Advertisement
E-Paper

কুমোরটুলির মানবজমিনে প্রতিমার প্রাণপ্রতিষ্ঠায় মগ্ন চায়না

প্রতিমা তৈরির দক্ষ কারিগর হিসেবে চায়না পাল ঘুরে এলেন চিনও! কেমন তাঁর জীবনযুদ্ধ?

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৯ ১৮:১২
Share
Save

একের পর এক মেয়ে।

চার নম্বরও যখন মেয়ে হল, বাবা-মা দুঃখ পেয়ে নাম রাখলেন ‘চায়না’।

মেয়ে তো, যা হোক নাম দিলেই হল!

বিধাতা অতি সদয় হলেন এই কনিষ্ঠ চায়নার উপর। সেই সদয়ের রকম এমন দাঁড়ালো যে প্রতিমা তৈরির দক্ষ কারিগর হিসেবে চায়না পাল ঘুরে এলেন চিনও!

ভেতরের চাপিয়ে দেওয়া দরজা খুলে যে মেয়ে কাদায়-খড়ে-জলমাখা মাটির গন্ধে বাবার পায়ে পায়ে ঘুরতো তাকে থামায় কার সাধ্যি?

আরও পড়ুন: ‘লোকে বলেছিল হাফ প্যান্ট পরিয়ে মেয়েদের শরীর দেখাতে শেখাচ্ছিস?’

‘‘বাবা মারা যেতেই আমি বাবার স্টুডিয়োতে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। আমি তো ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে আসতাম। মূর্তি তৈরি করতাম। বাবার সঙ্গে যে কাকারা কাজ করত ওরা বলত, তুই বাচ্চা, কী করবি? আমি ঠিক লেগে থাকতাম। আর শুধু মূর্তি গড়া নয়, যারা প্রতিমা কিনতে আসতো তাদের সঙ্গেও দিব্যি কথা বলতাম।’’

বাবা না চাইলেও চলে এলেন মূর্তি তৈরির কাজে। এলোমেলো চুল, সিন্থেটিক শাড়ি, কপালে পুজোর টিপ, চায়না পাল গল্প করতে বসলেন।

কুমোরটুলিতে তাঁর নাম বললে যে কেউ বাড়ি চিনিয়ে দেবে। সামনে স্টুডিয়ো আর তার গায়ে লাগোয়া সরু গলিতে চায়নার দু’কামরার বাড়ি। ‘‘আসলে বরানগরে ফ্ল্যাটটা বড়। ওটা কিনে পড়ে আছে। ওখানে আমি থাকতে পারবো না। ধুর! আমার এখানে তিনটে স্টুডিয়ো। বাড়ি। মা...’’

চায়ের জল চাপালেন চায়না। সর্ষে-রুই খুব পছন্দের খাবার তাঁর।

ঠাকুর তৈরির সময় মাছ খান?

‘‘দেখুন, আমাদের তেমন নিয়ম কিছু নেই। তবে স্টুডিয়োয় ও সব ঢোকাই না,’’ সপ্রতিভ চায়না।

আরও পড়ুন: সোনালি এখন এই পাড়ার রিকশা দিদিমণি...

ঝড়, আলগা বৃষ্টি আর মেঘের আলোয় ভিজে আছে কুমোরটুলির পাড়া। ভিজে হয়ে আসে চায়নার চোখ, ‘‘দিন রাত এক করে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছি। বাবার জায়গায় আমি এলাম। একটা মেয়ে। কুমোরটুলি তখন আমায় মেনে নেয়নি। আমি স্টুডিয়োর বাইরে মূর্তি রাখতাম। সবাই আপত্তি করল। কেউ কোনও একটা মূর্তির কিছু অংশ ইচ্ছে করে ভেঙে দিল। আমি কিছু বলিনি। শুধু কাজ করে গেছি। ঠাকুর আমায় বাঁচিয়ে রেখেছে।’’
হাল ছাড়েননি তিনি।

হাল ছাড়ার উপায়ও ছিল না। ‘‘প্রথম দিকে এমন হয়েছে, একটা শিখছি, আর একটা বাকি রয়ে যাচ্ছে। গয়না কী ভাবে পরাব, কোনটা আগে কোনটা পরে করব...বাবার আশীর্বাদ আর মা দুর্গার হাত ধরে কাজ শিখলাম।’’

চায়ের জল ফুটতে লাগলো।

কাজ শেখার পরে বাইরে থেকে ডাকও পেয়েছিলেন। যেমন লখনউ। প্রিয় কুমোরটুলিকে ছেড়ে যাননি চায়না।

‘‘ভাবলাম, তখন এই স্টুডিয়োটার কী হবে? এত লড়াই করে যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি, সেই জায়গাটা ছাড়তে মন চাইল না। নতুন জায়গায় গেলে আবার নতুন করে শুরু করতে হত।’’

এই ধৈর্য আর একাগ্রতা অবশেষে তাঁকে নিয়ে গেল চিনে।

বিস্ময় নামলো চায়নার চোখে।

‘‘চিনে গেলাম এক চালচিত্রের দুর্গা নিয়ে। পুরো দুর্গা প্রতিমাটিই ফোল্ডিং। সেটি কুনমিংয়ে প্রদর্শিত হয়েছিল। এ ছাড়াও আমি কালীমূর্তি এবং বিভিন্ন ধরনের ডাইস নিয়ে গিয়েছিলাম। কুনমিংয়ে আমি দেখিয়েছি, কী ভাবে একটি ডাইস ব্যবহার করে প্রথমে দুর্গা এবং পরে কালীর মুখ বানানো যায়।’’ কথাগুলো বলছিলেন এত সহজ ভাবে যেন এ কাজ সবাই পারে! চিনের যাদুঘরে তাঁর মূর্তি।

আরও পড়ুন: ছেলেদের শেখান, মেয়েদের অসম্মান করা যায় না

কুমোরটুলিতে কাজে ব্যস্ত চায়না।

কেমন লাগে আজ?

‘‘ও সব ভাবি না। আমার পঁচানব্বই বছরের মা আর আমি আর আমার স্টুডিয়ো, এই বেশ আছি। আমি সহজ জীবন চাই। শুধু মানুষের ভালবাসা চাই,’’ হাসলেন চায়না। রোজ সকালে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে প্রণাম সেরে এসে দিন শুরু হয় তাঁর।

বিয়ের কথা ভাবেননি?

মাথা নিচু করেন চায়না।

‘‘নাহ, বাবা চলে গেল, তার পর তো কাজ আর কাজ। তিন হাজার টাকা নিয়ে এই ব্যবসায়ে এলাম। এখন তিন লাখ টাকাও কিছু মনে হয় না।’’ রোদ্দুর হাসি ঠিকরে পড়ল চায়নার মুখে। মনের মতো মূর্তি গড়ার কাজেও একরোখা তিনি, ‘‘একটা কথা অবশ্যই বলতে চাই। সাবেকিয়ানার ঐতিহ্য পৃথিবীর কোনও দেশ অস্বীকার করতে পারে না। যতই থিমের পুজো আসুক, আমাদের বাপ-ঠাকুর্দার একচালার দুর্গাই হল প্রতিমা। আমি বেঁচে থাকতে কুমোরটুলির এই ঐতিহ্যকে নষ্ট হতে দেব না।’’

এ তো কেবল প্রতিমাশিল্পীর ব্যবসা নয়, এর মধ্যে মিশে আছে চায়নার আত্মা!

আরও পড়ুন: বিশ্বের ইতিহাসে কোথায় এগিয়ে কোন মেয়েরা, জানেন?

‘‘আগে প্রতিমা নিয়ে চলে গেলে কেঁদে ফেলতাম। এত দিন ধরে একটু একটু করে তৈরি করা রূপ! আর জানেন তো, এখানেই প্রতিমার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়। তাঁকে ছাড়তে মন কেমন হবে না? প্রতিমা সাজিয়ে দেন নিজের হাতে। চুল পরিয়ে। বেনারসী শাড়ি জড়িয়ে। হয়তো ডাকের সাজ। কালী আর দুর্গা তাঁর প্রিয়। ‘এই সাজাতে সাজাতেই মা জেগে ওঠেন।’’
চুপ করে থাকেন চায়না।

ভিন্নতার প্রতি বরাবর আকৃষ্ট তিনি। নিজের ‘অর্ধনারীশ্বর’ শিল্প সম্পর্কে বললেন, ‘‘আমি ২০১৫ সালে ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মানুষদের অনুরোধে এই প্রতিমা তৈরি করি। কিছু মানুষের ভাল লাগেনি, কিন্তু তাতে আমার কিছু এসে যায় না। আমার মনে হয় সকল মানুষের তাঁদের নিজের মতো করে ঈশ্বরকে পুজো করার অধিকার আছে। আমি আর কাউকে এ রকম মূর্তি বানাতে শুনিনি।”

নিজের দৃঢ় বিশ্বাস আর অস্তিত্বের মর্যাদা রাখতে কোনও মানুষ বা সমাজের মুখাপেক্ষী নন তিনি।

(ভিডিয়ো: অজয় রায়)

China Pal চায়না পাল Kumortuli কলকাতা International Womens' Day

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}