নির্মম: ভয়ঙ্কর বাউন্সার এড়াচ্ছেন উমেশ। সোমবার পার্থে। এএফপি
শুধু সিরিজে সমতা ফেরানোই নয়। দু’দলের ক্রিকেটারদের সম্পর্ককেও সম্ভবত তিক্ত করে দিয়ে গেল পার্থ। এমনিতেই দু’দলের মধ্যে স্লেজিংকে কেন্দ্র করে তর্ক-বিতর্ক চলছিলই। তার উপরে ম্যাচের শেষ দিনে অস্ট্রেলিয়ার বডিলাইন বোলিং সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটিয়ে দিয়ে থাকলে অবাক হওয়ার নেই।
সকালে উমেশ যাদবকে করা মিচেল স্টার্কের একটি ওভার বিশেষ করে পরিস্থিতি জটিল করে দিয়ে গেল। স্টার্ক রাউন্ড দ্য উইকেট এসে ইচ্ছাকৃত ভাবে উমেশের শরীর আর মাথা লক্ষ্য করে বল করতে থাকলেন। এক বার উমেশের কাঁধে লাগল। কোনওক্রমে মুখ বাঁচালেন। আর এক বার হেলমেটে লাগতে লাগতে বাঁচলেন। সেই ওভারেই শরীরের দিকে ছুটে আসা বাউন্সারে কট অ্যান্ড বোল্ড হয়ে গেলেন।
এখানেই শেষ নয়, ভারতের শেষের দিককার ব্যাটসম্যানদের জন্য ডগলাস জার্ডিনকে মনে করিয়ে কুখ্যাত লেগসাইড ফিল্ডিংও সাজালেন টিম পেন। উইকেটের পিছন থেকে তাঁর বোলারদের বডিলাইন বোলিং করার ব্যাপারে তাতিয়েও গেলেন। আর স্টার্ক, কামিন্সরা বাউন্সার বৃষ্টি চালিয়ে গেলেন। শেষের দিককার ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের দেখা গেল আত্মরক্ষার জন্য সরে গিয়ে খেলছেন। ভারতের হাতে এখন দারুণ সব ফাস্ট বোলার থাকলেও স্টার্ক বা কামিন্স এখনও গতি এবং বাউন্সে এগিয়ে। স্টার্ক এ দিন নিয়মিত ভাবে ঘণ্টায় প্রায় ১৫০ কিলোমিটার গতিবেগে বল করে যাচ্ছিলেন। কামিন্সও তাই। উমেশ, ইশান্তরা মোটেও স্বস্তিতে ছিলেন না।
অস্ট্রেলিয়া শিবির এর মধ্যে অন্যায়ের কিছু দেখছে না। অবশ্যই বাউন্সারের জবাবে বাউন্সার দিয়েছে তারা। নেথান লায়ন ব্যাট করতে আসার পরে তাঁর হেলমেটে শামির বাউন্সার লেগেছে। যশপ্রীত বুমরা, উমেশ যাদবরা অস্ট্রেলিয়ার টেলএন্ডারদের বাউন্সার দিতে ছাড়েননি। সেটাই তাঁরা এ দিন ফেরত পাচ্ছিলেন। কিন্তু চতুর্থ দিন পর্যন্ত তবু একটা সৌজন্যতা বোধ লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। লায়নের হেলমেটে লাগার পরে শামি গিয়ে তাঁকে আন্তরিক ভাবেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, ঠিক আছেন কি না। লায়ন হাত নেড়ে বলেন, সব ঠিক আছে। এ দিন উমেশের কাঁধে লাগার পরে স্টার্ককে সে রকম কিছু করতে দেখা যায়নি।
সকালে ভারতীয় ইনিংসের বাকি পাঁচ উইকেট মাত্র ৬৫ মিনিটের মধ্যে ১৫ ওভারেই তুলে নেয় অস্ট্রেলিয়া। ২৮৭ রানের টার্গেটের সামনে ১৪০-এই শেষ হয়ে যায় ভারত। হনুমা বিহারী আউট হতেই বোঝা গিয়েছিল, অস্ট্রেলিয়ার জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। কয়েকটি শট মেরে ঋষভ পন্থও আউট হয়ে গেলেন। কিন্তু সব চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে দিয়ে গেল বডিলাইন বোলিং। ভারতীয় টেলএন্ডারদের রীতিমতো আতঙ্কিত করে দিয়ে গেলেন স্টার্ক, প্যাট কামিন্সরা। অতীতে ক্রিকেট খেলায় একটা অলিখিত চুক্তি থাকত ফাস্ট বোলারদের মধ্যে। অনেক ক্ষেত্রেই টেলএন্ডারদের কেউ বাউন্সার দিতেন না। এখন সে সবের বালাই নেই। আরও অস্বস্তিকর হচ্ছে, ফিল হিউজ ট্র্যাজেডির পরে নানা সাবধানতার কথা বলা হলেও ক্রিকেট যে সেই হিংসাত্মক খেলাই রয়ে গিয়েছে, সেই উগ্র ছবিটাও ধরা পড়ল পার্থে। বার বারই স্পষ্ট হয়ে হিয়েছে, ইচ্ছাকৃত ভাবে আঘাত করার জন্য বোলাররা বাউন্সার ব্যবহার করছেন। কখনও কখনও একেবারে ব্যাটসম্যানের শরীর বা মাথা তাক করে গোলার মতো বল ছুটছে। বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে হলে তা-ও ঠিক আছে। তাঁদের সেই গতি এবং বাউন্স সামলানোর মতো দক্ষতা থাকে। কিন্তু নীচের দিককার ব্যাটসম্যানরা ফাস্ট বোলিং খেলার জন্য অতটা পোক্ত হন না। তাঁদের ক্ষেত্রে আঘাত লাগার আশঙ্কা বেশি থাকে। এক-এক সময় মনে হচ্ছিল, স্লেজিংয়ের চেয়েও বিপজ্জনক এই বাউন্সার বিনিময়ের খেলা। কথার যুদ্ধে কারও প্রাণহানির ভয় নেই। কিন্তু টেলএন্ডারদের মাথা লক্ষ্য করে যে রকম বাউন্সার-বৃষ্টি চলছে, তাতে না আবার বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যায় ক্রিকেটে!
দেখে কে বলবে, ক্রিকেট থেকে এখনও ফিল হিউজের ছায়া চলে যায়নি! ম্যাচের সেরা নেথান লায়ন এ দিন জানিয়েছেন, ড্রেসিংরুমে হিউজকে স্মরণ করার অভিনব পন্থা বের করেছেন তাঁরা। নিজেরাই নিজেদের দল থেকে প্রত্যেক ম্যাচের সেরা বেছে নিচ্ছেন। তাঁকে ৪০৮ লেখা সোনালি ব্লেজার উপহার দেওয়া হচ্ছে। পরের ম্যাচে তিনি আবার অন্য কাউকে সেই ব্লেজার পরিয়ে দেবেন। লায়ন অ্যাডিলেডে এই ব্লেজার পেয়েছিলেন দলের কাছ থেকে। ‘‘হিউজি চলে যাওয়ার পর থেকে এটা আমরা চালু করেছি,’’ অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যমে বলেছেন লায়ন। শুনতে-শুনতে মনে হবে, চোখের সামনে এমন একটি ঘটনা থাকা সত্ত্বেও ক্রিকেট তার নির্মমতার জায়গা থেকে এতটুকু সরেনি।
মেলবোর্নে কী অপেক্ষা করছে? কোহালি বলে গেলেন, তাঁদের কাছে পার্থ অতীত হয়ে গিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া তাঁদের চেয়ে ভাল ক্রিকেট খেলেছে, ধারাবাহিকতা দেখিয়েছে তাই তারা জিতেছে। ‘‘আমাদের মাথায় এখন মেলবোর্ন। এই টেস্ট থেকে বেরিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে চাই,’’ বললেন ভারত অধিনায়ক। বল-বিকৃতি কেলেঙ্কারির পরে এই প্রথম টেস্ট জিতল অস্ট্রেলিয়া। টিম পেনরা মেলবোর্ন যাচ্ছেন, এই বিশ্বাস নিয়ে যে, বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট টিমকে তাঁরা হারাতে পারেন।
এই সিরিজের পূর্বাভাসের মতো অস্ট্রেলিয়া আর দুর্বল অস্ট্রেলিয়া নয়। ভারতও আর ফেভারিট নয়। মেলবোর্নে সম্ভবত বছরের সব চেয়ে এসপার-ওসপার ম্যাচ কোহালিদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy