Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

সচিন-যুগকে মনে করিয়ে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন কিং কোহালি

ছিয়ানব্বইয়ের লর্ডসে একই সঙ্গে উদয় ঘটেছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং রাহুল দ্রাবিড়ের। তার পরে বীরেন্দ্র সহবাগ, ভি ভি এস লক্ষ্মণ। তৈরি হল টিম ইন্ডিয়া। তার আগে পর্যন্ত নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ভারতীয় ব্যাটিং মানে ছিল শুধুই সচিন-নির্ভর ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’।

লড়াই: ভারতের বিপদে আবার ত্রাতার ভূমিকায় তিনি। শনিবার পার্‌থে আট রানে দুই উইকেট পড়ার পরে নামছেন বিরাট কোহালি। টুইটার

লড়াই: ভারতের বিপদে আবার ত্রাতার ভূমিকায় তিনি। শনিবার পার্‌থে আট রানে দুই উইকেট পড়ার পরে নামছেন বিরাট কোহালি। টুইটার

সুমিত ঘোষ
পার্থ শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:৪৯
Share: Save:

১০-২!

কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী— একটা সময়ে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া সেই স্কোরলাইন। যখন ধরে নেওয়া হত ভারত ব্যাট করতে নামছে মানে দু’তিন ওভারের মধ্যে দুই ওপেনারের ভবলীলা সাঙ্গ হবে। আর তার পরেই প্যাভিলিয়নের সিড়িতে দেখা যাবে বিস্ময় বালকের ছায়া। ভারতের জন্য ম্যাচটা আসলে শুরু হত দুই উইকেটে ১০ রান দিয়ে। যখন কোনও এক সচিন রমেশ তেন্ডুলকর ক্রিজে আসতেন। বলাই হত, সচিন যত ক্ষণ, শ্বাস তত ক্ষণ!

ছিয়ানব্বইয়ের লর্ডসে একই সঙ্গে উদয় ঘটেছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং রাহুল দ্রাবিড়ের। তার পরে বীরেন্দ্র সহবাগ, ভি ভি এস লক্ষ্মণ। তৈরি হল টিম ইন্ডিয়া। তার আগে পর্যন্ত নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ভারতীয় ব্যাটিং মানে ছিল শুধুই সচিন-নির্ভর ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’। গোটা ক্রিকেট বিশ্ব জানত, ভারত আসলে ১০-২ টিম আর তার পর তেন্ডুলকর আউট মানে ম্যাচ থেকে তারাও ‘আউট’। ওয়াসিম আক্রম এক বার বলেছিলেন, ‘‘যখনই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ হত, আমাদের টিম মিটিংয়ের সিংহ ভাগ জুড়ে থাকত এক জনই ক্রিকেটার। কী ভাবে সচিনের উইকেটটা তোলা হবে, সেটা নিয়েই কেটে যেত অর্ধেক মিটিং। আমরা জানতাম, এক জনকে সরাতে পারলেই কেল্লা ফতে।’’

সচিন-উত্তর যুগেও মনে হচ্ছে, ভারতীয় দল ১০-২ স্কোরের টিমে ফিরে গিয়েছে। এ বার তাদের রক্ষা করার জন্য কোনও মাস্টারব্লাস্টার নেই, তবে এসে গিয়েছেন কিং কোহালি! এখনকার দুই ওপেনার এম বিজয় এবং কে এল রাহুলের উপরে আশা-ভরসা রাখা মানে ধরে নেওয়া যে, চেন্নাইয়ে গরম পড়বে না, চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হবে না! পার্‌থের নতুন স্টেডিয়ামে ১০-২ স্কোরও হওয়ার দরকার পড়ল না। ৮ রানেই দুই স্টাইল-ভাই ওপেনার বিদায় নিলেন।

আরও পড়ুন: অবিশ্বাস্য সংযম দেখলাম বিরাটের ব্যাটিংয়ে: মঞ্জরেকর

এক জন শরীরের ট্যাটু আর চুল-দাড়ির দিকে যা সময় দেন, তার অর্ধেক মনঃসংযোগও যদি ক্রিজে দাঁড়িয়ে ব্যাট হাতে করতেন! ইনি কে এল রাহুল। চার বা পাঁচ টেস্টের সিরিজে তিনটে টেস্ট চলে যাবে তাঁর আড়মোড়া ভাঙতে। বাইশ গজে সংযম-শৃঙ্খলাই নেই, তিনি কীসের সুনীল গাওস্করের দেশের ওপেনার? অন্য জন এম বিজয়। তিনিও ব্যাটিংয়ের চেয়ে চুলের স্টাইলে বেশি চমকে দিতে ভালবাসেন। মাঝে পনিটেল রেখেছিলেন। এই সিরিজের জন্য সম্ভবত হেয়ারড্রেসার বৈচিত্র আনতে বলেছেন। স্কোরে অবশ্য কোনও বৈচিত্রের বালাই নেই। সেই টেলিফোন নম্বরের মতোই দেখাচ্ছে রানগুলো। ইংল্যান্ডে মাঝপথে বসিয়ে দেওয়া এবং সফর থেকে বাতিল হওয়ার পরেও আবার এখানে কেন ফেরানো হল, কে জানে! নাকি ভারতীয় ক্রিকেটের অন্দরমহলে দক্ষিণী প্রভাব ‘শেষ হইয়াও হয় না শেষ’! না হলে ঘরোয়া ক্রিকেটে ঝুড়ি ঝুড়ি রান করেও ময়াঙ্ক আগরওয়ালের মতো উঠতি তরুণের সুযোগ না পাওয়ার কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে?

আরও পড়ুন: ওপেনারদের ব্যর্থতায় খোঁজ পড়েছে পৃথ্বীর

দুই স্টাইল ভাই ওপেনার বিদায় নিলেন অস্ট্রেলীয় বোলারদের বেশি পরিশ্রম-টরিশ্রম না করিয়ে। প্যাভিলিয়নের সিঁড়িতে উদয় হলেন সচিনের উত্তরসূরি। তাঁর ব্যাট করতে নামার দৃশ্যটা হলিউডের নায়কদের ‘অ্যাপিয়ারেন্স সিন’কেও হার মানাতে পারে। ভিভ রিচার্ডসের পর এতটা আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে ক্রিজের দিকে এগিয়ে যেতে আর কাউকে দেখা যায়নি। ভিভ নামতেন অদ্ভুত এক শীতল ঔদ্ধত্য নিয়ে। নৃত্যের তালে তালে এগিয়ে চলেছে পেটানো শরীর। প্রতিপক্ষের দিকে খুনে দৃষ্টি। শক্ত চোয়ালে চুইংগাম চিবনোর মধ্যে যেন বোলারদের বলতে চাওয়া— তোদেরও এ ভাবেই চিবিয়ে চিবিয়ে খাব এ বার।

কোহালি দুলকি চালে হাঁটেন না। বাউন্ডারি লাইন পেরিয়ে প্রণাম করেই শূন্যে ব্যাট ঘোরাতে ঘোরাতে ছুটতে ছুটতে ঢোকেন। তখন তাঁকে দেখে মনে হয় না কোনও ব্যাটসম্যান ক্রিজে ঢুকছেন, মনে হয় কোনও বীর যাচ্ছেন যুদ্ধক্ষেত্রে তরোয়াল হাতে জয় করতে। ভিভের মতোই প্রতিপক্ষের জন্য সতর্ক বার্তা— স্কোরবোর্ড যা বলে বলুক, আমি এসেছি তোদের বধ করতে!

এ রকম সবুজ ঘাসে মোড়া পিচে ব্যাটসম্যানদের বুক ধুকপুক করার কথা। যত রকম সুরক্ষা নেওয়া যায়, নিয়ে রাখার কথা ভাববেন যে কেউ। চেতেশ্বর পুজারাদের মতো কোহালি কখনও আর্ম গার্ড পরেন না। পার্‌থের এই আগুনে পিচেও তা পরার ধার ধারলেন না। সব চেয়ে আশ্চর্য করে দিলেন অস্ট্রেলীয় পেসারদের খেলার জন্য এখানেও ক্রিজের অনেকটা বাইরে দাঁড়িয়ে!

এই স্ট্র্যাটেজি নিয়ে চার বছর আগে মিচেল জনসনকে পিটিয়েছিলেন কোহালি। কিন্তু পার্‌থের এমন দুর্ধর্ষ বাউন্স আর গতিসম্পন্ন পিচে যে তিনি বাইশ গজকে আঠারো গজ করে নিয়ে দাঁড়াবেন, কেউ ভাবতে পারেনি। অস্ট্রেলিয়ার সম্প্রচারকারী চ্যানেলগুলোতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে সব কিংবদন্তি বসছেন। কোনও বক্স থেকে বেরোচ্ছেন রিকি পন্টিং তো কোনওটা থেকে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। একটু দূরে বসে আছেন অ্যালান বর্ডার। এ দিন শেন ওয়ার্নকে দেখা গেল না। কিন্তু কানে ফোন লাগিয়ে তাঁর দীর্ঘকায় এক প্রাক্তন পেসার-সতীর্থকে দেখা গেল— গ্লেন ম্যাকগ্রা। যে দিকে চোখ যায়, বিশ্বকাপজয়ীর ছড়াছড়ি।

কোহালির ব্যাটিংয়ে তাঁদেরও মন্ত্রমুগ্ধ দেখাল। মিডিয়া সেন্টারের টিভিতে তখন দেখাচ্ছে কোহালি এই পিচেও ক্রিজের কতটা বাইরে দাঁড়িয়েছেন। এই অস্ট্রেলিয়া দলে অন্তত দু’জন পেসার রয়েছেন, যাঁরা ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতিবেগে বল করতে পারেন। বিশ্বের দ্রুততম বোলারদের মধ্যে পড়েন তাঁরা। মিচেল স্টার্ক এবং প্যাট কামিন্স। ক্রিজে এসে দ্বিতীয় বলেই জশ হেজলউডকে দর্শনীয় অন ড্রাইভ। ডন ব্র্যাডম্যানের অ্যাডিলেড ধিক্কার ধ্বনি দিয়েছিল। অন ড্রাইভটার পরে দেখা গেল লিলির পার্‌থ উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। পন্টিং আর গিলক্রিস্টও মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকলেন। যখন ব্যাট করতে নামলেন, তখন শুধু স্কোরবোর্ডেই অন্ধকার নয়। মাথার উপরে আকাশও কালো করে এসেছে। অস্ট্রেলিয়ার তিন পেসার সেই আবহাওয়ার সদ্ব্যবহার করে শিকারি বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে তৈরি। কোহালি তাঁদের বিরুদ্ধে শুরু করলেন আক্রমণাত্মক ভাবে, কিন্তু চেতেশ্বর পূজারা আউট হওয়ার পরে বিপদ বুঝেই সাবধানী হয়ে নিজেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ফেললেন।

দিনের শেষে তিনি ১৮১ বলে ৮২ অপরাজিত। সঙ্গী অজিঙ্ক রাহানে অস্ট্রেলীয় বোলারদের পাল্টা আক্রমণের রণনীতি নিয়ে ১০৩ বলে ৫১ অপরাজিত। দু’জনে অবিচ্ছিন্ন চতুর্থ উইকেটে ৯০ রান যোগ করে ফেলেছেন। এর পরেও ভারত পিছিয়ে ১৫৪ রানে। অর্থাৎ, দিল্লি এখনও বহু দূর। রবিবার সকালেও কোহালি-রাহানের পরীক্ষা চলবে। যদি সত্যিই লম্বা পার্টনারশিপ গড়ে ম্যাচের রং পাল্টে দিতে পারেন তাঁরা, ইডেনের মতো মহাকাব্যিক হয়ে উঠতে পারে ডেনিস লিলির পার্‌থ।

দিনের শেষে কোহালি ব্যাট তুলে অভিবাদন নিতে নিতে ফিরছেন, তাঁর মাথার উপর দিয়ে দুলছে তেরঙ্গা, ভারতীয় ড্রেসিংরুমের সামনে দেখা গেল প্রত্যেক ক্রিকেটার উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছেন। হেড কোচ রবি শাস্ত্রী পিঠ চাপড়ে দিলেন। গর্বিত ভারত অধিনায়ক ঢুকে গেলেন ড্রেসিংরুমে। চ্যালেঞ্জ ভালবাসেন কোহালি। যত কঠিন পরিস্থিতি, তত শক্ত হয়ে ওঠে তাঁর চোয়াল।

৮-২ হোক কী ১৭২-৩, ভারতীয় ক্রিকেট জনতার নতুন স্লোগান— বুরা না মানো কোহালি হ্যায়!

স্কোরকার্ড
অস্ট্রেলিয়া ৩২৬
ভারত ১৭২-৩ (৬৯)

অস্ট্রেলিয়া (প্রথম ইনিংস ২৭৭-৬-এর পর)
টিম পেন এলবিডব্লিউ বুমরা ৩৮
প্যাট কামিন্স বো উমেশ ১৯
মিচেল স্টার্ক ক পন্থ বো ইশান্ত ৬
নাথান লায়ন ন আ ৯
জশ হেজলউড ক পন্থ বো ইশান্ত ০
অতিরিক্ত ১৯
মোট ৩২৬
পতন: ১-১১২ (ফিঞ্চ, ৩৫.২), ২-১৩০ (খোয়াজা, ৪৫.৬), ৩-১৩৪ (হ্যারিস, ৪৮.২), ৪-১৪৮ (হ্যান্ডসকম্ব, ৫৪.১), ৫-২৩২ (মার্শ, ৭৬.৬), ৬-২৫১ (হেড, ৮২.১), ৭-৩১০ (কামিন্স, ১০৪.৬), ৮-৩১০ (পেন, ১০৫.২), ৯-৩২৬ (স্টার্ক, ১০৮.২), ১০-৩২৬ (হেজলউড, ১০৮.৩) ।
বোলিং: ইশান্ত শর্মা ২০.৩-৭-৪১-৪, যশপ্রীত বুমরা ২৬-৮-৫৩-২, উমেশ যাদব ২৩-৩-৭৮-২, মহম্মদ শামি ২৪-৩-৮০-০, হনুমা বিহারী ১৪-১-৫৩-২, মুরলী বিজয় ১-০-১০-০।
ভারত (প্রথম ইনিংস)
কে এল রাহুল বো হেজলউড ২
মুরলী বিজয় বো স্টার্ক ০
পূজারা ক পেন বো স্টার্ক ২৪
বিরাট কোহালি ব্যাটিং ৮২
অজিঙ্ক রাহানে ব্যাটিং ৫১
অতিরিক্ত ১৩
মোট ১৭২-৩
পতন: ১-৬ (বিজয়, ২.৬), ২-৮ (রাহুল, ৫.১), ৩-৮২ (পূজারা, ৩৮.২)।
বোলিং: মিচেল স্টার্ক ১৪-৪-৪২-২, জশ হেজলউড ১৬-৭-৫০-১, প্যাট কামিন্স ১৭-৩-৪০-০, নেথান লায়ন ২২-৪-৩৪-০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE