নাতি অগস্ত্যের সঙ্গে প্রণব বর্ধন। নিজস্ব চিত্র।
সোনার ছেলে, সোনার মেয়েরা যখন একটার পর একটা পদক জিতছেন দেশের হয়ে, তখন কোত্থেকে যেন উড়ে এসেই আচমকা জুড়ে বসলেন দুই বাঙালি ‘বুড়ো’। ‘বুড়ো’ তো বটেই। আর যাঁরা খেলতে নেমেছেন এশিয়াডের মঞ্চে, তাঁরা সবাই যে প্রায় প্রণব-শিবনাথের ‘নাতি-নাতনীর বয়সী’।
৬০ বছরের প্রণব আর ৫৬ বছরের শিবনাথ ব্রিজে সোনা জিততেই নজির গড়ে ফেললেন প্রণব। এত বেশি বয়সে আর কেউ কখনও কোনও এশিয়াড পদক জেতেনি।
প্রণব বর্ধনের বাড়ি দক্ষিণ কলকাতার সন্তোষপুরে। চলতি হাওয়ার পন্থী নয়, বরং বর্ধন পরিবার বরাবরই যেন ব্যতিক্রমী। তাস খেলা নিয়ে তো বটেই! গড়পড়তা বাঙালি পরিবারে তাস মানেই সময় নষ্ট। ‘তাস-দাবা-পাশা তিন সর্বনাশা’র প্রবাদটা বাঙালি সমাজে কম প্রচলিত নয়। তবে এ সবের মধ্যেও বাঙালি তাস খেলে। অফিস টাইমে যে কোনও লোকাল ট্রেনে, শহর-গ্রামের ক্লাব ঘরে, তাসের আসর বহুকালের চেনা ছবি। এখনও সে ছবি অমলিন। তবে বাঙালি-পরিবারের ঘরে ‘তাস পেটানো’র ছবি খুব বেশি দেখা যায় না। বর্ধন পরিবার সেখানে আলাদা। এখানে বরাবর জল-হাওয়া পেয়েছে তাসের নেশা। নেশা কেন, প্রেমই বলা যায় একে।
এশিয়ান গেমসে সোনা জেতার পর প্রণব বর্ধন ও শিবনাথ দে সরকার। ছবি: পিটিআই।
এশিয়ান গেমসে এ বারই প্রথম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কনট্র্যাক্ট ব্রিজ। আর প্রথম বারেই হাওড়া সালকিয়ার শিবনাথ দে সরকারের সঙ্গে জুটি বেঁধে তাতে বাজিমাত করেছেন প্রণব বর্ধন। টেলিফোনে কথা হচ্ছিল প্রণবের মেয়ে প্রতিরূপার সঙ্গে। কথায় কথায় জানা গেল, বিয়ের আগেই ভাবী স্ত্রী রুমাকে বলে দিয়েছিলেন নিজের তাস-প্রেমের কথা। আর মেয়ে তো ছোট থেকেই দেখছেন। “অন্যদের থেকে যে প্রচলিত ধারণা মাফিক মন্তব্য শুনিনি তা নয়। তবে সেটাকে পাত্তা দিইনি। পরিবারের মধ্যে সেই ধারণাকে আশ্রয় দিইনি আমরা”— বলছিলেন প্রতিরূপা। চাকরি সূত্রে গোয়ায় থাকেন। তবে এই মুহূর্তে কলকাতায়। কথা বলার সময় বেরিয়ে আসছিল বাবার সোনা জয়ের জন্য উচ্ছ্বাসটা। ফিরে যাচ্ছিলেন আগের কথায়। “বাবা বোঝাত এটা যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, লজিক মেনে খেলতে হয়। লাক নয়, এটা লজিকের খেলা। এটা অঙ্কও। আমরা তাই ছোট থেকেই এই খেলাকে অন্য চোখে দেখেছি”— বলছিলেন প্রতিরূপা।
বর্মন পরিবারের রক্তেই তাস। প্রণব বর্ধনের বাবাও ভালবাসতেন খেলতে। তাঁর দাদাও খেলতেন। তবে প্রণব শুধু ভালবাসাতেই আটকে থাকেননি। বেরিয়ে এসেছিলেন বড় প্রতিযোগিতার দরবারে। ব্রিজ যদি এশিয়ান গেমসে এ বার না ঢুকত, তা হলে আম বাঙালি, এমনকি খেলা প্রেমী বাঙালি, তাঁর নাম জানত কি না সন্দেহ।
আরও পড়ুন: ব্রিজে সোনা আনলেন দুই বাঙালি, বক্সিংয়েও এল সোনা
আরও পড়ুন: কাল ডার্বি, বিশ্বকাপার প্রতিপক্ষকে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে না মোহনবাগান
খেলার জন্য থাকতে হয় বাইরে বাইরে। স্ত্রী-মেয়েকে সময় দিতে পারেন কম। যদিও বর্ধন পরিবারের তাতে কোনও দিনই আপত্তি নেই। মেয়ে বললেন, “বাবা অনেক বছর ধরে এটা খেলছে। এটা নিয়ে খুব কমিটেড। যখন প্র্যাকটিস করে, তখন কারও সঙ্গে কথা বলে না। আমরা তাই বরাবর চেয়েছি, বাবা এটাতে উন্নতি করুক, সাফল্য পাক। ছোট থেকেই দেখছি, বাবা খেলার জন্য বাইরে বাইরে থাকছে। আমরা অবশ্য তা নিয়ে সমস্যা করিনি। সবসময় উত্সাহ দিয়েছি। ইতিবাচক ভাবে দেখেছি। মায়ের ওপর যদিও চাপ পড়ে যেত। সবকিছু সামলাতে হত।”
গত ১৬ বছর ধরে পেশাদার ভাবেই ব্রিজ খেলেন প্রণব বর্ধন। তার আগে প্রোমোটিং করতেন। কঠিন সময় যে আসেনি, তা নয়। জীবন সবসময় মসৃণ ছিল না। অনেক প্রতিযোগিতার এন্ট্রি ফি ছিল খুব বেশি। যা জোগাড় করতে স্পনসর খুঁজতে হত। স্ত্রী রুমা এই কঠিন সময়ে থেকেছেন পাশে। উত্সাহ দিয়েছেন। মেয়ের কথায়, “মা অনেক স্বার্থত্যাগ করেছে। মা এখনও স্কুলে পড়ায়। সবসময় বাবাকে বলেছে, তুমি খেলে যাও, ওতে মন দাও, অন্য কিছু ভাবতে হবে না। হাসিমুখেই মা সব দায়িত্ব পালন করেছে।”
প্রণব বর্ধনের ব্যস্ততা এখন অবশ্য আগের চেয়ে বেড়েছে। মেয়ের কথায়, “যখন ছোট ছিলাম, তখন অবশ্য বাবাকে তাও কাছে পেতাম। এখন দেখছি বাবা আরও অনেক বেশি বাইরে থাকছে।”
তিনি নিজেও এখন চাকরিসূত্রে থাকেন কলকাতা থেকে অনেক দূরে। ছুটিতে এসেছেন। আর সেই সময়ই এসেছে বাবার সোনা জেতার খবর। বাড়িতে প্রচারমাধ্যমের ভিড়, অভিনন্দন বার্তার জোয়ার। পাড়ার লোকেরা হঠাত্ এক্কেবারে অন্য চোখে তাকাচ্ছে। জীবন যেন পালটে গিয়েছে কয়েক ঘণ্টাতেই!
পারিবারিক প্রণব বর্ধন। স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে। নিজস্ব চিত্র।
প্রদীপ জ্বলার নেপথ্যে থাকে সলতে পাকানোর পর্ব। তেমনই সোনা জেতার সাফল্যের আড়ালে রয়েছে দীর্ঘ প্রস্তুতির ইতিহাস। গত বছর জুনে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সোলে এশিয়া প্যাসিফিক প্রতিযোগিতাতেও প্রণব সোনা পেয়েছিলেন ব্রিজে। এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতি হিসেবে জাকার্তাতেই গত নভেম্বরে একটা প্রতিযোগিতা হয়েছিল। তাতেও সোনা পেয়েছিলেন। এ ছাড়া ভারতীয় ব্রিজ ফেডারেশন প্রস্তুতি হিসেবে অনেক প্রতিযোগিতায় খেলার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। তাতেও অংশ নিয়েছিলেন প্রণব-শিবনাথ জুটি। প্রতিরূপার কথায়, “গত বছর ব্রিজ খেলার জন্য অনেক সফর করেছে বাবা। প্রচুর ঘোরাঘুরি করেছে। খুব ধকলও গিয়েছে।”
জানা গেল, শিবনাথ দে সরকারের সঙ্গে প্রণব বর্ধনের জুটি দীর্ঘ দিনের। দু’জনে এর আগেও অনেক প্রতিযোগিতায় একসঙ্গে খেলেছেন। এমনিতে ব্রিজ যেমন বাড়ি-ক্লাবে বসে খেলা যায়, একই ভাবে অনলাইনেও খেলা যায়। বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়রা অনেকেই একটা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনলাইনে এটা খেলেন। এশিয়াডে সোনা-জয়ী বাঙালি জুটিও তা করেছেন। নিজেদের শানিয়ে নিয়েছেন অনলাইনে। অংশ নিয়েছেন নানা প্রতিযোগিতায়। তাতে আবার সেরাও হয়েছেন। ফলে, আত্মবিশ্বাস তুঙ্গেই ছিল।
প্রতিরূপা বললেন, “মনে হচ্ছিল বাবা কিছু একটা করবে। এখন এত বড় মঞ্চে সোনা জেতার পর অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।” তিনি নিজেও একসময় শিখতে চেয়েছিলেন ব্রিজ। কিন্তু শেখা হয়ে ওঠেনি। প্রতিরূপা হেসে বললেন, “আমি বাবাকে অনেকবার বলেছি শেখাতে। কিন্তু আমার আর শেখা হয়নি। এ বার আমার ছেলেকে শেখাতেই হবে।” নাতি অগস্ত্য বর্ধন সরকারের বয়স এখন মাত্র ১৫ মাস। বাড়িতে এত আনন্দের কারণটা বোঝার বয়স এখনও হয়নি। বড় হয়ে দাদুর সোনার মেডেল দেখে তারও নিশ্চয় চোখ চকচক করবে। হয়ত দুই প্রজন্মের তাসুড়ে পরিবারটা একটা প্রজন্ম ফাঁক দিয়ে আবার খুঁজে নেবে নতুন খেলোয়াড়। সোনার দাদু তো নিশ্চয় সেটা চাইবেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy