Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নেতৃত্ব-সঙ্কটের মধ্যেও কমেনি ‘প্রতারকদের’ নিয়ে বিদ্রোহ

বল-বিকৃতি কেলেঙ্কারির জেরে স্টিভ স্মিথ নির্বাসিত হওয়ার পরে টিম পেনকে অধিনায়ক করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, এতটা নরমসরম নেতাও কি দরকার ছিল অস্ট্রেলিয়ার?

কাঠগড়ায়: ওয়ার্নার-স্মিথের অপরাধ ক্ষমা করেনি অস্ট্রেলিয়ার মানুষ। ফাইল চিত্র

কাঠগড়ায়: ওয়ার্নার-স্মিথের অপরাধ ক্ষমা করেনি অস্ট্রেলিয়ার মানুষ। ফাইল চিত্র

সুমিত ঘোষ 
পার্থ শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৪:০৬
Share: Save:

অ্যাডিলেডে হারের যন্ত্রণার মধ্যেই বিরল সঙ্কট হাজির হয়েছে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে। বিমানবন্দর থেকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে যা নিয়ে সকলকে আলোচনা করতে দেখা যাচ্ছে। কী সেই সঙ্কট? না, দলকে চালানোর মতো ভাল অধিনায়কই পাওয়া যাচ্ছে না।

বল-বিকৃতি কেলেঙ্কারির জেরে স্টিভ স্মিথ নির্বাসিত হওয়ার পরে টিম পেনকে অধিনায়ক করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, এতটা নরমসরম নেতাও কি দরকার ছিল অস্ট্রেলিয়ার? এমনিতে অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিকেট ভক্তদের গভীরতা অবাক করে দেওয়ার মতো। সমস্ত পরিসংখ্যান ঠোঁটের গোড়ায় তৈরি। অ্যাডিলেডে টেলএন্ডাররা কত রান তুলেছে, পরিষ্কার বলে দেবেন যে কেউ। অ্যাডিলেড থেকে পার্‌থগামী উড়ানে বসে এক প্রৌঢ় ক্রিকেটপ্রেমী যেমন বলছিলেন, ‘‘চেতেশ্বর পুজারারই ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার প্রাপ্য ছিল। ঠিক লোককেই বাছা হয়েছে।’’

এই বক্তব্যের মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই। অবাক করার মতো হচ্ছে, বিভিন্ন দেশে ক্রিকেট খেলা দেখে বেড়ানো অ্যাডিলেডের বাসিন্দা বলে দিলেন, ‘‘পূজারা যখন ৮৯, কট বিহাইন্ড ছিল। খুব হাল্কা করে ব্যাটে লেগেছিল। অস্ট্রেলিয়া অ্যাপিলটা করল, কিন্তু রিভিউটা নিল না। অ্যাডিলেডে বসে ৩১ রানে হার দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, রিভিউটা নিলে কে জানে অস্ট্রেলিয়া হয়তো জিতেও যেতে পারত।’’

এ রকম গভীর ক্রিকেটমনস্করা কিছুতেই মানতেন না প্রতারণার পরেও স্টিভ স্মিথ এবং ডেভিড ওয়ার্নারদের দলে রাখা হলে। এখনও সেই অপমানের ক্ষত রয়েছে। এক দর্শক যেমন মাঠ থেকে বেরোনোর সময় বলছিলেন, ‘‘যে দিন টিভি-তে সারা বিশ্ব দেখছিল, আমাদের এক ক্রিকেটার সিরিশ কাগজ দিয়ে বল ঘষছে, সেই দিনটার কথা ভাবুন। গোটা অস্ট্রেলিয়াকে আর কোনও ঘটনা এতটা নাড়িয়ে দিয়ে যেতে পারেনি। সেই দিনটার চেয়ে অ্যাডিলেড ওভালের এই সম্মানজনক হারের মুহূর্তটা ভাল।’’

এক-এক সময়ে বেশ আশ্চর্যই হয়ে যেতে হবে যে, এখনও কী রকম স্মিথ এবং ওয়ার্নার-বিরোধী হাওয়া বইছে গোটা অস্ট্রেলিয়া জুড়ে। অ্যাডিলেড হোক কি পার্‌থ, কেউ এখনও ক্ষমার চোখে দেখতে নারাজ। বিশেষ করে ওয়ার্নারকে। অ্যাডিলেড বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে এ দিনও কয়েক জন বললেন, ‘‘ওয়ার্নারকে আর কখনও অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলতে দেওয়া উচিত নয়। ঝুলিতে পচা আপেল ওটাই।’’ কে বলবে, এই ওয়ার্নারই আধুনিক প্রজন্মের সফলতম অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানদের এক জন! তারকার সিংহাসন থেকে ভূপতিত। আর কখনও হারানো সেই সম্মান ফিরে পাবেন কি না, সেটা নিয়েই অনিশ্চয়তা রয়েছে। আশ্চর্যের হচ্ছে, স্মিথের প্রতি ওয়ার্নারের চেয়ে সামান্য বেশি সহানুভূতি থাকলেও তাঁকে পুরোপুরি ক্ষমা করে দিতে নারাজ অস্ট্রেলীয় জনতা। ‘‘অস্ট্রেলীয় ক্যাপ্টেন কী করে প্রতারণার লজ্জাজনক এই অভিযানে স্বাক্ষর করে দিল? না, না, ওরা কেউ সাধু হতে পারে না,’’ এখনও বলে উঠছে ক্ষিপ্ত জনতা। সঙ্গে যোগ করছে, ‘‘ডারেন লেম্যান বলল, ও নাকি জানত না। একদম মিথ্যে কথা। তা হলে কোচ হয়ে বসে ছিল কেন?’’ কারও কারও কঠোর বার্তা— ‘‘স্মিথকে ফেরানো হোক, ওয়ার্নারকে নয়। কিন্তু স্মিথকে যেন কখনও অধিনায়কের মুকুট না দেওয়া হয়!’’ ট্রেভর চ্যাপেলের সেই কুখ্যাত আন্ডারআর্ম বোলিংয়ের সময়েও সম্ভবত এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার লাভা উদগীরণ ঘটেনি! যা দেখা যাচ্ছে বল-বিকৃতি কেলেঙ্কারি নিয়ে।

রিকি পন্টিং— যিনি ক্রিকেটজীবনে খুবই আগ্রাসী খেলোয়াড় এবং অধিনায়ক ছিলেন, তিনি টিভি-তে সরাসরি বলেছেন, বিরাট কোহালিকে থামাতে গেলে নরমসরম ক্রিকেট খেলে হবে না। ‘‘বিরাটের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হবে,’’ মনে করছেন পন্টিং। কিন্তু সেই চোখে চোখ রেখে কথা বলার মতো কাউকে এই অস্ট্রেলিয়া দলে দেখা যাচ্ছে না। মিচেল স্টার্কের মতো এক্সপ্রেস গতির পেসারকেও ন্যাতানো মনে হয়েছে। স্টার্ক ব্যাট হাতে লড়াই করলেও বোলিংয়ের সময়ে পেসার-সুলভ শরীরী ভাষাই দেখা যায়নি। পন্টিং, ওয়ার্নের মতো কিংবদন্তিরা বিশেষজ্ঞের ব্লেজার চাপিয়ে টিভি-র সামনে বসে সে সব ধরিয়ে দিতে ভুলছেন না।

পেনকে সরিয়ে যে অন্য কোনও নেতা বাছা হবে, সেই উপায়ই বা কোথায়? দলে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। উসমান খোয়াজার নাম কেউ কেউ বলছিলেন। কিন্তু তাঁর নেতৃত্বের গুণ নিয়ে নির্বাচকেরা নিশ্চিত নন। নতুন প্রথা তৈরি করে এ বার টেস্ট দলে দু’জন সহ-অধিনায়ক নিয়োগ করেছে অস্ট্রেলিয়া। এমনই অবস্থা যে, তাঁদের মধ্যে এক জন— মিচেল মার্শের অ্যাডিলেডের প্রথম একাদশেই জায়গা হয়নি। কেউ কেউ প্যাট কামিন্সের নাম নিচ্ছেন। দেশের দাবি মেনে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি থাকা ক্রিকেটার। কিন্তু পেস বোলার কেমন অধিনায়ক হবে, চিরকালের সেই সংশয় থেকে যাচ্ছে। দেখে বিস্ময়করই মনে হবে যে, ডন ব্র্যাডম্যান, রিচি বেনো, ইয়ান চ্যাপেল, অ্যালান বর্ডার, মার্ক টেলর, স্টিভ ওয়ের মতো চিরশ্রেষ্ঠ অধিনায়ক যে দেশ উপহার দিয়েছে, সেখানেই এখন নেতার আকাল। অস্ট্রেলিয়ার এক সাংবাদিক বলছিলেন, ‘‘টিম পেন অধিনায়ক না থাকলে হয়তো দলেই থাকত না। শুধু এক জন নেতা দরকার বলে ওকে বেছে নিতে হয়েছে।’’ ২০১০-এ অভিষেক ঘটেছিল পেনের। তার পরে হারিয়েই গিয়েছিলেন। ফিরলেন একেবারে অধিনায়ক হয়ে।

পেন সংকট আরও গভীর করে দিয়েছিলেন অ্যাডিলেডে মহম্মদ শামির বলে আঙুলে চোট লাগিয়ে। কিন্তু জাস্টিন ল্যাঙ্গার এ দিন বললেন, ‘‘পেন সাহসী এক চরিত্র। ও পার্‌থে খেলবে। ও-ই অধিনায়কত্ব করবে।’’ এই আঙুলেই সাত বার অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁর। অ্যাডিলেড থেকে পার্‌থ যাওয়ার পথে বিমানবন্দরে দাঁড়িয়েই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেন ল্যাঙ্গার। তাঁদের অধিনায়ককে নিয়ে বললেন, ‘‘বাচ্চা ছেলের মতো মুখের আড়ালে একটা নাছোড় পুরুষ আছে। আমি এত দৃঢ় মানসিকতা আর কারও দেখিনি।’’

স্টিভ ওয়ের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ার স্বর্ণযুগের একাদশের সদস্য ছিলেন ল্যাঙ্গার। কিন্তু তিনি জানেন, সেই অস্ট্রেলিয়াও নেই, সেই স্টিভও নেই। বাজার ঘুরে পাওয়া গিয়েছে টিম পেন, তা দিয়েই তো চালাতে হবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE