বাড়িতে বসে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন সঞ্জয়। শুক্রবার। ছবি: উত্পল সরকার।
করিম বেঞ্চারিফার মোবাইল কোনও অজ্ঞাত কারণে একটাও ‘কল’ নিচ্ছে না।
আই লিগে মোহনবাগানের স্বপ্নের দৌড়ের গৌরবগাথা লিখতে বসলে ছয় বছর আগের কথা তো এসে পড়বেই। আর তখনই এসে পড়েন বাগানের প্রাক্তন মরক্কান কোচও। টানা দশ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড। যা সেই সময় ফোন করে শহরের নানা সংবাদপত্রের ফুটবল সাংবাদিকদের নিয়মিত মনে করাতেন করিম।
স্বপ্নের দৌড় তো শুরু করেছে সঞ্জয় সেনের বাগানও। পরিসংখ্যানবিদের তথ্য মানেই তাতে নানা চমকপ্রদ ব্যাপার। যেমন করিম বাগানে ধারাবাহিক সাফল্য পেয়েছিলেন লিগের মাঝপথে। সেখানে বঙ্গসন্তান সঞ্জয় লিগের শুরু থেকেই দৌড়ে টানা আট ম্যাচ অপরাজিত। যা কখনও হয়নি আই লিগে। না, মোহনবাগানের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বছরগুলোতেও নয়।
করিমের অপরাজিত থাকার দৌড় সে বার শেষ হয়েছিল ইস্টবেঙ্গলের সামনে পড়ে। বিশ্রী হেরে। রানার্স হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। সঞ্জয় সেনের সামনেও আবার সেই লাল-হলুদ জার্সি। নয় নম্বর ম্যাচে এসে। চাকা কি উল্টো দিকে ঘুরবে এ বার? অপরাজিত আখ্যা অটুট রাখতে পারবেন কাতসুমিরা?
“মোহনবাগানের শক্তি যেমন জানি, তেমন দুর্বলতাও। সেগুলো কাজে লাগিয়ে ম্যাচটা জিততে চাই।” শুক্রবার বিকেলে যখন শতবর্ষপ্রাচীন ক্লাবের লনে বসে প্রতিপক্ষ কোচ এলকো সতৌরি এই মন্তব্য করছেন, তখন তাঁর পাশেই বাগান কোচ। হঠাত্-ই সঞ্জয়ের মুখটা গম্ভীর। সামনের জলের বোতলের ছিপি খুলে ফেললেন যেন অজান্তে। তাকালেন মঞ্চেই বসে থাকা নিজের অন্যতম সেরা অস্ত্র পিয়ের বোয়ার দিকে।
“দেখুন, করিমের টিমটার সঙ্গে এই টিমের ফারাক অনেক। মোহনবাগানে সে বার ব্যারেটো, ভাইচুং। তারকা নির্ভর টিম ছিল। এ বার সে রকম নয়। এটা সত্যিই একটা টিম,” বলছিলেন সত্যজিত্ চট্টোপাধ্যায়। যিনি সেই ২০০৮-০৯ মরসুমে ছিলেন করিমের সহকারী কোচ। এখন সঞ্জয়ের দলের টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য। বহু ডার্বি জেতা-হারা সত্যজিতের অভিজ্ঞতার ঝাঁপি থেকে বেরোচ্ছে, “এই ম্যাচে যে আত্মবিশ্বাসী থাকে সে-ই জেতে। এ বার মোহনবাগান যত ম্যাচ জিতেছে, দেখবেন প্রত্যেকটাই মোটামুটি সহজে জিতেছে। এই জয়গুলোই আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।”
লিগ শীর্ষে মোহনবাগান। ইস্টবেঙ্গল পাঁচ নম্বরে। বহু দিন পর ডার্বির সময় আই লিগ টেবলের চেহারাটা এ রকম দেখাচ্ছে। আর প্রিয় ক্লাবের ট্রফি জয়ের গন্ধে যেন রথের মেলা বোয়া-সনিদের তাঁবু! সকাল-বিকেল টিকিট কাটার হুড়োহুড়ি। প্রবীণের পাশপাশি বেশি করে তাজা তরুণ মুখের ভিড়।
চুলে সবুজ-মেরুন ক্লিপ এঁটে কলেজ-বন্ধুদের সঙ্গে চলে এসেছেন সদ্য আঠারোয় পা, হাওড়া জগাছার সেবন্তী দাস। তাঁর বয়ফ্রেন্ডরা সনি-বোয়া নিয়ে এত কেন হইচই করেন স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছে। বাগানের জার্সির রঙের ক্লিপটা নাকি কিনে দিয়েছেন এক বন্ধুই।
মাথায় কাগজের তৈরি পাল তোলা নৌকো বেঁধে হুগলির ভদ্রকালীর এক ভ্যানচালক তো সাত সকালেই হাজির মাঠে। নৌকোয় মা কালী আর লোকনাথ বাবার ছবি। “যতই সনি-কাতসুমিরা গোল করুক, ইস্টবেঙ্গলকে হারাতে ভাগ্যও চাই। তাই বাবা-মাকে রেখেছি নৌকোয়,” বলেন কট্টর বাগান সমর্থক।
বাগান-লনের আমগাছগুলোয় এ বার প্রচুর মুকুল ধরেছে। লনের আড্ডায় বসে থাকা প্রবীণ সদস্যদের অনেকে বলছিলেন, “যে বার ক্লাবের গাছে প্রচুর আম হয় সে বার আমরা কিন্তু ট্রফি জিতি।” গত সাড়ে চার বছর তো ট্রফি নেই, তা হলে কি এত দিন মুকুল ধরেনি? পাল্টা প্রশ্নে থমকে যান ওঁরা। “মুকুল হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আম হয়নি,” বলেই হেসে ফেললেন এক জন।
বাগান কোচ সঞ্জয় সেনও জানেন ‘মুকুল’ আর ‘আম’ এক নয়। টানা আট ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড-টেকর্ড ঝরে যাবে যদি শনিবাসরীয় ডার্বি না জেতা যায়, ট্রফি যদি শেষমেশ সবুজ-মেরুন তাঁবুতে না ঢোকে। সে জন্যই টিমকে শশার মতো ঠান্ডা রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এক প্রয়াত বিখ্যাত বাগান রিক্রুটার যেমন থাকতেন ক্লাবের খারাপ সময়েও। “আমার কাছে অপরাজিত থাকাটাই আসল ব্যাপার। কাল জিতলে ভাল। ড্র হলেও ক্ষতি নেই। পয়েন্টের ফারাকটা তো থাকবেই,” বললেন সঞ্জয়।
বাগানের ‘আম্রমুকুল’ সমর্থকদের স্বস্তি দিলে, ইস্টবেঙ্গলকে সাহস যোগাচ্ছে সারদা কাণ্ডে অভিযুক্ত ক্লাবের অন্যতম প্রধান কর্তা নিতু সরকারের জামিন পাওয়া। এলকোর কোচিংয়ে খেলা টিমের সব ফুটবলারকেই যে লাল-হলুদে এনেছেন ‘নিতুদা’। “উনি যদি ড্রেসিংরুমে এসে উদ্বুদ্ধ করেন, টিম বাড়তি মোটিভেশন পাবে,” আশাবাদী লাল-হলুদ অধিনায়ক হরমনজ্যোত্ খাবরা। ডুডু থেকে র্যান্টি, এলকো থেকে অ্যালভিটোসবার মুখেই এই কথার প্রতিধ্বনি। যুবভারতীতে অনুশীলন হওয়ায় সমর্থকরা গরহাজির ছিলেন। বিকেলে ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে সামান্য ভিড় হয়েছিল।
বাগানের অনুশীলনে সেট পিস আর রক্ষণ সংগঠনে জোর দিয়েছেন সঞ্জয়। রক্ষণের নিয়মিত তিন ফুটবলারই হয় চোট, না হয় দেশের হয়ে খেলতে গিয়েছেন। প্রীতম, শৌভিক, ধনচন্দ্রদের জায়গা ভরাট করতে আনা হচ্ছে বেলো, আনোয়ার, সুখেনদের। বেলো-আনোয়ার শেষ বার স্টপার-জুটি হিসেবে সম্ভবত খেলেছিলেন মরসুমের শুরুর দুটো ম্যাচে। তার পর আজকের ডার্বিতে নামবেন। মাঝমাঠে ডেনসন ব্লকার খেললে কী হবে ভেবে আকুল বাগান সমর্থকরা। আনোয়ার ও ডেনসন দু’জনকেই শ্লথ দেখিয়েছে অনুশীলনে। কিন্তু সঞ্জয়ের হাতে বিকল্প অস্ত্রও নেই।
এলকোর ইস্টবেঙ্গলে চোট-আঘাত কম। অনেক বিকল্প ফুটবলার বিদেশি কোচের হাতে। ডাচ কোচের আবার চিন্তা তাঁর মাঝমাঠের বোহেমিয়ান আচরণ। কিন্তু ডাচ কোচের হাতে যে ‘পাশুপত’ও আছে র্যান্টি মার্টিন্স। কেমন? ইস্টবেঙ্গল এ বার লিগে ১৪ গোল করেছে। তার বারোটাই র্যান্টির। “মোহনবাগান ভাল খেলছে। সবার আগে আছে। অ্যাডভান্টেজ পজিশনেও আছে। তবে আমাদেরও টিম ভাল। ডেম্পোকে পাঁচ গোল দিয়েছি। ফরোয়ার্ডে ডুডু-র্যান্টি জুটি আছে,” বলছিলেন লাল হলুদ কোচ। এলকোর কথা শুনেই বোঝা যায় নতুন বাগান-রক্ষণ ভাঙার জন্য তাঁর বিদেশি স্ট্রাইকার জুটিকেই বুলডোজার পাঠাতে চান।
সঞ্জয় টিম সাজাচ্ছেন ৪-৪-১-১ ফর্মেশনে। এলকো ৪-৪-২ ডায়মন্ডে। ময়দান আর যুবভারতীতে দু’দলের অনুশীলন দেখে মনে হয়েছে, আগে নিজের ঘর বাঁচিয়ে অন্যের ঘর ভাঙার জন্য এগোতে চাইছেন দুই কোচই।
ভারতে এলকোর কোচিং অভিষেক সঞ্জয়কে সরিয়েই। ইউনাইটেডে দু’বছর আগের সেই স্মৃতি আজও টাটকা চেতলার বঙ্গসন্তানের। শনিবাসরীয় বিকেলে দেখার— এ বার কে কাকে সরিয়ে ডার্বি জয়ীর চেয়ারে বসেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy