Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Nobel Prize

Nobel Prize In Chemistry 2021: প্রকৃতির কাছ থেকে পাঠ নিয়ে ওষুধ তৈরির নতুন উপায় দেখানোর জন্য রসায়নে নোবেল দু’জনের

বুধবার এই পুরস্কারজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে নোবেল কমিটি।

রসায়নশাস্ত্রে দুই নোবলজয়ী। অধ্যাপক বেঞ্জামিন লিস্ট ও অধ্যাপক ডেভিড ম্যাকমিলান। ছবি সৌজন্যে- ‘দ্য রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’।

রসায়নশাস্ত্রে দুই নোবলজয়ী। অধ্যাপক বেঞ্জামিন লিস্ট ও অধ্যাপক ডেভিড ম্যাকমিলান। ছবি সৌজন্যে- ‘দ্য রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২১ ১৮:৪৭
Share: Save:

শেখাতে পড়াতে হয় না। যে কাজটা প্রকৃতি অনবরতই করে চলে নিজের খেয়ালে, অনায়াসে, সেই কঠিনতম কাজটা যে মানুষও করতে পারে সহজেই, তারই পথ দেখিয়ে এ বার রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পেলেন দু’জন। অধ্যাপক বেঞ্জামিন লিস্ট ও অধ্যাপক ডেভিড ম্যাকমিলান।

এই দু’জনের দেখানো পথই নতুন শতাব্দীতে পা পড়ার পর থেকে অত্যন্ত কার্যকরী নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কারের দরজাটা হাট করে খুলে দিয়েছে সভ্যতার সামনে। তারই স্বীকৃতিতে জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর কোহলেনফরশুং-এর অধিকর্তা অধ্যাপক লিস্ট ও আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাকমিলানকে পুরস্কৃত করার কথা বুধবার নোবেল কমিটি ঘোষণা করেছে। জানিয়েছে, ১ কোটি সুইডিশ ক্রোনার অর্থমূল্যের পুরস্কার এ বার লিস্ট ও ম্যাকমিলানের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।

অন্য পথ খুঁজছিলেন দু’জনেই

দু’জনেই এমন পথ খুঁজেছিলেন যাতে নির্ঝঞ্ঝাটে, যেমনটি চাইছি ঠিক সেই ভাবেই দু'টি জৈব অণুর মধ্যে জোড় বাঁধিয়ে কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়াকে নিজেদের ইচ্ছেমতো গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। যাতে চাইলে সেই বিক্রিয়ার গতি বাড়বে। না চাইলে কমানোও যাবে ইচ্ছে মতোই। যে কাজটা প্রকৃতি করে চলে অনায়াসে, অনবরত মানবশরীরে। মানবশরীরকে বলে দিতে হয় না, শেখাতে পড়াতে হয় না, কখন কোন প্রোটিন বা উৎসেচক প্রয়োজন হবে জীবন-রথের চাকাকে তরতরিয়ে গড়িয়ে নিয়ে যেতে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, এই কাজটাই যদি আমরা করতে পারি তা হলে তো জীবনদায়ী-সহ যে কোনও ওষুধ তৈরির কাজটা অনেক সহজ হয়ে যেতে পারে। যা চাইছি যেমন চাইছি যে গতিতে চাইছি, সেই ভাবে ওষুধ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলিকে ঠিক সেই ভাবে তো ঘটতে দেয় না বাতাসের আর্দ্রতা (জলের উপস্থিতি) আর অক্সিজেনই।

অনুঘটক: প্রকৃতি, মানবশরীর

অথচ, প্রকৃতি গোড়া থেকেই এই সব লক্ষ লক্ষ ‘হাতিয়ার’ তৈরি করে রেখেছে মানবশরীরে। যাদের কাজকর্মের গতি বাতাসের আর্দ্রতা আর অক্সিজেন কমাতে-বাড়াতে পারে না। এরা অনায়াসেই নিজের নিজের খেয়ালে কখনও কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি বাড়িয়ে আমাদের জীবনের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে। কখনও বা গতি কমিয়ে। এদের আমরা বলি অনুঘটক (‘ক্যাটালিস্ট’)। আর তাদের সেই কাজকর্মের প্রক্রিয়াটার নাম অনুঘটন প্রক্রিয়া (‘ক্যাটালিলিস’)।

শুধুই শরীরে নয়, আমাদের রোজকার জীবনযাত্রাতেও এমন নানা ধরনের অনুঘটকের প্রয়োজন হয়। দিনগুলিয়ে চালিয়ে নিয়ে যেতে। রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি বাড়ানো আর কমানোর নিরিখে যথাক্রমে দু’ধরনের অনুঘটক হয়। ধনাত্মক অনুঘটক (‘পজিটি‌ভ ক্যাটালিস্ট’) আর ঋণাত্মক অনুঘটক (‘নেগেটি‌ভ ক্যাটালিস্ট’)। মাথায় রাখা জরুরি, গোটা বি‌শ্বের মোট গৃহজ উৎপাদন (জিডিপি)-এর ৩৫ শতাংশই নির্ভর করে রাসায়নিক অনুঘটন প্রক্রিয়ার উপর। যেহেতু তাদের উপরেই নির্ভরশীল ওষুধ-সহ যাবতীয় শিল্পপণ্যের উৎপাদন।

ধারণায় কোথায় ঘা মেরেছিলেন লিস্ট ও ম্যাকমিলান?

লিস্ট ও ম্যাকমিলান- দু’জনেই অনুঘটক আর অনুঘটন প্রক্রিয়া সম্পর্কে কয়েক শতাব্দীর প্রচলিত ধারণায় সজোরে ধাক্কা মেরেছিলেন। জানিয়েছিলেন, গত শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত আমাদের যা ধ্যানধারণা ছিল, সেই ধাতু আর মানবশরীরের লক্ষ লক্ষ উৎসেচক (‘এনজাইম’) ছাড়াও অন্য অনুঘটকের অস্তিত্ব সম্ভব। যা মানবশরীরের লক্ষ লক্ষ উৎসেচকের প্রায় সমান দক্ষতায় কাজ করতে পারে। বিক্রিয়ার গতি আমরা যেমন চাইছি, সেই মতো কমিয়ে-বাড়িয়ে প্রয়োজন মাফিক ঠিক সেই সেই জৈব অণু তৈরি করতে পারে। তাতে কাঙ্ক্ষিত জৈব অণুকে পাওয়ার জন্য রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলির ধাপের সংখ্যাও কমানো যায়। বিক্রিয়াগুলির ধাপ কমে বলে সে ক্ষেত্রে মাঝের ধাপগুলির অপ্রয়োজনীয় জৈব অণুগুলি তৈরি হতেই পারে না। যার পরিণতিতে কাঙ্ক্ষিত জৈব অণুর পরিমাণ বাড়ে। ওষুধ আবিষ্কার ও তৈরি করে যারা তাদের জন্য যা খুবই জরুরি। তাতে তাদের খরচ বাঁচে। পরিবেশের পক্ষে বিপজ্জনক উপজাতও তৈরি হয় না বলে বাঁচে পরিবেশও। ওষুধও হয় খুব নিখুঁত। আরও বেশি কার্যকরী।

ধাতব অনুঘটক ও অরগ্যানোক্যাটালিসিস

২০০০ সালে আলাদা আলাদা ভাবে করা দু’টি গবেষণায় নতুন শ্রেণির সেই অনুঘটকেরই খোঁজ দিয়েছিলেন লিস্ট ও ম্যাকমিলান। যা আমাদের পরিচিত ধাতব অনুঘটক নয় পুরোদস্তুর। আবার মানবশরীরের লক্ষ লক্ষ উৎসেচকের মতো অনুঘটকও নয়। এই নতুন শ্রেণির অনুঘটকের নামটা প্রথম দিয়েছিলেন অধ্যাপক ডেভিড ম্যাকমিলান। ‘অরগ্যানোক্যাটালিস্ট্‌স’। প্রক্রিয়াটার নাম- ‘অরগ্যানোক্যাটালিসিস’।

এই নতুন শ্রেণির অনুঘটকরা আদতে জৈব অণু। চার হাতের (‘ভ্যালেন্সি’) কার্বন পরমাণুর জৈব যৌগ। যার শৃঙ্খলগুলি খুব দীর্ঘ। তাদের কোনও হাতে ধরা থাকতে পারে অক্সিজেন পরমাণু, কোনও হাতে হাইড্রোজেন বা কোনও হাতে নাইট্রোজেন পরমাণু। এই সব পরমাণুই যেহেতু খুব সহজলভ্য তাই নতুন নতুন ওষুধ তৈরির জন্য রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলিকে নিজেদের ইচ্ছেমতো এগিয়ে নিয়ে যেতে অসুবিধা হয় না ওষুধ সংস্থাগুলির।

আবার ধাতব অনুঘটক ব্যবহারের বিস্তর হ্যাপাও সামলাতে হয় না তাদের। যেহেতু ধাতু বাতাসের আর্দ্রতা আর অক্সিজেন পেলেই অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তুতে পরিণত হতে পারে। তা ছাড়াও বেশির ভাগ ধাতব অনুঘটকই তৈরি হয় ভারী ধাতু দিয়ে। যা পরিবেশের পক্ষে বিপজ্জনক।

প্রকৃতির দেখানো পথ ধরেই নতুন পথের ঠিকানা

এই নতুন জৈব অনুঘটক বানাতে প্রকৃতির নিয়মকেই অনুসরণ করেছিলেন লিস্ট ও ম্যাকমিলান। অনেক জৈব অণুই আমাদের দু’টি হাতের মতো একে অন্যের প্রতিবিম্ব (‘মিরর ইমেজ’)। কিন্তু রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ধাপে ধাপে যখন এই সব প্রতিবিম্বের মতো জৈব অণুগুলি তৈরি হয় তখন তাদের মধ্যে কেউ যেমন উপকারী হয় অন্যটি তেমনই হয়ে উঠতে পারে বিপজ্জনক, অপকারী। কিন্তু ধাতব অনুঘটকগুলি জৈব অণুদের প্রতিবিম্বগুলিকে চিনতে পারে না আলাদা ভাবে। দু’টি প্রতিবিম্বকেই সামনের দিকে এগিয়ে দেয় রাসায়নিক বিক্রিয়ার পরের ধাপে। ফলে, পরের ধাপে গিয়ে ওষুধ প্রস্তুতকারকরা জৈব অণুর অপকারী প্রতিবিম্বটিকেও পায়। তা বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া যেমন জটিল, তেমনই তা সম্পূর্ণ নির্ভুলও নয়। তাই তা খুব কার্যকরী ওষুধ তৈরির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এটা কিন্তু মানবশরীরে হয় না। প্রকৃতিই হতে দেয় না।

লিস্ট ও ম্যাকমিলামের উদ্ভাবিত অরগ্যানোক্যাটালিসিস পদ্ধতিতে জৈব অণুর দু'টি প্রতিবিম্বের মধ্যে শত্রু আর মিত্রকে চিনে ফেলা সম্ভব হয় অনেক আগেভাগেই। মানবশরীর যে ভাবে করে ঠিক সেই ভাবেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nobel Prize
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE