নির্বাচনের আগে আড্ডায় দুই ফুটবল সচিব পদপ্রার্থী। মধ্য কলকাতার এক রেস্তোরাঁয়। ছবি: উৎপল সরকার
মোহনবাগানের একশো পঁচিশ বছরের ইতিহাসে ফুটবল সচিব পদে প্রথম বার মুখোমুখি দুই ঘরের ছেলে। সুব্রত ভট্টাচা়র্য এবং সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়। দুই প্রাক্তন ফুটবলার সরকারি ভাবে ঐতিহাসিক লড়াইয়ে নেমে পড়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই এক টেবিলে গুরু-শিষ্য। কখনও উত্তেজিত হয় চ্যালেঞ্জ নেওয়া। কখনও সহনশীল। আকর্ষণীয় সেই তর্কযুদ্ধের সাক্ষী শুধু আনন্দবাজার।
সুব্রত: আরে সত্য, তুই দাঁড়িয়ে গেলি আমার বিরুদ্ধে? ভোটে জিতে কী করবি? সব তো ওরা চার জনই (টুটু-অঞ্জন-সৃঞ্জয়-দেবাশিস) করবে!
সত্যজিৎ: বাবলুদা, তুমি মনে হয় এখনকার ব্যাপারটা জানো না। এই যে টিমটা এখন খেলছে, সঞ্জয় (সেন) যে কোচ হয়েছে সব তো আমরা টেকনিক্যাল কমিটিই করেছি। তোমাকেও তো আমরাই দু’হাজার বারোয় মোহনবাগান কোচ করেছিলাম।
সুব্রত: মোহনবাগানে কী হয় আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। সব তো ওই চার জন। তোদের ছুঁইয়ে নেয়। আচ্ছা ঠিক আছে, আমাকে কোচ করেছিলি বলছিস, তার মানে আমাকে তাড়ানোর সময়ও তোদের মত ছিল?
সত্যজিৎ: (কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর) সেটা তো অন্য ব্যাপার ছিল। তোমার সমস্যাটা হল বাস্তবের জমিতে কখনও হাঁটো না। আবেগ দিয়ে কবিতা লেখা যায়—জীবনানন্দ লিখতেন, জয় গোস্বামীরা লেখেন। আবেগ দিয়ে সংগঠন হয় না। সেটা ভোটের পর বুঝতে পারবে।
সুব্রত: (রাগত ভাবে) কী বলতে চাইছিস? আমার চেয়ে বেশি বিকেলে ক্লাবে যাস? ওদের মানে তুই যাদের হয়ে নেমেছিস তাদের নোংরামি জানতে গেলে রোজ বিকেলে ক্লাবে যেতে হবে। আমার বিরুদ্ধে তোকে ছাড়া দাঁড় করানোর লোক পাচ্ছিল না। চুনীদা, নয়তো তুই। দাঁড়িয়েছিস ভাল করেছিস। কিছু করতে পারবি না। আমি জেলায় জেলায়ও ঘুরেছি।
সত্যজিৎ: জেতার স্বপ্ন দেখতেই পারো তুমি। সবাই-ই দেখে। বাস্তবের রুক্ষ জমিতে নেমে দেখো। ভোটের পর দেখবে আমিই জিতেছি। কোনও সংশয় নেই। (হেসে) তোমার পুরনো পাড়া শ্যামনগরেও প্রচারে যাব। আমার পাড়ায় তুমি যাবে?
সুব্রত: কবে যাবি? গিয়ে কী বলবি? কী জানিস? কে শুনবে? তবে আমি যাব শুনতে। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে চার লাইন বলতে পারবি? বল কী বলবি? অ্যাকাউন্টসের বেআইনি যে সব জিনিস আছে! আনব, দেখবি আনব? আমার ব্যাগে কিন্তু সব কাগজপত্তর আছে।
সত্যজিৎ: (হাত দিয়ে থামিয়ে) আরে তুমি তো কখনও সংগঠন করোনি। ক্লাবও করোনি। আমরা করি। বালিতে আমার কোচিং সেন্টার আছে। শুধু হাওয়ায় ঘুরলে হবে? সব কিছুর একটা নিয়ম আছে। মোহনবাগানের হিসাব অডিট হয়েছে। কর্মসমিতিতে পাশ হয়েছে। সাধারণ সভায় পাশ হয়েছে। তোমার কথা কেন সদস্যরা শুনবেন?
সুব্রত: কী বলছিস, শুনবে না? আদালতে সব উঠছে। যদি প্রমাণ হয় তা হলে ফুটবল সচিবের পদ ছেড়ে দিবি বল? এই নে কাগজ দিচ্ছি, লেখ।
সত্যজিৎ: ভোটই তো হল না। এখনই ছাড়ার কথা বলব কেন? (হেসে) তার মানে আমি জিতে গিয়েছি বলছ?
সুব্রত: হার-জিত তো সব লড়াইয়েই আছে। তুই জিতলে তো আমারই জয়! আমিই তো প্রথম ক্লাবের ফুটবলারদের কর্মসমিতিতে নেওয়ার দাবি তুলেছিলাম। তোদের টুম্পাই-দেবাশিস সমঝোতা করার জন্য যা প্রস্তাব লিখে নিয়ে এসেছিল সেটা আমি সই করে দিলে তুই তো দাঁড়াতেই পারতিস না। ফুটবল সচিব আমিই হতাম। কিন্তু আমি বিক্রি হব না। তোর সঙ্গে কী লড়ব? এক সঙ্গে খেলেছি, তোকে কোচিং করিয়েছি। আসল লড়াই তো ওদের চার জনের সঙ্গে। তুই দাড়িয়েছিস। নির্বাচনী সভায় তোকে নিয়ে বলতে হবেই। তবে বলব শালীনতা রেখে।
সত্যজিৎ: আমাদের প্রস্তাবগুলো মানতেই পারতে। তুমি ফুটবল সচিব হয়ে কাজ করলে গর্বিত হতাম। আমি কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে কিছু বলব না। তোমার সঙ্গে আমার যা সম্পর্ক! আমি যা বলব সার্বিক ভাবে বলব।
সুব্রত: আমার বিরুদ্ধে কী বলবি? তোর সঙ্গে নিশ্চয়ই বিদেশ (বসু), শিবাজী (বন্দ্যোপাধ্যায়), মানসরা (ভট্টাচার্য) যাবে। সব ধান্দাবাজ। ওই ওরা কিনে নিয়েছে এদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে। আমার কাউকে দরকার নেই। আমিই লাদেন, আমিই মাদার টেরিজা। একাই একশো!
সত্যজিৎ: সবাই ফোন করছে। দেখি কে কে যায়। ক্লাব থেকে প্রস্তাব দিয়েছিল ফুটবল সচিব পদে দাঁড়ানোর। ভাবলাম কোচিংটা আমার দ্বারা হবে না। প্রশাসনে এসে যদি ক্লাবের ভাল কিছু করতে পারি। করুণাবাবু, মান্নাদা, চুনীদা-রা এই পদে ছিলেন। আমি এলে পরম্পরা বজায় থাকবে। তুমি এলেও!
সুব্রত: গত পঁচিশ বছর পরম্পরা কোথায় ছিল? কেন কোনও ফুটবলারকে আনেনি টুটুরা? নব্বইতেই আমি জিততাম। টুটু-অঞ্জন-বলরাম মিলে অন্যায় ভাবে হারিয়েছিল।
আনন্দবাজার: তা হলে সেই বলরাম চৌধুরীর প্যানেলে এ বার আপনি দাঁড়ালেন কী ভাবে?
সুব্রত: এটা কারও প্যানেল নয়। সুব্রত ভট্টাচার্যের প্যানেল। তাতে সবাই লড়ছে। আরে সত্য, ক্লাবকে যারা কলুষিত করছে, নানা কেলেঙ্কারিতে ডুবে আছে, তাদের হয়ে দাঁড়িয়ে গেলি? কী আর করবি? বুঝতেই পারছি, চাপে পড়ে করেছিস।
সত্যজিৎ: তোমার কথা মানছি না। তোমার বিরুদ্ধে জেনেশুনেই ভোটে নেমেছি। কেউ চাপ দেয়নি। ভোটেই তো সব ঠিক হয়ে যাবে। টিমের আর্থিক সমস্যা হলে কে টাকা দেয়? সেই টুটুদা।
সুব্রত: (উত্তেজিত ভাবে আঙুল তুলে) কী বলছিস? কে টাকা দেয়? টুটু? এক পয়সাও দেয়নি। সব প্রমাণ আছে আমার কাছে। কী টাকা দেয়, কত ফেরত নেয়, কার্ড কী ভাবে হয়—সব জানি। সব ফাঁস করব।
সত্যজিৎ: তুমি বললে কী হবে? সদস্যারা সব জানেন। ভোটটা হোক না! দেখবে কী হয়।
আনন্দবাজার: দু’জনের যিনিই ফুটবল সচিব হয়ে আসুন, সেই বারবার কোচ বদল হবে কি? স্বদেশি না বিদেশি—কোন কোচ পছন্দ?
সুব্রত: আমার স্বদেশি কোচই পছন্দ। তবে আমি ইন্টারভিউ নেব। তবে কোচের সঙ্গে তোর দলের লোকেদের মত আচরণ করব না।
সত্যজিৎ: স্বদেশি কোচ আমারও পছন্দ। তবে পরিস্থিতি দেখতে হবে। আলোচনা করব।
সুব্রত: আরে তোদের কোচ বাছবে তো দেবাশিস-টুম্পাই-অঞ্জন। তোর কথা শুনবে?
সত্যজিৎ: দেখো না কী হয়!
সুব্রত: সব জানা আছে। জিতব আমিই। তার পরে সব ক’টাকে তাড়াব। তবে তোকে নেব। হাজার হোক, তুই তো আমারই ছাত্র!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy