো, ভয়ংকর অসুখের বীজ-ভাসা জলে ডুব দিচ্ছে নির্ভয়ে। এই কালো জলের ব্যাকড্রপে দারুণ লাগছে আপাদমস্তক লাল সিঁদুর মাখানো এক দেবীমূর্তি। মেয়ে বউরা আসছে, ধূপ-ধুনো দিয়ে, আবির মাখিয়ে প্রণাম করে যাচ্ছে। যেই আমি ছবি তুলব বলে আমার ময়লা মোবাইল ফোন বের করেছি অমনি এক জন হুমদো মতো চোঙা-লেন্স লাগানো ফোটোগ্রাফার এসে, ‘সরুন, সরুন তো এখান থেকে’ বলে ধাক্কা মেরে আমাকে সরিয়ে ছবি তুলতে লাগল।

আমার পাশে অনেক লোক রয়েছে, সবাই দেখেছে, কেউ কিছু বলল না। আমি চুপ করে সরে গিয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুঝতে পারছিলাম, রাগে, রোদে, অপমানে মাথার ভিতরটা দপদপ করছে। ভাবছিলাম কালীক্ষেত্রের দুশো গজ দূরে এমন ঘটনা ঘটছে, ঈশ্বর দেখেও কেন দেখছেন না, নাকি ভক্ত সমাগমে, পুজোর উপচারের আড়ালে, নববর্ষের আড়ম্বরে ব্যাপারটার কোনও গুরুত্বই নেই? আবার দেখলাম লোকটাকে। বিরক্ত মুখ, ছবিটা পছন্দসই হয়নি। চোঙা-লেন্স খুলে চাঁদা লাগানো বেঁটে লেন্স লাগাচ্ছে। বাঘের মতো চোখের দৃষ্টি নিয়ে এগোচ্ছে নোংরা জলের দিকে। সেখানে গায়ে সুতোটি নেই একটা বাচ্চা মেয়ে অশ্রাব্য গালাগালি দিচ্ছে চার পাশের ছেলেগুলোকে। তারাও কুচ্ছিত অঙ্গভঙ্গি করছে। এক জন লোক এসে একটা সবুজ বোতল ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘যা, মাঝখান থেকে ভাল জল নিয়ে আয়।’ তিনটে ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। জলভরা বোতল ফেরত নিয়ে পয়সা দিয়ে চলে গেল লোকটা। ফোটোগ্রাফার মেয়েটাকে ডাকল এ বারে। বলল কী সব। মেয়েটা মাথা নাড়ল। চড়া গলা শোনা গেল, ‘দাঁড়াবি না মানে, তোর মা দাঁড়াবে!’ রেগে যাচ্ছে কোমর জলে দাঁড়ানো ন্যাংটো মেয়েটা। ছেলেগুলোর মহা মজা। এক জন বলল, ‘ওকে কালী সাজতে বলেছে, জিভ বার করে হাত তুলে দাঁড়াতে বলেছে, পয়সা দেবে না— অ্যাই লক্ষ্মী, দাঁড়াবি না বলে দিলাম।’ শুনেই ফোটোগ্রাফার ঘুরে গেল ছেলেটার দিকে, ঘুরেই এক থাপ্পড়। ছেলেটা পড়ে গেল ঘাটের ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে গা ঘিনঘিন করা জলের মধ্যে জোয়ার উঠল ভয়ংকর শব্দের। ছোটদের গলা এত কর্কশ হতে পারে জানা ছিল না। পয়সা তোলা ছেড়ে সবাই সাঁতরে চলে এল কাছে। তার পর একসঙ্গে হাতের তেলো দিয়ে নোংরা জল ছুড়তে লাগল ঘাটের দিকে। সরে যাওয়ার কোনও সুযোগ পেল না ফোটোগ্রাফার। তার জঙ্গি ফ্যাশনের জ্যাকেট ভিজে একশা। ক্যামেরা, লেন্স থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। ঘাটের দিকে দৌড়ে এল অনেকে। চিৎকার, চেঁচামেচি। কোনও রকমে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল ওকে। কিন্তু তত ক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। ক্যামেরাটা শেষ।

আলগোছে দু’একটা মন্তব্য করল কিছু লোক। বাচ্চাদেরও বকাঝকা করা হল। কিন্তু ওরা তত ক্ষণে আবার ফিরে গেছে জলে, হাতের সুতো ঘুরিয়ে ম্যাগনেট ফেলে পয়সা তোলা শুরু করে দিয়েছে। মাঝনদীতে ভেসে যাওয়া কচুরিপানা, ফেলে দেওয়া ফুল পাতার মধ্যেই চলছে বিজয়োৎসব। ঘাট থেকে উড়ে আসা কঠিন উপদেশগুলোর অকালমৃত্যু হচ্ছে আদিগঙ্গায়।

যাদের সঙ্গে এসেছিলাম তাদের আর দেখতে পেলাম না। ওপরে উঠে এলাম। হলুদ পেঁড়া বিক্রি হচ্ছে দোকানে। কিনলাম ছোট এক চ্যাঙারি। ঠাকুরকে নৈবেদ্য দিয়ে কী-ই বা হবে! হাঁটতে লাগলাম মন্দিরের দিকে। মুখে পুরতে লাগলাম পেঁড়াগুলো, একটার পর একটা।

ছবি: লেখক।

suvolama@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

subhamoy maitra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE