Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

আর্ত গলায় ফোন এল, ডেড বডি পড়ে আছে 

দুষ্কৃতী যখন গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে মসজিদের ভিতরে প্রার্থনারতদের, সেই সময়ে খুব কাছের হ্যাগলি পার্ক ওভাল মাঠ থেকে সেখানে নমাজ পড়তে এসেছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটারেরা। সতেরো জনকে নিয়ে বাস দাঁড়িয়েছিল মসজিদের সামনে

ঘটনাস্থলে নিরাপত্তা কর্মীরা। ছবি: এএফপি।

ঘটনাস্থলে নিরাপত্তা কর্মীরা। ছবি: এএফপি।

দেব চৌধুরী (বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিক)
ক্রাইস্টচার্চ শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৯ ০৪:২৪
Share: Save:

হ্যাগলি পার্ক ওভাল মাঠ থেকে হাঁটা পথের দূরত্বে আল নুর মসজিদ। শুক্রবার নিউজ়িল্যান্ডের সময় দুপুর একটা চল্লিশ থেকে (ভারতীয় সময় ভোর ছ’টা দশে) সেখানে যে হত্যালীলা চলল, বাংলাদেশের ক্রিকেটারেরাও তার মধ্যে পড়ে যেতে পারতেন। কপালজোরে তাঁরা বেঁচে গিয়েছেন।

দুষ্কৃতী যখন গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে মসজিদের ভিতরে প্রার্থনারতদের, সেই সময়ে খুব কাছের হ্যাগলি পার্ক ওভাল মাঠ থেকে সেখানে নমাজ পড়তে এসেছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটারেরা। সতেরো জনকে নিয়ে বাস দাঁড়িয়েছিল মসজিদের সামনে। স্টেডিয়াম থেকে সেই জায়গাটির দূরত্ব দেড় কিলোমিটারও হবে না। সকালে বৃষ্টি হচ্ছিল বলে ক্রিকেটারেরা দেরি করে মাঠে এসেছিলেন। কথা ছিল, নমাজ পড়ে আবার তাঁরা ফিরবেন মাঠে। তখন মাঠ শুকিয়ে আসবে, তাই অনুশীলনও করা যাবে।

বৃষ্টি খেলা ভন্ডুল করে দেয় বলে এত কাল কত লেখালেখি হয়েছে। কে জানত, বৃষ্টি ক্রিকেটারদের রক্ষাকর্তাও হয়ে দাঁড়াতে পারে! একটু আগে পৌঁছলেই তো গুলি চলার সময় মসজিদের ভিতরেই থাকতেন ক্রিকেটারেরা। আরও একটা ঘটনা মাথায় ঘুরছে। স্টেডিয়ামে এসে সাংবাদিক সম্মেলন করে নমাজ পড়তে যাওয়ার কথা ছিল ক্রিকেটারদের। কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলন করতে আসার সময়ে বাংলাদেশের অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াধ দেখলাম জাতীয় দলের টুপিটা পরেননি। আমিই ওঁকে বললাম, টুপিটা পরবেন না? তখন অধিনায়ক ফিরে গেলেন ড্রেসিংরুমে। আরও পাঁচ-সাত মিনিট পরে শুরু হল সাংবাদিক সম্মেলন। এখন মনে হচ্ছে, ছোটখাটো কিছু টুকরো ঘটনাই কখন যে জীবনদায়ী হয়ে উঠতে পারে!

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ক্রিকেটারেরা যখন মসজিদের সামনে পৌঁছন, তত ক্ষণে ধ্বংসলীলার অনেকটাই হয়ে গিয়েছে। জানাজানি হয়ে গিয়েছে, ভিতরে কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড চলছে। তাই ক্রিকেটারেরা তাঁদের সতর্ক করার জন্য কাউকে পেয়েছিলেন। বাস থেকে কয়েক জন ক্রিকেটার নেমে মসজিদে ঢুকতে যাবেন, সেই সময়েই এক ভদ্রমহিলা প্রথম দৌড়ে এসে তাঁদের সাবধান করে জানান, ভিতরে গুলি চলছে। ভিতরে যাবেন না।

আমি তখন মাঠে বসে। অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াধের সাংবাদিক সম্মেলন করে অফিসে ‘ফিড’ পাঠাব বলে সমস্ত কিছু গোছাচ্ছি। সেই সময়ে মোবাইলটা বেজে উঠল। ফোনটা এসেছিল বাংলাদেশের এক ক্রিকেটারের কাছ থেকে। তাঁর নামটা এখানে প্রকাশ করতে পারছি না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে, তাঁকে অনেক দিন ধরে চিনি। এ রকম উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর কখনও শুনিনি তাঁর গলায়। কোনও রকমে কাঁপতে কাঁপতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ভাই, আপনার কাছে লোকাল পুলিশের নম্বর আছে? এখানে মসজিদে খুব গোলাগুলি চলছে। দু’তিন জনের ডেড বডি পড়ে আছে।’’ পুলিশের নম্বর দেব কী, ফোনের ও প্রান্ত থেকে পরিচিত ক্রিকেটারের এমন কথা শুনেই তো হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এসেছিল।

বাসের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ দলের ১৭ জন। অফস্পিনার নইম হাসান, ব্যাটসম্যান লিটন দাস এবং স্পিন বোলিং কোচ, ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার সুনীল জোশী শুধু হোটেলে ছিলেন। ওই ভদ্রমহিলার সাবধানবাণী শোনার পরে সকলে হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে বাসের নীচে শুয়ে পড়েছিলেন। কিছুক্ষণ ও ভাবে শুয়ে থাকার পরে এক ক্রিকেটার (সম্ভবত তিনি বাংলাদেশের বাঁ হাতি ওপেনার তামিম ইকবাল) সাহস করে বলে ওঠেন, ‘‘এ ভাবে শুয়ে থাকলে যদি সেই দুষ্কৃতী বাসে উঠে আক্রমণ করে, তা হলে আমরা কেউ বাঁচব না। তার চেয়ে বরং চলো বাস থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করি।’’

তাঁর কথা শুনে সম্বিৎ ফেরে সকলের। বাস থেকে নেমে পড়িমড়ি করে পাশের হ্যাগলি পার্কের মধ্যে ঢুকে পড়েন। এই পার্ক থেকে মাঠের দূরত্ব এক কিলোমিটার মতো। কেউ পার্কের রাস্তা ধরে সোজা হাঁটতে থাকেন। কেউ উত্তেজনায় দৌড়তে থাকেন। টিম বাসকে ফেলে রেখে এ ভাবেই সকলে হ্যাগলি পার্ক ওভাল মাঠে ফিরে আসেন। পার্ক ধরে আসার সময় পুরো রাস্তা মুশফিকুর রহিম কাঁদতে থাকেন। তামিম খুব বিমর্ষ ছিলেন। তবু তিনিই সাহস দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

তামিম, মুশফিকরা পার্ক ধরে হেঁটে সোজা স্টেডিয়ামে ফিরে আসেন। দ্রুত তাঁদের ড্রেসিংরুমে নিয়ে গিয়ে সব দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তত ক্ষণে আমাদের আমাদের ‘লক’ করে দেওয়া হয়েছে স্টেডিয়ামের ক্যান্টিনে। সফরকারী সাংবাদিক, স্কাই স্পোর্টসের প্রতিনিধি, মাঠের কর্মী মিলিয়ে প্রায় জনা চল্লিশেক ব্যক্তি। দু’টোর সময় আমাদের ক্যান্টিনে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। যখন বের হলাম, বিকেল সাড়ে পাঁচটা বেজে গিয়েছে। ওখানে বসেই বুঝতে পারলাম, টেস্ট বাতিল হয়ে যাবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফেরাটাই এখন একমাত্র লক্ষ্য।

ক্রিকেটারেরা হোটেলে ফেরেন বাসে করেই। আমরা আটকে ছিলাম মাঠে। স্টেডিয়ামে কর্মরত অ্যাঞ্জেলিনা উদয় হলেন ‘অ্যাঞ্জেল’ হয়ে। ‘‘তোমাদের আমি বাংলাদেশ দলের হোটেলেই পৌঁছে দিচ্ছি এখন। ওই জায়গাটা নিরাপদ,’’ বলে তিনি গাড়িতে করে আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেলেন। নিউজ়িল্যান্ডের সময় রাত সাড়ে দশটাতেও আমরা টিম হোটেলে বসে। বাংলাদেশ দলের পক্ষ থেকে আমাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বিশেষ অনুমতি নিয়ে হোটেলের ভিতরে ঢুকে বসতে দেওয়া হয়। ক্রিকেটারদের অনেকের সঙ্গে কথা হল একে একে। তত ক্ষণে হত্যালীলার ভয়ঙ্কর ভিডিয়োগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। সেগুলো দেখে কেঁপে উঠছিলেন তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহরাও। শুনলাম, শনিবার দুপুরের উড়ানেই ঢাকা ফিরে যাচ্ছে দল। বিজনেস ক্লাসের টিকিট সকলের পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু ইকনমিতে বসে ফিরতেও আপত্তি নেই কারও।

হত্যাপুরীতে কে পড়ে থাকতে চায়!

(লেখক বাংলাদেশের নিউজ চ্যানেল টিভি একাত্তরের সিনিয়র রিপোর্টার। নিউজ়িল্যান্ডে চলতি সিরিজ কভার করছিলেন। শুক্রবার ছিলেন ক্রাইস্টচার্চের ঘটনাস্থলেই)।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE