শিকারে নামার অপেক্ষায়। এসসিজি-তে মিচেল জনসন। ছবি: এএফপি
কপাল বটে মাইকেল ক্লার্কের! গ্রুপে দ্বিতীয় হওয়ার চূড়ান্ত যুদ্ধে নামার আগে যে ম্যাচে একটু মন দেবেন, উপায় নেই। প্রতিপক্ষ মোটেও আফগান সদৃশ আর দুগ্ধপোষ্য নয়, ঐতিহ্যশালী শ্রীলঙ্কা। চব্বিশ ঘণ্টাও বাকি নেই ম্যাচের, আর কোথা থেকে নতুন এক প্রতিপক্ষ এসে উপস্থিত!
ভদ্রলোক লঙ্কাদেশীয় কেউ নন। অস্ট্রেলীয় এবং ঠোঁটকাটা। ক্রিকেটটা খেলেছেন একটু-আধটু। লোকে চেনেও মোটামুটি।
ইনি— রিকি পন্টিং। অধিনায়ক হিসেবে দেশকে দু’বার বিশ্বকাপ দেওয়ার রেকর্ড যাঁর আছে এবং অস্ট্রেলিয়া-শ্রীলঙ্কা ম্যাচের চব্বিশ ঘণ্টা আগে যিনি প্রায় ধুয়ে দিলেন জাতীয় নির্বাচক কমিটি সহ অস্ট্রেলীয় টিম ম্যানেজমেন্টকে! শেন ওয়াটসনকে বাদ দিতে দেখে প্রবল খেপেছেন পন্টিং। সঙ্গে টিমকে শুনিয়েও রেখেছেন, আফগানিস্তান ম্যাচ দিয়ে নিজেদের বিচার করলে ডুববে। ওখানে ওয়াটসনকে বাদ দিয়েছ। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধেও সেটা করলে কিন্তু কপালে অশেষ দুঃখ অপেক্ষা করে আছে!
পন্টিং মনে করেন, নির্বাচকদের টেবলে ওয়াটসনের প্রমাণ করার আর কিছু নেই। সে সব পর্যায় পেরিয়ে এসেছেন তিনি বহু দিন। আর পান্টারের বিশেষত্ব হল ভাবেন যেটা, লেখেনও সেটা। অস্ট্রেলিয়ার এক সংবাদপত্রে নিজের কলামে খুল্লমখুল্লা যেমন লিখেছেন, ‘আমি তো ভেবেছিলাম আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে দু’টো ফাস্ট বোলার খেলাবে আর ওয়াটসনকে নেবে। দেখলাম উল্টো হল। ওয়াটসনকে বাদ দিয়ে দিল। পরিষ্কার বলছি, ওয়াটসন ছাড়া অস্ট্রেলীয় ব্যাটিং ঠুনকো। নড়বড়ে। আর এ সব অপশন নিয়ে ভাবার অবস্থা কিন্তু শ্রীলঙ্কা ম্যাচে থাকবে না।’ ওয়াটোর জায়গায় মিচেল মার্শকে আনতে দেখে আরও চটেছেন পন্টিং। লিখেছেন, ‘মিচেল মার্শ টিমকে যা দিতে পারবে, ওয়াটসন তার চেয়ে অনেক বেশি দিতে পারবে। লোকে বোঝে না ক্রিকেট নিয়ে ওয়াটো কতটা সিরিয়াস।’
দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেট অধিনায়কের কড়কানিতেই হোক বা অন্য কোনও কারণে, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে শেন ওয়াটসনকে টিমে ফেরাতে পারে অস্ট্রেলিয়া। ব্যাট হাতে চলতি বিশ্বকাপে খারাপ ফর্ম টিমকে থেকে যাঁকে হঠাৎই ছিটকে দিয়েছিল। গত আফগানিস্তান ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া রেকর্ড করলে কী হবে, একই সঙ্গে সে দেশে জাতীয় বিতর্কও বেধেছিল ওয়াটসনকে রাতারাতি ছেঁটে ফেলা নিয়ে। এক নির্বাচক আবার প্রকাশ্যে বলে দিয়েছিলেন যে, ওয়াটসনকে মোটেও বিশ্রাম দেওয়া হয়নি। বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাদ দেওয়ার চার দিনের মধ্যে আবার তাঁকে ফেরানোর ইঙ্গিত ভাসছে কেন? প্রথমত, সিডনির শুকনো উইকেট। যেখানে স্পিন ধরতে পারে। মনে করা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কা স্পিনারদের সামনে ওয়াটসনের অভিজ্ঞতা সেখানে কাজে দেবে। তা ছাড়া আফগানদের বিরুদ্ধে ওয়াটসনের বিকল্প হিসেবে যাঁকে নেওয়া হয়েছিল সেই মিচেল মার্শের পায়ে হালকা চোট আছে। তাই ওয়াটসন। মাইকেল ক্লার্ক সঙ্গে আবার ভেবে রাখছেন, সিডনি উইকেটে স্পিনার জেভিয়ার ডোহার্টিকে খেলানোর কথা।
ক্লার্ক শনিবার সিডনিতে কঠিন প্র্যাকটিসে ডুবে গিয়েছিলেন। কিন্তু অস্ট্রেলীয় অধিনায়কের চেয়েও হাড়ভাঙা খাটুনির রাস্তায় এ দিন যদি কেউ গিয়ে থাকেন, তিনি— ওয়াটসন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেটে পড়ে থাকলেন। সবার শেষে মাঠ ছাড়লেন। আসলে ক্লার্ক-ওয়াটো দু’জনের ক্রিকেট-রাজপথই যে গভীর খাদের দিকে বাঁক নিচ্ছে। ওয়াটসনের ফর্ম নিয়ে টিমের কোচ প্রকাশ্যে অসূয়া দেখাচ্ছেন না। ডারেন লেম্যান বলে দিয়েছেন, “টিমের কাছে ও অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। গত সপ্তাহে খেলবে না শোনার পরেও অসাধারণ মনোভাব দেখিয়েছে ও।” কিন্তু বাস্তব তা বলছে না। তাঁর আচমকা বাদ পড়ায় জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল, ওয়াটসনের আন্তর্জাতিক কেরিয়ারই সঙ্কটে পড়ে গেল কি না? ক্লার্ক—তাঁর সমস্যাও কম নয়। সিডনিতে গত কয়েকটা ওয়ান ডে ম্যাচে যতটা করে ঘাস দেখতেন, এ দিন উইকেট দেখে সেটা পাননি। উইকেটে রোলিং, রোদ্দুর, সব মিলিয়ে ক্লার্ক বলতে শুরু করেছেন, উইকেট ধীরে ধীরে হয়তো শক্ত হবে। আশা করছেন, নিশ্চয়ই হবে।
কিন্তু সেটা না হলে একটা সেকুগে প্রসন্নের ধাঁধা থাকে। উইকেটের চরিত্র বদল না হলে যে লেগস্পিনারকে খেলাবে বলে ঠিক করে ফেলেছে শ্রীলঙ্কা। বলা হচ্ছে, উইকেট যদি স্পিন সহায়ক হয়, তা হলে দেশের মাঠে নামলেও সেটা অস্ট্রেলিয়ারই বিপক্ষে যাবে। যতই রঙ্গনা হেরাথের স্পিনিং ফিঙ্গারকে চোট আক্রমণ করে তাঁকে ম্যাচের বাইরে করে দিক, শ্রীলঙ্কা মনে করছে পরপর তিনটে ম্যাচ জিতে তারা ঠিক সময়ে ‘পিক’ করছে। হেরাথ নেই। কিন্তু প্রসন্ন আছে। সে না পারলে একটা তিলকরত্নে দিলশান আছে। যাঁর স্পিন বিশ্বকাপে ভালই কাজ দিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া সহজে বাঁচবে না।
আসলে ম্যাচটার ঐতিহ্যই এমন। পঁচাত্তরের বিশ্বকাপ থেকে ২০১১— যত বার অস্ট্রেলিয়া-শ্রীলঙ্কা, তত বার উত্তাপের চোটে থার্মোমিটার টুকরো। তা সে জেফ টমসনের বল মাথায় খাওয়ার পর দিন দলীপ মেন্ডিসের ঘরে পুলিশ অফিসারের ঢুকে, ‘আপনি মিস্টার টমসনের বিরুদ্ধে চার্জ আনবেন কি না’ জিজ্ঞেস করাই হোক, বা ’৯৬ বিশ্বকাপে দু’দেশের সম্পর্কের অবনতিতে মার্ক টেলরের টিমের সঙ্গে রণতুঙ্গাদের হাত না মেলানোর বিতর্কিত সিদ্ধান্ত— কখনওই ম্যাচটা নিরামিষ হয়নি।
রবিবার কী হবে?
রেকর্ডের যুদ্ধ একটা চলছে। ’৯৬ ফাইনালের পর বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে পরপর হারের রেকর্ডে যদি লঙ্কা সমর্থকদের মন খারাপ হয়, তা হলে তাঁদের উৎসাহ দেবে এসসিজির রেকর্ড। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে কিন্তু গত আটটা পূর্ণ ম্যাচের মাত্র দু’টোয় হেরেছে শ্রীলঙ্কা। মাহেলা জয়বর্ধনের কথাবার্তা শুনলে আঁচটা আরও ভাল বোঝা যাবে। অস্ট্রেলিয়ার শক্তি পেস আর সেই পেস বোলিং নিয়ে মাহেলা বলে রাখলেন, “আমরা অপেক্ষা করে আছি। তবে শুধু গতি থাকলেই হয় না। নিখুঁত বোলিংটাও করতে হয়। নইলে পেস দিয়েও রান আটকানো যাবে না।”
প্রচ্ছন্ন হুমকি? নিশ্চয়ই।
সাধে কি আর ম্যাচটাকে কাপ-ইতিহাসের ‘গ্রেটেস্ট রাইভ্যালরি’ বলা হচ্ছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy