আগ্রাসী: কোহালির আগ্রাসনে ঔদ্ধত্য নেই, মত অরবিন্দের। ফাইল চিত্র
সামান্য পুরনো ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তদের মন থেকে নিশ্চয়ই সেই দিনটার দাগ মুছে যায়নি। ১৩ মার্চ, ১৯৯৬। ইডেনে সে দিন বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জাভাগল শ্রীনাথ বিপজ্জনক ওপেনিং জুটি সনৎ জয়সূর্য এবং রোমেশ কালুভিথর্নেকে তুলে নিলেন। তার পর কোনও এক শিল্পীর প্রবেশ এবং তাঁর তুলির টানে দ্রুত ম্যাচ থেকে ছিটকে যাওয়া শুরু ভারতের। সে দিন তাঁর ৬৬ রানের কাউন্টার অ্যাটাকিং ইনিংসই টার্নিং পয়েন্ট হয়ে গিয়েছিল। এর পর ফাইনালে তাঁর সেঞ্চুরির সুবাদে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতে ইতিহাস সৃষ্টি করল শ্রীলঙ্কা। ব্যাট হাতে যেন উড়তেন তিনি। এমনই গতিশীল আর স্ট্রোকে ভরপুর ব্যাটিং ছিল যে, গাড়িভক্ত তাঁর নামকরণ হয়েছিল ‘ম্যাডম্যাক্স’। এখন একটি গাড়ি সংস্থাতেই ‘বস্’ তিনি। সকাল থেকে নানা কাজ আর মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকায় ইন্টারভিউয়ের সময় বারবার বদলাতে হল। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট ইতিহাসে সব চেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাটসম্যান অরবিন্দ ডি’সিলভা-কে শেষ পর্যন্ত যখন সন্ধের দিকে ফোনে পাওয়া গেল, তখন আর একটা মিটিংয়ে ঢুকবেন। কথা শুরু...
প্রশ্ন: কলম্বোতে খেলা দেখতে এসেছিলেন। কেমন লাগল এই ভারতীয় দলকে?
অরবিন্দ ডি’সিলভা: বেশ ভাল। ওরা টিম হিসেবে খেলছে। তরুণ সব ছেলেদের নিয়ে চলতে শুরু করে এখন দাঁড়িয়ে গিয়েছে। টিমটাকে খুব আত্মবিশ্বাসী লাগল।
প্র: এমন কিছু দেখলেন এই ভারতীয় দলটার মধ্যে যা বিশেষ ভাবে আপনার নজর টানল?
অরবিন্দ: ভাল করার খিদে দেখতে পেলাম। যেটা আমাকে খুব প্রভাবিত করেছে। জেতার ইচ্ছেটা খুব রয়েছে। এটাই আসল। আম্তর্জাতিক ক্রিকেটে মানসিকতাটাই সব। জেতারও আগে জেতার মানসিকতা তৈরি করা দরকার। সেটা ভারতের এই টিমটার মধ্যে এসে গিয়েছে।
প্র: এই টিমের ক্যাপ্টেন সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
অরবিন্দ: বিরাট কোহালি এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের এক জন। ধারাবাহিকতা খুব ভাল আর সেটা ওকে অন্যদের চেয়ে আলাদা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, ম্যাচ জেতানোর ক্ষেত্রে ওর অবদান। যত দূর জানি, ম্যাচ জেতানোর ক্ষেত্রে সব চেয়ে ভাল রেকর্ড ওর। রান তাড়া করে জিতিয়েছে সব চেয়ে বেশি বার। এ গুলো সবই গ্রেট ক্রিকেটারের লক্ষণ।
প্র: সর্বকালের অন্যতম সেরা এক ব্যাটসম্যান এবং স্ট্রোকমেকারকে যদি জিজ্ঞেস করি কত বড় ব্যাটসম্যান কোহালি, কী বলবেন?
অরবিন্দ: আমার মতে, এই প্রজন্মে দু’জন সেরা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহালি এবং এ বি ডিভিলিয়ার্স। ওদের আমি সব চেয়ে উপরে রাখব।
প্র: কেন এঁরা দু’জন আর সকলের চেয়ে এগিয়ে?
অরবিন্দ: কারণ, ওরা বোলারদের শাসন করতে পারে। দারুণ সব শট খেলতে পারে। চাপের মুখে রান করে। কখনও ওদের স্বাভাবিক খেলাটা নষ্ট হতে দেখি না। সেই কারণেই ওদের সেরা মনে হয়েছে।
প্র: আপনি নিজে দুর্ধর্ষ স্ট্রোকমেকার ছিলেন। আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতেন। কোহালিকে কোন ধরনের ব্যাটসম্যান বলবেন?
অরবিন্দ: কোহালিও বেশ আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে। পজিটিভি ব্যাটসম্যান। যে ক্রিজে থাকলে দলের মধ্যেও ইতিবাচক তরঙ্গ তৈরি হয়।
প্র: কোহালিকে অনেকে ইতিমধ্যেই গ্রেটদের গ্রহে দেখতে শুরু করেছেন। আপনি কী বলবেন?
অরবিন্দ: আমি বলব যে, কোহালির ক্ষমতা আছে গ্রেটদের গ্রহে ঢুকে পড়ার। আমি একেবারেই অবাক হব না যদি সেটা ঘটে।
প্র: কোহালি অনেক রেকর্ডই ভেঙে দিচ্ছেন। ভিভ রিচার্ডস, সচিন তেন্ডুলকরদের সঙ্গে তুলনা করা যায়?
অরবিন্দ: আমার প্রিয় ব্যাটসম্যান ছিলেন ভিভ। কোহালির মধ্যে ভিভের সেই ডাকাবুকো ভঙ্গিটা দেখতে পাই। ‘অ্যাপ্রোচ’টায় মিল আছে দু’জনের। এটা ঠিক যে বিরাটের এখনও অনেক রাস্তা যাওয়া বাকি। ভিভের বিরল সব প্রাপ্তি রয়েছে। সেগুলো চট করে ধরে ফেলা যাবে না। তবে ভিভের মতো বিরাটও শাসন করতে চায়, শাসিত হতে চায় না। সেটা মাঠে দাঁড়িয়ে ওর ভাবভঙ্গি থেকেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
প্র: অনেকে আবার বলেন, বিরাট অতি আক্রমণাত্মক। এবং, সেটা নিয়ে দেশের সংবাদমাধ্যমে খুব সমালোচিতও হয়েছেন বার বার।
অরবিন্দ: ধুর, ধুর। অতি আক্রমণাত্মক আবার কী! ক্রিকেট মাঠে দাঁড়িয়ে অতি আক্রমণাত্মক বা অতিরিক্ত আগ্রাসন বলে কিছু হয় না। টিমের প্রয়োজনে, নিজের সেরাটা দেওয়ার জন্য যা যা দরকার, তা করা যেতেই পারে। আমার মনে হয়, বিরাট সেটাই করে। ওর আগ্রাসনের সমালোচনা তখনই করা যেতে পারে যদি দর্শকদের সঙ্গে ও উদ্ধত আচরণ করে। বিরাট সে রকম কিছু করেছে কি? আগ্রাসন আর ঔদ্ধত্যের মধ্যে কিন্তু তফাত আছে।
আরও পড়ুন:শেষ টেস্টে জাডেজার বদলি হওয়ার দৌড়ে অক্ষর
প্র: আর একটা তর্ক শুরু হয়েছে যে, সচিনের রেকর্ড কি বিরাট ভেঙে দিতে পারেন? আপনি কী বলবেন?
অরবিন্দ: সচিনের তো অনেক রেকর্ড। কোনটার কথা বলছেন, সেটা প্রথমে জেনে নেওয়া দরকার (হাসি)।
প্র: ধরুন যদি একশো সেঞ্চুরির কথাই বলা যায়।
অরবিন্দ: কঠিনতম হার্ডল, সন্দেহ নেই। এখন এত বেশি ক্রিকেট হয় যে, বিরাটের সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ফিট থাকা। যদি ও ফিট থাকতে পারে এবং আরও দশ বছর খেলতে পারে, তা হলে কে বলতে পারে সচিনের রেকর্ড ধরে ফেলবে না! কাজটা কঠিন। কিন্তু একেবারে পারবে না বলে উড়িয়েও দেওয়া যাবে না। বিশেষ করে বিরাট যখন দুর্দান্ত গতিতে সেঞ্চুরির সংখ্যা বাড়াচ্ছে।
প্র: মানে সচিনের রেকর্ড বিরাট ধরে ফেলতেও পারেন?
অরবিন্দ: বলছি না পারবেই। আবার এটাও বলতে চাই যে, কেন নয়? ভারতে কিংবদন্তি ছিল সুনীল গাওস্কর। ব্যাটিংয়ের সব রেকর্ড তো সানিরই ছিল একটা সময়। সচিন এসে সব রেকর্ড ওর দখলে নিয়ে নিল। এখন বিরাট ভারতীয় দলের সেরা ব্যাটসম্যান। দারুণ ফর্মে রান করছে, সেঞ্চুরি করছে। হতেই তো পারে যে ও রেকর্ডটা ধরে ফেলল। সেটা সময় ও ফিটনেস-সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে অসম্ভব বলা যাবে না।
প্র: শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট দলের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
অরবিন্দ: নিজেদের উপর আস্থা রাখতে বলব। খারাপ সময় যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু আমি বলব, এই শ্রীলঙ্কা টিমটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। দরকার কয়েকটা ভাল পারফরম্যান্স। যা ওদের মনোবল বাড়িয়ে তুলবে। আশা করব, নির্বাচকেরাও ধৈর্য ধরবে আর ওদের যোগ্যতায় আস্থা রাখবে। সিরিজটা হেরে গেল বলেই যেন হঠকারিতা করে প্লেয়ার ছাঁটাইয়ের নেশায় মাতে।
প্র: কলকাতার বাসিন্দা হিসেবে জানতে চাইব, ইডেনে ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের সেই ইনিংসের স্মৃতি এখনও কতটা মধুর। কলকাতার অনেক ক্রিকেট ভক্তের কাছে সেটা এখনও সেরা ইনিংস হিসেবে চোখে লেগে রয়েছে।
অরবিন্দ: ধন্যবাদ কলকাতাকে। সেই ইনিংসটা মনে রাখার জন্য। আমার কাছে অন্যতম সেরা স্মৃতি হয়ে থাকবে ইডেনে সেমিফাইনালের সেই ইনিংস। তবে আরও স্মরণীয় অবশ্যই লাহৌরে ফাইনালের সেঞ্চুরিটা। কারণ ওটা আমাদের বিশ্বকাপ দিয়েছিল। ক্রিকেট জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! বিশ্বকাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। বিশ্বসেরা। ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy