Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শিখরদের দায়িত্ববোধ দেখলাম না, কিন্তু জানি ওরা কতটা পুড়ছে

৩২ বছর আগে কপিল’স ডেভিলসের বিশ্বজয়ী টিমে তিনিও ছিলেন। এ বার ধোনিদের মিশন নিয়ে আনন্দবাজারে এক্সক্লুসিভ কাপ আড্ডায় দিলীপ বেঙ্গসরকরনাহ, আজ দিনটাই ভারতের ছিল না। টস থেকে শুরু করে উমেশ যাদবের উইকেট পুরো ম্যাচেই প্রায় কর্তৃত্ব রেখে জিতল অস্ট্রেলিয়া। সত্যি, ম্যান অব দ্য ম্যাচ স্টিভ স্মিথ আর অ্যারন ফিঞ্চ দুর্দান্ত ব্যাট করেছে। ওদের পার্টনারশিপটা আমার দারুণ লেগেছে। আরে, ওয়ান ডে-তে দুটো জিনিসই তো সবচেয়ে জরুরি। শুরুটা ভাল করা, আর ভাল কয়েকটা পার্টনারশিপ তৈরি করা। অস্ট্রেলিয়া সেগুলো তো করলই। তার পর নীচের দিকে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল আর মিচেল জনসনও দ্রুত রান তুলে স্কোরটা তিনশোর চেয়ে সাড়ে তিনশোর বেশি কাছাকাছি নিয়ে গেল।

স্বপ্নের মৃত্যু

স্বপ্নের মৃত্যু

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৫ ০৪:৩৮
Share: Save:

নাহ, আজ দিনটাই ভারতের ছিল না। টস থেকে শুরু করে উমেশ যাদবের উইকেট পুরো ম্যাচেই প্রায় কর্তৃত্ব রেখে জিতল অস্ট্রেলিয়া। সত্যি, ম্যান অব দ্য ম্যাচ স্টিভ স্মিথ আর অ্যারন ফিঞ্চ দুর্দান্ত ব্যাট করেছে। ওদের পার্টনারশিপটা আমার দারুণ লেগেছে। আরে, ওয়ান ডে-তে দুটো জিনিসই তো সবচেয়ে জরুরি। শুরুটা ভাল করা, আর ভাল কয়েকটা পার্টনারশিপ তৈরি করা। অস্ট্রেলিয়া সেগুলো তো করলই। তার পর নীচের দিকে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল আর মিচেল জনসনও দ্রুত রান তুলে স্কোরটা তিনশোর চেয়ে সাড়ে তিনশোর বেশি কাছাকাছি নিয়ে গেল।

আজকাল ওয়ান ডে-তে তিনশো হামেশাই উঠছে। সেটা সফল ভাবে তাড়াও করে দিচ্ছে টিমগুলো। কিন্তু ভাই, নকআউট আলাদা ব্যাপার। সেই চাপটার কথায় মাথায় রাখলেই বুঝতে পারবেন, ৩২৮ বিশাল টার্গেট। তাও ভারত শুরুটা ভাল করেছিল। কিন্তু ওই সময় শিখর ধবনের ব্যাটিং দেখে অবাক লাগল। যখন সব কিছু তোমার পক্ষে যাচ্ছে, তখন এক্সট্রা কভারের উপর দিয়ে ও রকম বোকার মতো একটা শট খেলার কোনও মানে আছে কি? শিখরের ব্যাটিং দেখে মনে হল হয় ছেলেটা নিজেকে নিয়ে বড্ড বেশি আত্মবিশ্বাসী, না হলে ওর ধৃষ্টতাটা মাত্রাতিরিক্ত। ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, ‘ককি’? শিখর হল ঠিক তাই।

বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ৩২৮ তাড়া করতে নামলে যে দায়িত্ববোধ, যে বিচক্ষণতা দরকার, তার একটাও দেখলাম না শিখরের ইনিংসে। আর বিরাট কোহলিকে দেখে মনে হল ও বড্ড বেশি চাপে আছে। সাধারণত যে ভাবে ওকে কোনও দিনই দেখিনি। নকআউট খেলার চাপ তো বিরাটের কাছে নতুন নয়। কেন ও আজ এতটা কুঁকড়ে থাকল, বুঝতে পারলাম না। কুড়ি ওভারের মধ্যে প্রথম তিনজন ব্যাটসম্যান ড্রেসিংরুমে লড়াইটার অর্ধেকেরও বেশি তো ওখানেই হেরে গেলাম আমরা!

এত বড় স্কোর তাড়া করতে গেলে কয়েকটা জিনিস হওয়া দরকার। যেমন প্রথম চার ব্যাটসম্যানের মধ্যে অন্তত এক জনের দেড়শোর কাছাকাছি রান করা। যেমন তিন-চারটে পার্টনারশিপ হওয়া। যেমন টার্গেটটাকে একসঙ্গে মাথায় না রেখে সেটাকে একশো বা দেড়শোর ছোট ছোট ভাগে ভেঙে নেওয়া। যার এক-একটা ধাপ ঠিকঠাক পেরোতে পারলে পরের দিকে অতটা চাপ হয়তো পড়ত না। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ভারত এর কোনওটাই করতে পারেনি সিডনিতে। এখানে মাইকেল ক্লার্কের ক্যাপ্টেন্সির প্রশংসা না করে পারছি না। বিরাট ব্যাট করতে নামার সঙ্গে সঙ্গে ক্লার্ক আক্রমণে নিয়ে এল মিচ জনসনকে। যে আজ অনেক দিন পর আগুনে গতিতে বল করল। বিরাটকে করা ওর বেশ কয়েকটা বল দেড়শোর আশেপাশে ছিল। এটাকেই তো বলে মাস্টারস্ট্রোক!

যাই হোক, ম্যাচ নিয়ে কাটাছেঁড়া করলে তো আর ম্যাচটার ফল পাল্টে যাবে না। হ্যাঁ, আজকের দিনটা দেশের কাছে দুঃখের। কিন্তু এই যে দেখছি লোকজন এর মধ্যে বিরাটের ব্যক্তিগত জীবন টেনে আনছে, সেটা মানতে পারছি না। হয়তো এর পর ধোনিদের বাড়িতে ইট-পাটকেলও পড়বে। যেটা অত্যন্ত লজ্জাজনক। ক্রিকেট আমাদের দেশে একটা ধর্ম, তাই ক্রিকেট ঘিরে আবেগগুলোও চরম হতে বাধ্য। কিন্তু তাই বলে প্লেয়ারদের ব্যক্তিগত ভাবে আক্রমণ করা একেবারেই উচিত নয়। আমি তো বলব, মিডিয়ারও এটা নিয়ে আর একটু দায়িত্ববোধ দেখানো উচিত ছিল। প্লেয়ারদের কুশপুতুল পোড়ানো হচ্ছে, টিভিতে এ সব দেখলে সেই রাগটা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে যাবেই। এই যে ভারতের কাছে টিম হেরে যাওয়ায় পাকিস্তানে টিভি পোড়ানো হল, বিশ্বাস করুন এগুলো আমার ভীষণ অদ্ভুত লাগে। বুঝতে পারি না, হারের কষ্টের উপর এগুলো করার কি খুব দরকার?

এগুলো বলতে বলতে আমার নিজের ক্রিকেটজীবনের একটা সময় মনে পড়ে গেল। সাতাশির বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। সবাই ধরে নিয়েছে, ওই ম্যাচটা আমরা জিতব। ইডেনে ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল হবে। তা আগের সেমিফাইনালটায় পাকিস্তান হেরে গেল। আর ওয়াংখেড়েতে আমরা ইংল্যান্ডকে হারাতে পারলাম না। যে রবি শাস্ত্রী-মনিন্দর সিংহ গোটা বিশ্বকাপে দুর্দান্ত বল করল, ওই ম্যাচে তাদের সুইপ করে করে শেষ করে দিল গ্রাহাম গুচ। সেই ম্যাচটায় আমি খেলিনি, কিন্তু ড্রেসিংরুমে ছিলাম তাই জানি টিম কতটা ভেঙে পড়েছিল। এ রকম বড় মঞ্চে হারের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা কত কঠিন, পেশাদার প্লেয়ার ছাড়া বোধহয় কেউই ঠিক বুঝবে না।

আর শুধু বড় ম্যাচে হার কেন। নিজের কথা বলতে পারি, আমি তো একটা খারাপ শটে আউট হলে পরের দু’তিন মাস ভুলতে পারতাম না। পোকার মতো মনের মধ্যে চিন্তা ঘুরেফিরে বেড়াত যে, কেন ও রকম শট খেলতে গেলাম আমি? কেন অন্য কিছু করলাম না? কী ভাবে পরে ও রকম আউট এড়াব?

আর ধোনিদের কথা ভাবুন। প্রায় চার মাস দেশের বাইরে পড়ে আছে ছেলেগুলো। পরিবার, বন্ধুদের ছেড়ে। আগের বার বিশ্বকাপে গ্যারি কার্স্টেন নিয়ম করেছিল যে, প্লেয়াররা খবরের কাগজ পড়তে পারবে না। যাতে বাইরের দুনিয়ার ক্যাঁচরম্যাঁচর ওদের কানে না যায়। কিন্তু তাতে কি খুব কাজ হয়? কাগজ না হয় পড়লাম না। হোটেলের ঘরে বসে টিভি দেখাটা কে আটকাবে? আর এখন তো ইন্টারনেট এসে যাওয়ায় সুইচ অফ করা আরও অনেক কঠিন হয়ে গিয়েছে।

আমি যেটা বলতে চাইছি সেটা হল, প্লেয়াররা নিজেরাই যথেষ্ট কষ্টের মধ্যে রয়েছে। যে কষ্ট এড়ানো ওদের পক্ষে কঠিন নয়, অসম্ভব। এর উপর যদি নাগাড়ে ওদের অযৌক্তিক ভাবে আক্রমণ করে যাওয়া হয়, তা হলে ছেলেগুলোর মনের অবস্থা কী হবে ভেবে দেখেছেন কি? তার চেয়ে এখন কয়েকটা দিন ওদের একটু শান্তিতে থাকতে দিন না। বাড়ি ফিরতে দিন, বন্ধুবান্ধব-পরিবারের সঙ্গে একটু সময় কাটাতে দিন।

আপনারা তো তবু স্কুল-কলেজ-অফিসের অন্য জীবনে ক্রিকেট মাঠের ব্যর্থতা ভুলে থাকতে পারবেন। এই ছেলেগুলোর তো এই একটাই জীবন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE