করোনার চৌন্বক ক্ষেত্রের মানচিত্র।
বিদ্যাবিনয়ের কথায়, ‘‘আমরা ফোটোস্ফিয়ার থেকে ৩৫ হাজার কিলোমিটার উপরে থাকা করোনার চৌম্বক ক্ষেত্রগুলিকে দেখা শুরু করি। সেটা চালিয়ে গিয়েছি ফোটোস্ফিয়ার থেকে আড়াই লক্ষ কিলোমিটার উপরে থাকা করোনার চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি পর্যন্ত। যেগুলি অত্যন্ত ক্ষীণ বললেও কমই বলা হয়। সূর্য আদতে একটা গোলক (‘স্ফেরিক্যাল’)। আমরা সেই গোলকের ওই পরিমাণ এলাকায় অত্যন্ত ক্ষীণ চৌম্বক ক্ষেত্রগুলির হদিশ পেয়েছি। তাই আমরা এটাকে গ্লোবাল বলছি। যা এর আগে সূর্যের বায়ুমণ্ডলের এতটা বিশাল এলাকা জুড়ে করা সম্ভব হয়নি।’’
যে পথে এগিয়েছিলেন গবেষকরা...
এই মানচিত্র বানাতে গিয়ে তাঁরা ঠিক কোন পথ ধরে এগিয়েছেন, তা ব্যাখ্যা করলেন অন্যতম গবেষক তন্ময় সামন্ত। জানালেন, পৃথিবী থেকে সূর্যের করোনা দেখে তার বৈশিষ্ট্যগুলি বোঝার জন্য একটি বিশেষ প্রকৌশলের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। যার নাম- ‘করোনাল সিস্মোলজি’ বা ‘ম্যাগনেটোসিস্মোলজি’।
আমরা জানি, বিভিন্ন মাধ্যমে শব্দের গতিবেগ হয় বিভিন্ন রকমের। বাতাসে শব্দ যে গতিবেগে ছোটে, জলে সেই গতিবেগে ছোটে না। আবার ধাতুর মধ্যে দিয়ে গেলে শব্দের গতিবেগ আলাদা হয়। এর অর্থ, মাধ্যমের ঘনত্ব ও তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে শব্দের তরঙ্গ-ধর্ম বদলায়। ফলে, সেই তরঙ্গগুলিকে দেখে সেগুলি কোন মাধ্যম দিয়ে ছড়াচ্ছে, তা বোঝা যায়।
আরও পড়ুন- সূর্যের করোনায় এই প্রথম হদিশ ‘ক্যাম্পফায়ার’-এর
আরও পড়ুন- নিজের ছোড়া ‘বাণ’ থেকে আমাদের বাঁচায় সূর্যই! দেখালেন মেদিনীপুরের সঞ্চিতা
তন্ময় বলছেন, ‘‘একই ভাবে সূর্যের করোনার বিভিন্ন স্তরের তরঙ্গগুলির ধর্মও আলাদা আলাদা হয়। এদের পোশাকি নাম- ‘ম্যাগনেটোহাইড্রোডায়নামিক ওয়েভ্স’। এরা নানা ধর্মের হয়। তাদেরই অন্যতম- ‘ট্রান্সভার্স ম্যাগনেটোহাইড্রোডায়নামিক ওয়েভ’। বা ‘ট্রান্সভার্স এমএইচডি’। আমরা এই ট্রান্সভার্স এমএইচডি নিয়েই কাজ করেছি।’’
এ এক অভূতপূর্ব ফলাফল: অধ্যাপক দীপঙ্কর বন্দোপাধ্যায়
নৈনিতালের ‘আর্যভট্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব অবজারভেশনাল সায়েন্সেস (এরিস)’-এর অধিকর্তা দীপঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘করোনাগ্রাফ দিয়ে গবেষকরা প্রথমে বর্ণালী বিশ্লেষণ করে এই ট্রান্সভার্স এমএইচডি-গুলিরই ঘনত্ব মেপেছিলেন। তার পর তাঁরা চৌম্বক ক্ষেত্রের ভিতরের চৌম্বক রেখাগুলির উপর সেই তরঙ্গের বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যবহার করেছিলেন চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তি বুঝতে। এই সবের মাধ্যমেই গবেষকরা এই মানচিত্রটি বানিয়েছেন। এটা অভূতপূর্ব ফলাফল।’’
সূর্যকে বোঝার নতুন পথ দেখাল এই গবেষণা: অধ্যাপক দিব্যেন্দু নন্দী
‘‘এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটা কাজ’’, বলছেন মোহনপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার কলকাতা)’-এর অধ্যাপক বিশিষ্ট সৌরপদার্থবিজ্ঞানী দিব্যেন্দু নন্দীও। তাঁর কথায়, ‘‘সূর্যের বায়ুমণ্ডলের বাইরের দিকটায় (‘আউটার অ্যাটমস্ফিয়ার’) থাকা অত্যন্ত ক্ষীণ চৌম্বক ক্ষেত্রগুলিকে বোঝার একটা নতুন পথ দেখাল এই গবেষণা। সূর্যের করোনার এর চেয়ে বেশি গ্লোবাল মানচিত্র বানানো মুশকিল। কারণ, পৃথিবী থেকে করোনাগ্রাফ দিয়ে সূর্যের করোনার শুধু প্রান্তটিকে দেখা যায়। তাই এটাকে আমি আক্ষরিক অর্থে সূর্যের করোনার চৌম্বক ক্ষেত্রের গ্লোবাল মানচিত্র বলে মেনে নিতে রাজি নই। তবে এটা খুবই আনন্দের, এই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে দুই বাঙালি বিজ্ঞানীর।’’
সূর্যের বর্ণপরিচয়েও বাঙালিরই নাম!
ক্ষেতের ফসলের কথা ভেবে যাঁদের বছরভর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, সেই কৃষক পরিবারেরই দুই সন্তানের বড় ভূমিকা থেকে গেল অনেক আগেভাগে সূর্যের গোপন ‘অভিসন্ধি’গুলি জেনে ফেলার উপায় বাতলানোয়। যা আগামী দিনে বড়সড় বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে পারে সভ্যতাকে।
সূর্য-পরিচয়ের সেই নতুন ‘বর্ণপরিচয়’-এও লেখা থাকল বাঙালিরই নাম। বিদ্যাবিনয় ও তন্ময়ের।
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ ও তিয়াসা দাস।