কেনাকাটা: দেশে ফেরার পথে কলকাতায় বাংলাদেশের সুব্রত কাপ জয়ীরা। ময়দান মার্কেটে খুদে ফুটবলারেরা। মঙ্গলবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
কখনও মাঠ ঘেরাও হয়ে যেত। যাতে ফুটবলারেরা কোনও ভাবে বেরোতে না-পারে।
কোথাও জার্সি টেনে ধরে রাখত দর্শকেরা। কেন? যাতে ফুটবলারেরা মাঠেই নামতে না-পারে।
কোথাও ফুটবলের জন্য চেহারাই বদলাতেই হয়েছিল। যাতে বোঝা না-যায়, ছেলে না মেয়ে— কে খেলছে। না-হলে যে মাঠেই নামা যাবে না!
এদের সবার পরিচয় এক। এরা সবাই মেয়ে ফুটবলার। তবে ভারত বা এ-পার বাংলার নয়, ও-পার বাংলার। মাঠ এবং মাঠের বাইরে সমানে লড়াই করে যারা এগিয়ে চলেছে। যাদের মন্ত্র একটাই— কিছুতেই হার মানবো না।
আরও পড়ুন
প্রীতমদের হুগলিতে নেই মেয়েদের লিগ
হার যে তারা মানছে না, বাংলাদেশের ১৫-১৬ বছরের মেয়েগুলো তা বুঝিয়ে দিয়েছে ভারতের মাটি থেকে দেশকে ট্রফি এনে দিয়ে। সুব্রত কাপ ফুটবলে (মেয়েদের অনূর্ধ্ব ১৭) কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলার দল, সেমিফাইনালে স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়া এবং ফাইনালে হরিয়ানাকে ১-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)। এই নিয়ে পরপর দু’বার। ট্রফিজয়ী দল মঙ্গলবার দিল্লি থেকে প্রায় নিঃশব্দে কলকাতায় এসে পৌঁছল। মৌলালির রাজ্য যুব কেন্দ্রে বসে এ দিন দলের কোচ জয়া চাকমার মুখে মাঠের বাইরের যে লড়াইয়ের কাহিনি শোনা যাচ্ছিল, তা কম চিত্তাকর্ষক নয় মাঠের লড়াইয়ের থেকে।
আরও পড়ুন
‘আশা করি এই ইনিংসের পর ওরা আর সমালোচনা করবে না’
গত বছর সুব্রত কাপে ৪০ সেকেন্ডে গোল করে চমকে দিয়েছিল বছর তেরোর শাহেদা। কিন্তু ফুটবলের জন্য একটা সময় ছেলে সাজতে হয়েছিল তাকে। ‘দঙ্গল’ সিনেমায় কুস্তিগির বাবা মেয়েদের জোর করে চুল ছেঁটে দিয়েছিল। এখানে শাহেদা নিজেই সেই রাস্তা বেছে নিয়েছিল। কেন? জয়া বলছিলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকেই শাহেদা ফুটবল খুবই ভালবাসত। কিন্তু ছেলেরা ওকে খেলতে দিত না। বলত, মেয়েদের সঙ্গে ফুটবল খেললে আমাদের প্রেস্টিজ যাবে। তাই ও চুল ছেঁটে, ছেলে সেজে ওদের সঙ্গে খেলত। যাতে বাইরে থেকে কেউ বুঝতে না-পারে যে, একটি মেয়ে খেলছে।’’
সফল: ম্যানেজার লিটনের সঙ্গে কোচ জয়া (মাঝে)। নিজস্ব চিত্র
সময় বদলেছে। অতীতের চেয়ে কিছুটা সহজ হয়েছে পদ্মাপারের মেয়েদের ফুটবল জীবন। জয়া বলছিলেন, ‘‘আমি যখন খেলতাম, তখন এক বার স্টেডিয়াম ঘেরাও করা হয়েছিল। প্রায় তিন ঘণ্টা আটকে ছিলাম। পরে পুলিশ এসে বার করে নিয়ে যায়। আমাদের খেলার সময় মাঠে ঢিল পড়ত। মাঠে নামার আগে জার্সি টেনে ধরে রাখত। কিন্তু এত করেও আমাকে আটকে রাখা যায়নি। আমার মেয়েদেরও যাবে না।’’
এখন অবশ্য ঢিল পড়ে না। কিন্তু সামাজিক বা পারিবারিক রক্তচক্ষু এখনও আছে। উদাহরণ দিচ্ছিলেন জয়া। যেমন দলের অধিনায়ক সাদিয়া আখতার। যাকে বাড়ি থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল, ফুটবল খেলতে হবে না। পড়াশোনো চালিয়ে যাও। কিন্তু সে-সব কথা না-শুনে মেয়েটি প্রায় একার চেষ্টাতেই বিকেএসপি-তে এসে ট্রায়াল দিয়ে ভর্তি হয়। আছে ক্লাস সিক্সের রত্না খাতুন। সেরা ফুটবলার হয়েছে। যে এখন আর আবাসিক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে বাড়িই ফিরতে চায় না। ফুটবলকে ভালবেসে সব কিছু ছাড়তে তৈরি এই মেয়ে। ‘‘মেয়েদের সবার পিছনেই একটা না একটা কাহিনি আছে। কিছু আমরা জানি, কিছু জানি না,’’ বললেন জয়া।
বাংলাদেশে মেয়েদের ফুটবলের এই বিপ্লব যে সার্থক হচ্ছে বিকেএসপি-র জন্য, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই কোচ জয়া এবং দলের ম্যানেজার মহম্মদ শইদুল ইসলাম লিটনের। যে বিপ্লব যাবতীয় অন্ধকার মুছে আলোর রোশনাই এনে দিয়েছে এই কিশোরী ফুটবলারদের জীবনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy