রাত দেড়টা। স্কুলের লোহার দরজায় ঠক ঠক শব্দ। শব্দ আসছে মিড ডে মিলের স্টোর রুমের জানালা থেকেও। প্রথমে আস্তে। পরে বেশ জোরে। সেই শব্দে শুক্রবার রাতে ঘুম ভেঙে গেল বিষ্ণুপুরের গোঁসাইপুর রত্নেশ্বর হাইস্কুলের লাগোয়া হস্টেলের ছাত্রদের। প্রথমে তারা ভেবেছিল, স্কুলে হয়ত ডাকাত পড়েছে। দুরু দুরু বুকে কয়েকজন হাঁক দেয়— কে? উত্তর নেই।
অথচ শব্দ বাড়ছে। ঠুক ঠুক থেকে হঠাৎ দড়াম শব্দে ভেঙে পড়ল স্টোর রুমের একটা জানালা। এ বার সে দিকে টর্চের আলো ফেলতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে কয়েকজন ছাত্রের। শিউরে বলে ওঠে, ‘‘ওগুলো কি! কালো কালো হাতি তো!’’
আর ঘরে বসে থাকতে পারেনি ছাত্রেরা। হস্টেলের বিছানা ছেড়ে ১৫ জন ছাত্রই দৌড় লাগায় ছাদের সিঁড়ির দিকে। প্রাণে বাঁচতে হবে তো! ছাদে উঠে তারা দেখে স্কুল প্রায় ঘেরাও। চারপাশে বেশ কয়েকটা হাতি। চলছে গেট ভাঙার চেষ্টা। আর স্টোর রুমের জানালা ভেঙে দু’টি হাতি ততক্ষণে দিব্যি টেনে বের করে ফেলেছে চালের বস্তা। এই দেখে ছাদ থেকেই তারা— ‘‘বাঁচাও গো। হাতিগুলো মেরে ফেলবে আমাদের।’’ বলে চিৎকার জুড়ে দেয়। ছুটে আসেন গ্রামবাসী। তাঁরাও আগুন জ্বালিয়ে হল্লা শুরু করেন। হাতির দল ঢোকার খবর পেয়ে চলে আসেন বনকর্মীরাও। হাতিরা গুটি গুটি ফিরে যায়। ছাত্রেরা হাঁফ ছাড়লেও সে রাতে আর চোখ এক করতে পারেনি কেউ।
শুক্রবার রাতে বাঁকুড়ার জয়পুর রেঞ্জ এলাকার গোঁসাইপুর রত্নেশ্বর হাইস্কুলের ঘটনা। শনিবার সকালেই খবর পেয়ে স্কুলে ছুটে আসেন শিক্ষক বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়, হস্টেল সুপার বুদ্ধদেব রায়। তাঁরা দেখেন লোহার মেন গেট ভাঙা। বাকি তিনটি গেট তোবড়ানো। স্টোর রুমের জানালা ভাঙা। শুঁড় ঢুকিয়ে বের করা হয়েছে চালের বস্তা। হস্টেলে ছাত্রদের মুখে সব শুনে তাঁরা হতবাক।
হস্টেলের দশম শ্রেণির দুই ছাত্র অজয় লোহার ও সপ্তম শ্রেণির শান্তনু বাউরি ঘটনার বর্ণনা দিতে দিচ্ছিল। তাদের কথায়, “আমরা আধো অন্ধকারের মধ্যেও গুনে গুনে দেখেছি, স্কুলের চারপাশে ন’টা হাতি এসেছিল। এতোগুলি হাতি দেখে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম সবাই। হস্টেল ছেড়ে স্কুলের ছাদে উঠে যাই। আমরা চেঁচামেচি করতেই লোক জড়ো হতে থাকে। বনকর্মীরাও আসেন। বহু চেষ্টায় সবাই হাতিগুলোকে তাড়ায়।’’
আশপাশের মোবারকপুর, বাসানিপাড়া, ডাঙাপাড়া, ভগড়া গ্রাম থেকেও হাতি তাড়াতে ছুটে আসেন বাসিন্দারা। মোবারকপুর গ্রামের আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এই হাতির দলটি খুবই মারকুটে। তাড়াতে গেলে আমাদের দিকেই তেড়ে আসছিল। কপাল ভাল থাকায় বনকর্মীরাও তখন এলাকায় চলে এসেছিলেন। অনেক কষ্টে হাতিগুলোতে স্কুল চত্বর থেকে জঙ্গলে পাঠানো গিয়েছে।’’ স্কুলের প্রধান শিক্ষক আশিসকুমার নন্দী বলেন, “স্কুলের জানালা ভেঙে মিড-ডে মিলের চালের বস্তা খুলে প্রায় ৮০ কেজি চাল খেয়ে নিয়েছে হাতিগুলি। মোট চারটি লোহার গেট ভেঙে দিয়েছে ওরা। তবে হস্টেলের ছেলেদের কোনও ক্ষতি করেনি এটাই রক্ষার। ওরা সবাই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল।’’
গ্রামবাসী জানান, দিন কয়েক আগে স্থানীয় তাঁতিপুকুর গ্রামে একটি চালের দোকানে পর পর দু’দিন হানা দেয় দু’টি দাঁতাল। একটি শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের দরজা-জানালাও ভাঙে। এ বার ন’টি হাতির দলের হামলা হল। সব মিলিয়ে তাঁরা আতঙ্কে রয়েছেন। তাঁরা দাবি করেছেন, বন দফতর হাতিগুলিতে অন্যত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করুক।
জয়পুর রেঞ্জের আধিকারিক মনোজ যশ শনিবার বলেন, “ময়ুরঝর্নার ন’টি হাতির ওই দলটি শুক্রবার রাতেই পশ্চিম মেদিনীপুর ছেড়ে বাঁকুড়ার বাঁকাদহ রেঞ্জ হয়ে জয়পুরে ঢুকেছে। ওরা দ্বারকেশ্বর নদ পার হতে না পারায় লাগোয়া গোঁসাইপুর গ্রামের ওই হাইস্কুলে চালের গন্ধ পেয়ে হামলা চালায়। আমরা সঙ্গে সঙ্গে খবর পেয়ে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় গভীর জঙ্গলে ওদের ঢুকিয়ে দিয়েছি।” তিনি জানান, এলাকায় থাকা দু’টি রেসিডেন্ট হাতি ওদের ভয়ে অন্যত্র সরে গিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত স্কুলটির ক্ষতিপূরণের বিষয়েও তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘ওই ন’টি হাতির গতিবিধির দিকে বনকর্মীরা নজর রাখছেন। প্রয়োজনে বাসুদেবপুরে রাখা দু’টি কুনকি হাতি নামিয়ে ওদের সরানো হবে।’’