সাফল্য: স্বপ্নার কীর্তি টিভিতে দেখছেন বাড়ির লোকজন । ছবি: সন্দীপ পাল
সাইকেলের পিছনে মেয়েকে চাপিয়ে রোজ ছ’কিলোমিটার উজিয়ে মাঠে পৌঁছে দিতেন মা। ভ্যানচালক বাবা তখন থেকেই শয্যাশায়ী। সেই মেয়ের সোনা জয়ের খবর যখন টিনের চাল দেওয়া দরমা-বেড়ার ঘরে এসে পৌঁছল, তখন সব যন্ত্রণা ভুলে উঠে বসার চেষ্টা করলেন বাবা। বাইরে উঠোনে তুবড়ি জ্বালিয়েছে কচিকাঁচারা। আতসবাজির হাল্কা আলোয় দেখা গেল, আঁচলের এক প্রান্ত দিয়ে চোখ মুছছেন কয়েক মিনিট আগে এশিয়াডে হেপ্টাথলনে সোনা জয়ী স্বপ্না বর্মণের মা বাসনা দেবী। তিনি বললেন, “স্বপ্না তো সেই কবেই খেলার জন্য বাড়ি ছেড়েছে। বিদেশ গিয়ে কতবার খেলেছে। জানেন, এখনও বাড়িতে এলে মাটিতে শোয়!”
মা-বাবা, দুই দাদা, বৌদি, তাঁদের ছেলেমেয়ে নিয়ে ভরা সংসারে ঘরের সংখ্যা এত কম যে, কারও কারও মাটিতে শোওয়া ছাড়া উপায়ও নেই। জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া পাতকাটার ঘোষপাড়ায় যেখানে স্বপ্নার বাড়ি, সেখানে পথ গিয়েছে প্রায় আলের উপর দিয়ে। বাবা পঞ্চাননবাবু এক সময়ে ভ্যান চালাতেন। তার পরে কোমর, হাঁটু, পায়ের ব্যথায় দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী। স্বপ্না তখন স্কুলে পড়েন। সংসারের হাল ধরতে বাসনা দেবী চা বাগানে ঠিকে কাজ শুরু করেন। ঘরকন্না, বাইরের কাজ সামলেও স্বপ্নাকে খেলতে নিয়ে যেতে বিরক্ত হননি কোনও দিন। তিনি বললেন, “তখন তো ভাবতেই পারিনি, ও কখনও এত বড় খেলায় জিতবে! শুধু চাইতাম, মেয়েটা যা চায় তাই যেন করতে পারে।”
বাড়ির পাশে ঘোষপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় স্বপ্নার প্রথম স্কুল। তার পরে কালিয়াগঞ্জ হাইস্কুল। স্বপ্নার অন্যতম কোচ সুকান্ত সিংহ বলেন, ‘‘যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে, তখন ও আমাদের ক্লাবে প্রথম আসে। ওর সতীর্থদের মধ্যে ওর পরিবারের অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ ছিল। কিন্তু খেলায় তার ছাপ কখনও পড়েনি।’’ এখন কলকাতার চারুচন্দ্র কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী স্বপ্না। জলপাইগুড়ি, কালিয়াগঞ্জের মতো তাঁর কলেজের শিক্ষক সমীর বেরা, বিমলশঙ্কর নন্দেরাও উচ্ছ্বসিত সোনা জয়ের খবরে। জলপাইগুড়ির মেয়ের সোনা জয়ের পরে অভিবন্দন জানিয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
খেলার জন্য অনেক দিনই ঘরছাড়া স্বপ্না। তাতেও কিন্তু বুধবার সন্ধ্যায় পাতকাটা ঘোষপাড়ার আনন্দ কেউ কমাতে পারেনি। হেপ্টাথলন কী খেলা— সেটা না জেনে টিভির সামনে ঠায় বসে থেকেছে গোটা পাড়া। শেষ দৌড়ে স্বপ্না প্রথম হননি। কিন্তু সেই দৌড় শেষ হওয়ার পরে তাঁর উচ্ছ্বাসই জানিয়ে দেয়, কে জিতেছে! মুঠো শূন্য ছুড়ে তাঁর দৌড় এবং তার পরে গ্যালারি থেকে জাতীয় পতাকা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নেওয়া দেখতে দেখতে ঘোষপাড়ার লোকজনও হইহই করে ওঠেন। বড় দাদা রাজমিস্ত্রি, ছোট দাদা দিনমজুর। সেই ছোড়দা অসিত বলছিলেন, “ওর দাঁতে ব্যথা। তার মধ্যেই খেলতে নেমেছিল। বরাবরই অসম্ভব জেদ। আজ এত কষ্টের মধ্যে জয়টাও এল কিন্তু সেই জেদের বশে।’’ ঘোষপাড়ার বাড়ি ঘিরে তখন আতসবাজির রোশনাই।
আরও পড়ুন: টস ফের হারলেন কোহালি, দল অপরিবর্তিত ভারতের
আরও পড়ুন: এশিয়ান গেমসে দুটো রুপো জিতেও কেরিয়ার নিয়ে আশঙ্কায় দ্যুতি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy