Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

গঠনতন্ত্র নিয়ে কিন্তু চালাকি নয়

রাজ্য সংস্থাগুলোর সংবিধানে পরিবর্তন করা যে বাধ্যতামূলক, তা বোর্ডের নতুন নথিভুক্ত সংবিধানের ৩ (বি), ৬ (৫), ১৪ (৩), ১৪ (৪) ও ১৪ (৫) ধারা স্পষ্ট করে দিয়েছে।

চর্চায়: নতুন সংবিধান কেমন হতে চলেছে অপেক্ষায় সব কর্তারাই। ফাইল চিত্র

চর্চায়: নতুন সংবিধান কেমন হতে চলেছে অপেক্ষায় সব কর্তারাই। ফাইল চিত্র

ঊষানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৪:৪৬
Share: Save:

সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের যে সংবিধান অনুমোদন করেছে, তা নিয়ে সাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। ভারতীয় খেলাধুলোর আইন নিয়ে ৩০ বছর ধরে চর্চা করছি। এ ছাড়াও প্রায় ৪৫ বছর ধরে আইনের ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের অনুশাসনে বোর্ড ও তার অধীনস্থ রাজ্য সংস্থাগুলোর আবশ্যিক পরিবর্তনের নিঃস্বার্থ ভাবে ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

রাজ্য সংস্থাগুলোর সংবিধানে পরিবর্তন করা যে বাধ্যতামূলক, তা বোর্ডের নতুন নথিভুক্ত সংবিধানের ৩ (বি), ৬ (৫), ১৪ (৩), ১৪ (৪) ও ১৪ (৫) ধারা স্পষ্ট করে দিয়েছে। এ ছাড়া স্বচ্ছতা, স্বার্থের সংঘাতের অনুশাসন ও নির্বাচন আধিকারিক নিয়োগের নিয়মাবলীর শর্তাবলী অনুচ্ছেদ ৬, ৮ ও ৯-এ পূর্ণাঙ্গরূপে দেওয়া আছে, তাকে মান্যতা দেওয়া বাধ্যতামূলক। তবে ভারতীয় বোর্ডের মতো নির্বাচন আধিকারিক ও ন্যায়পাল নিয়োগের শর্তাবলী রাজ্য সংস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। লোঢা কমিটির সুপারিশ (অনুচ্ছেদ ১০) ও সুপ্রিম কোর্টের ১৮ জুলাই ২০১৬-র মান্যতার (অনুচ্ছেদ ৩৩) অনুসারে রাজ্য সংস্থার নির্বাচন আধিকারিক নিয়োগ করতে হবে। যিনি রাজ্য নির্বাচন কমিশনের প্রাক্তন আধিকারিক হবেন। ন্যায়পাল নিয়োগ করার ক্ষেত্রে কোনও সম্মানীয় ব্যক্তি, যাঁর শৃঙ্খলারক্ষার পদ্ধতি (ডিসিপ্লিনারি প্রসিডিং) সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। এই কয়েকটি আবশ্যিক বদল ছাড়া রাজ্য সংস্থার সংবিধানে পরিবর্তন অপ্রাসঙ্গিক।

অনেকেই আদালত নিযুক্ত ভারতীয় বোর্ডের কমিটি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটর্স (সিওএ)-এর চিঠির প্রেক্ষিতে বলছেন যে, রাজ্য সংস্থার সংবিধানকে বোর্ডের নতুন সংবিধানের প্রতিবিম্ব হতে হবে। আমি মনে করি, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তিকর। সুপ্রিম কোর্ট এমন কোনও নির্দেশ দেয়নি বা রাজ্য সংস্থাগুলোকে বলেনি, তাদের সংবিধানকে বোর্ডের সংবিধানের প্রতিবিম্ব হতে হবে। মহামান্য বিচারপতিগণ বিলক্ষণ জানেন যে, ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য সংস্থার সংবিধানও ভিন্ন ভিন্ন আইনের অনুশাসনে নথিভুক্ত। আর তাই এক-একটি সংস্থার নিয়মাবলিও আলাদা। এই কারণেই ভারতীয় বোর্ডের ৩ (বি) ধারায় পরিষ্কার ভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে, রাজ্য সংস্থাগুলোর বাধ্যতামূলক পরিবর্তন। শুধু তাই নয়, সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট জানিয়েছে, কী কী অনুশাসনের নির্দেশাবলির মান্যতা দিতে হবে। অর্থাৎ, প্রতিবিম্বে বিভ্রান্তি দূর করে স্বচ্ছতা ও নির্দেশাবলিকে মর্যাদা দেওয়া প্রয়োজন।

ভারতীয় বোর্ডের সংবিধানে ৩ (বি), ১ (৬), ৬ (৫), ১৪ (৩) ও ১৪ (৪) নির্দেশাবলি কী? যা রাজ্য সংস্থাগুলো মানতে বাধ্য? সংস্থার সঙ্গে যুক্ত কোনও ব্যক্তি, ক্লাব বা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের বয়স যদি ৭০ বছরের বেশি হয়, তা হলে তিনি ভোট দিতে বা প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না। এখানেই শেষ নয়। কোনও জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী, সরকারি কর্মচারি অথবা কোনও কর্মসমিতিতে পদাধিকারী হিসেবে নয় বছর পূর্ণ করেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। এ ছাড়াও ফৌজদারি মামলা চলেছে এমন কেউ-ই ভোট দিতে পারবেন না।

এই পরিস্থিতিতে বলা হচ্ছে, সদস্যদের ভোটদানে বাধা কোথায়? কোনও প্রতিষ্ঠান আর ক্লাব তো নিজেরা গাড়ি করে এসে ভোট দিতে পারে না। তাদের ক্রেনে করেও তুলে আনা হয় না। তাই ভোটদান হয় ব্যক্তির প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমেই। অর্থাৎ, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করা যাবে না।

সুপ্রিম কোর্ট গত ৯ অগস্ট ২০১৮-তে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে, কোনও অবস্থাতেই বিকল্প পথ অবলম্বন করা যাবে না। কোনও কোনও রাজ্য সংস্থাতে ‘বোর্ড অব ট্রাস্টি’ আছে। অথচ ট্রাস্ট ও সংস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন আইনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। যে মুহূর্তে রাজ্য সংস্থাগুলোতে ট্রাস্ট অন্তর্ভুক্ত হবে, তা কমিটি বলেই পরিগণিত হবে। সঙ্গে সঙ্গেই সদস্যেরা বিধিনিষেধের মধ্যে পড়ে যাবেন। ধরে নেওয়া যাক, বোর্ডের সংবিধানের প্রতিবিম্ব হতে হবে, তা হলে কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবেই বোর্ডের প্রতিবিম্ব করতে হবে। কোনও রকম সুবিধেজনক কারচুপি বা পরিবর্তন করা চলবে না।

এ বার ‘কুলিং অফ’ নিয়ে আলোচনা করা যাক। কোনও পদাধিকারী বা পরিচালন সমিতির সদস্য একটানা ছয় বছরের বেশি থাকতে পারবেন না। তিন বছর বাইরে থাকার সময়ে এমন কিছু করা যাবে না, যাতে তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে রাজ্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। শুধু তাই নয়, কোনও রকম সুবিধেজনক উপস্থাপনা করা যাবে না, যাতে বিকল্প উপায়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে রাজ্য সংস্থায় থাকা যায়। উপরোক্ত ছয় বা মোট নয় বছরের গণনা অতীত ও বর্তমানের যোগ হিসেবে ধরা হবে।

সামগ্রিক স্বচ্ছতার ব্যাপারেও স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে বোর্ডের সংবিধানে। ৩৭-৪০ ধারার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সংস্থার যাবতীয় সিদ্ধান্ত, খরচ ও চুক্তি ওয়েবসাইটে দেওয়া বাধ্যতামূলক। যাতে সাধারণ নাগরিক যে কোনও বিষয়ে এথিক্স অফিসার বা ন্যায়পালের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন। এ ছাড়াও কোনও রকম স্বার্থের সংঘাত থাকা চলবে না। অর্থাৎ, সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা, কোনও পদে বা কোনও ভাবে একটানা থাকা, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনও কোনও রাজ্য সংস্থা ভ্রান্ত ধারণায় তাদের ‘মেমোরেন্ডাম’ পরিবর্তনও করতে যাচ্ছে।

এক–এক রাজ্যের সংস্থা আলাদা আইনে নির্দেশিত। সুপ্রিম কোর্ট কোথাও রাজ্য আইনের বিরোধিতার কথা বলেনি। পশ্চিমবঙ্গে সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন আইনে কোনও মেমোরেন্ডাম পরিবর্তন করতে হলে রেজিস্টার অফ সোসাইটির পূর্ব সম্মতি বাধ্যতামূলক। সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কোনও মেমোরেন্ডামের কোনও অংশ রাজ্য সংস্থার সদস্যেরা খুশি মতো পরিবর্তন করতে পারেন না। আশা করছি, সব রাজ্য সংস্থাই ব্যক্তি বিশেষের ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিষ্ঠানের সম্মান, গৌরব ও ক্রিকেটের উন্নতির স্বার্থে এগিয়ে আসবে।

(লেখক ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রাক্তন প্রধান আইনি উপদেষ্টা)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE