গবেষকদল। দীপায়ন বৈরাগী (বাঁ দিক থেকে), নিবেদিতা নন্দী, অরিন্দম বন্দোপাধ্যায়, বিপ্লব মণ্ডল এবং বিশ্বনাথ হাঁসদা।
শিল্পবর্জ্য মেশা নদী বা পুকুরের জলে যারা থাকে মাত্রাতিরিক্ত ভাবে। যাদের জন্য পানীয় ও অন্যান্য কাজকর্মে ব্যবহৃত জল উত্তরোত্তর বিপজ্জনক হয়ে উঠছে আমাদের পক্ষে। তা হয়ে উঠছে ব্যবহারের অযোগ্যও।
জলের সেই সব শত্রু
শিল্পবর্জ্য এসে মেশা নদী বা পুকুরের জলে থাকে নানা ধরনের বিষাক্ত রং। যেগুলি অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ, ওই সব রং সাধারণত জলে বা পরিবেশে অনেক দিন থাকার পরেও অন্য কোনও পদার্থে রূপান্তরিত হয় না চট করে। ফলে খুব অল্প পরিমাণে থাকলেও তাদের থেকে আমাদের ও অন্যান্য জীবের বিপদের আশঙ্কা থেকেই যায়।
শিল্পবর্জ্য মেশা জলে প্রচুর পরিমাণে থাকে অত্যন্ত বিষাক্ত সিসা ও ক্যাডমিয়াম ধাতুর আয়ন। এই ধাতব আয়নগুলি আসে মূলত ব্যাটারি, ত়ড়িৎদ্বার (‘ইলেক্ট্রোপ্লেট’) এবং রং-এর শিল্পক্ষেত্র থেকে। পানীয় বা অন্যান্য কাজে ব্যবহারের ফলে জল থেকে ওই ধাতব আয়নগুলি আমাদের শরীরে ঢোকে, পরিবেশে মেশে। আর সেগুলি দীর্ঘ দিন থেকেও যায় অবিকৃত ভাবে।
ক্যাডমিয়াম আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জমে। ফলে তা বেশ প্রভাব ফেলে খাদ্যশৃঙ্খলের উপর।
আর সিসার আয়ন আমাদের শরীরে খুব অল্প পরিমাণেও যদি ঢোকে তা হলেও তা আমাদের স্নায়ু, অন্ত্র, দেহের স্বাভাবিক প্রতিরোধী ব্যবস্থা ও কার্ডিওভাসক্যুলার সিস্টেমের দারুণ ক্ষতি করতে পারে। হাড়ে, মস্তিষ্কে, কিডনি ও মাংসপেশিতে সিসা জমার দরুন নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা, রোগ হতে পারে। এমনকী মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে।
আরও পড়ুন- হকিং, পেনরোজ কি উদ্ভাসিত অমল আলোয়? কী বলছে ইতিহাস
তাই শিল্পবর্জ্য মেশা জল থেকে কত তাড়াতাড়ি ও কত বেশি পরিমাণে নানা ধরনের বিষাক্ত রং ও ধাতব আয়নগুলি দূর করে সেই জলকে বিষমুক্ত করা যায় তা নিয়ে এখন গোটা বিশ্বজুড়েই চলছে গবেষণা।
শত্রু হঠানোর চালু পদ্ধতিগুলি
সেই গবেষণায় যে পদ্ধতিগুলির এখন ব্যবহার চলছে সবচেয়ে বেশি তাদের মধ্যে অন্যতম মেমব্রেন সেপারেশন, ফ্লক্যুলেশন, আয়ন এক্সচেঞ্জ এবং ইলেক্ট্রো-কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট। যদিও পদ্ধতিগত জটিলতা, তাদের সাফল্য ও খরচের নিরিখে ওই সব পদ্ধতিরই বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
নতুন অণুর অভিনবত্ব
‘অ্যাডজরপশন’ পদ্ধতির সেই সীমাবদ্ধতাগুলি অনেক কম। অ্যাডজরপশন বা শোষণ এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে জলে দ্রবীভূত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থকে শোষণ করা সম্ভব হয়। আর সেটা করা সম্ভব হয় বহুরন্ধ্রবিশিষ্ট (‘পোরাস’) পদার্থের ভিতরের অনুকূল রাসায়নিক পরিবেশকে ব্যবহার করে।
এই গবেষণায় আবিষ্কৃত অণুটি দিয়ে তৈরি হাইড্রোজেলটিকে খুব কম চাপে ও খুব কম তাপমাত্রায় (-৭৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস) জলমুক্ত করে তাকে একটি বহুরন্ধ্র পদার্থে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
এই পদার্থের ট্যাবলেট জৈব রাসায়নিক রং মিশে থাকা জলের মধ্যে ফেলে দিলে তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জল থেকে রং শুষে নিয়ে জলকে পরিশুদ্ধ ও রঞ্জকহীন করে তুলতে পারে।
অরিন্দমদের কৃতিত্ব, তাঁরা এই প্রথম এমন একটি অণুর আবিষ্কার করেছেন যা একই সঙ্গে জলে গুলে যায় আবার পুরোপুরি গুলে যায়ও না। সেই অণুটি তেলেও গুলে যায় আবার তেলেও পুরোপুরি গুলে যায় না।
যারা কোনও দিনই একে অন্যের সঙ্গে মিশ খায় না বলে আমরা জানি, সেই জল আর তেলকে কার্যত ‘একই ঘাটে জল খাইয়েছেন’ অরিন্দমরা, তাঁদের সদ্য আবিষ্কৃত অণুটির দৌলতে। এই অণু জলের সঙ্গে যে আচরণ করে সেই আচরণই করে তেলের সঙ্গেও।
তার ফলে জলে পুরোপুরি মিশে যায় এমন সব বিষ (ধাতব ও নানা ধরনের জৈব রাসায়নিক রং) যেমন শুষে নিতে পারে অরিন্দমদের আবিষ্কৃত অণু, তেমনই জলে মেশে না এমন তেলজাতীয় পদার্থের গরলও তা টেনে নিতে পারে শিল্পবর্জ্যে ভরা জল থেকে। এটাই তাঁদের গবেষণার অভিনবত্ব।
আরও পড়ুন- এ বারের নোবেলজয়ী গবেষণার অন্তরালে এই বাঙালিও
‘‘একই সঙ্গে শিল্পবর্জ্য মেশা জলের তিন প্রধান শত্রুকে একই অস্ত্রে ঘায়েল করার ক্ষমতা রাখে এমন অণু এর আগে বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে বলে আমাদের জানা নেই’’, বলছেন অরিন্দম।
এর ব্যবহারে আমাদের ক্ষতি হবে না তো?
তাঁদের গবেষণায় যার হদিশ মিলেছে সেটি আসলে একটি পেপটাইডের অণু। যা অনেকগুলি অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে তৈরি। অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়েই তৈরি হয় নানা ধরনের প্রোটিন। অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলিই বিভিন্ন প্রোটিন তৈরির ‘ইট-বালি-চুন-সুড়কি’। আর আমাদের জীবনটাই বিভিন্ন রকমের প্রোটিনের উপর নির্ভরশীল।
‘‘তাই শিল্পবর্জ্য মেশা জলকে দূষণের কলুষমুক্ত করতে এই ধরনের পেপটাইড অণুর ব্যবহার আমাদের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে উঠবে না’’, বলছেন অরিন্দম।
কী দেখেছেন গবেষকরা?
গবেষকরা দেখেছেন বস্ত্রশিল্পে খুব ব্যবহৃত হয় এমন জৈব রাসায়নিক রং মিথিলিন ব্লু (এমবি) এবং চুলের রং করার কাজে ব্যবহৃত বিসমার্ক ব্রাউন (বিবি)-এর মতো জৈব রাসায়নিক রং শুষে নিতে পারে তাঁদের আবিষ্কৃত পেপটাইড অণুটি। এ ছাড়াও চর্মশিল্প ও বস্ত্রশিল্পে ব্যবহৃত বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক রংও পুরোপুরি শুষে নিতে পারে পেপটাইড অণুটি। এমনকী নানা রকমের জৈব রাসায়নিক রঙের মিশ্রণকেও তা শুষে নিতে পারে। একই সঙ্গে পারে সিসা ও ক্যা়ডমিয়ামের মতো অত্যন্ত বিষাক্ত ধাতব আয়নগুলিকেও জল থেকে টেনে বের করে নিতে।