Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বিতর্ক আর বিরাট-বাণে বিদ্ধ পার‌্‌থের সবুজ দৈত্য

মাঝখানের বাইশ গজের সঙ্গে সবুজ মাঠকে যে আলাদা করাই যাচ্ছে না! এতটাই ঘাস ছেড়ে রাখা হয়েছে উইকেটে। মেলবোর্নের মতোই অতিকায় স্টেডিয়ামের এক কোণ থেকে অন্য কোণে যেতে পথ হারিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের পর্যন্ত দেখা গেল নিজেদের ড্রেসিংরুমে ঢোকার দরজা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। 

পরীক্ষা: পার্‌থের সবুজ উইকেট খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালি। গেটি ইমেজেস

পরীক্ষা: পার্‌থের সবুজ উইকেট খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালি। গেটি ইমেজেস

সুমিত ঘোষ 
পার্থ শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:১৩
Share: Save:

ডেনিস লিলির শহরে নতুন স্টেডিয়ামের পিচ নিয়ে যত আলোচনা। কিন্তু কোনটা পিচ? বৃহস্পতিবার সোয়ান নদীর অন্য পারে স্পনসর নামাঙ্কিত বিশাল মাঠে দাঁড়িয়ে সেটাই গুলিয়ে গেল।

মাঝখানের বাইশ গজের সঙ্গে সবুজ মাঠকে যে আলাদা করাই যাচ্ছে না! এতটাই ঘাস ছেড়ে রাখা হয়েছে উইকেটে। মেলবোর্নের মতোই অতিকায় স্টেডিয়ামের এক কোণ থেকে অন্য কোণে যেতে পথ হারিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের পর্যন্ত দেখা গেল নিজেদের ড্রেসিংরুমে ঢোকার দরজা খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

তেমনই নতুন মাঠে টেস্ট বোধনের লগ্নে পিচকেও সবুজ মখমলের মতো আউটফিল্ডের থেকে আলাদা করা কঠিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ দিন সব চেয়ে বেশি করে ছড়িয়ে পড়েছে পার্‌থের নতুন বাইশ গজের ছবি। সেখানেও সকলের একটাই প্রতিক্রিয়া— কোনটা পিচ? আলাদাই তো করা যাচ্ছে না! ক্রিকেট দ্বৈরথের নতুন মঞ্চের নামকরণও করা হয়ে গিয়েছে— সবুজ দৈত্য। শুক্রবার থেকে যা ব্যাটসম্যানদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য তেড়ে আসছে বলে ধরে রাখা যায়।

কিন্তু নতুন পার্‌থ পিচে প্রথম টেস্টের একটাও বল হওয়ার আগেই তাকে ঘিরে তুমুল বিতর্ক আর মত-পাল্টা মত তৈরি হয়ে গিয়েছে। দু’দলের দুই অধিনায়ক বিরাট কোহালি এবং টিম পেনের মতোই সকলের নজরে নতুন স্টেডিয়ামের প্রধান পিচ প্রস্তুতকারক ব্রেট সিপথর্প। দ্রুতগামী উইকেট বানানোয় স্পেশালিস্ট তিনি। নিউজিল্যান্ডে বেসিন রিজার্ভের উইকেট বানাতেন। সেখান থেকে ওয়াকার চরিত্র না পাল্টে ‘ড্রপ-ইন’ পিচ তৈরির জন্য আনা হয়েছে।

গত তিন দিন ধরে একের পর এক ইন্টারভিউয়ের অনুরোধ আসছে তাঁর কাছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সিপথর্পকে দিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে সাংবাদিক সম্মেলন করানো হল। কিন্তু তার আগেই ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় একটি সংবাদপত্রকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে সিপথর্প দাবি করেছেন, অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড থেকেই নাকি তাঁর কাছে নির্দেশ এসেছে ভয় ধরানো ফাস্ট পিচ বানানোর। পুরনো সেই অস্ট্রেলীয় ঔদ্ধত্য এবং নির্মমতার ছোঁয়া রেখে সিপথর্প সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘ওরা (অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড) চায় এমন পিচ যেখানে বল উড়বে। এটা তাই আমার কাছে আগাম ক্রিসমাস গিফ্‌টের মতো হতে যাচ্ছে। বল উড়ে উড়ে যাচ্ছে আর প্রতিপক্ষের চোখে ভয় ধরা পড়েছে— আহ্, দারুণ!’’ তাঁর এই মন্তব্য ঘিরে তীব্র জলঘোলা শুরু হয়ে গিয়েছে।

একে তো অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড দাবি করছিল, তারা নাকি স্লেজিং বা অশোভন আচরণকে প্রশ্রয় দেবে না। ক্রিকেট মাঠে চরিত্র শুদ্ধির বাণী শোনাচ্ছে তারা। তা হলে আবার প্রতিপক্ষের চোখে ভয় ধরিয়ে ‘ক্রিসমাস গি‌ফ্‌ট’-এর কথা আসছে কী করে? দ্বিতীয়ত প্রশ্ন উঠছে, অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড কী করে নির্দেশ পাঠাল? তার মানে একমাত্র ভারতেই নিজেদের ইচ্ছা মতো পিচ বানানোর কাণ্ড ঘটে না! তৃতীয়ত, অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের চোখে ভয় ধরানোর কথা ভাবার আগের নিজেদের দলের দিকে তাকাক অস্ট্রেলিয়া।

এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা পেস আক্রমণ রয়েছে ভারতের হাতে। যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ শামি, ইশান্ত শর্মারা এই পিচ পেয়ে উল্টে অস্ট্রেলিয়াকেই ধ্বংস করে দিত পারেন। মাইকেল ভন এই মতের শরিক। এই সিরিজে ধারাভাষ্য দিতে এসেছেন প্রাক্তন ইংল্যান্ড অধিনায়ক। বৃহস্পতিবার সকালে পার্‌থের নতুন স্টেডিয়ামে একটি অনুষ্ঠানে এসে তিনি বলে গেলেন, ‘‘এই পিচ অস্ট্রেলিয়ার জন্য ব্যুমেরাং হতে পারে। ইংল্যান্ডে আমি ভারতীয় পেসারদের বল করতে দেখেছি। দক্ষিণ আফ্রিকায় দেখেছি। অ্যাডিলেডে দেখেছি। ওরা অসাধারণ। এই পিচ দেখে যশপ্রীত বুমরা, ইশান্ত শর্মা, মহম্মদ শামিরা রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে একটাই কথা বলবে— থ্যাঙ্ক ইউ।’’ এখানেই না থেমে ভন যোগ করছেন, ‘‘অ্যাডিলেড টেস্টের ময়নাতদন্ত করলে দেখা যাবে অস্ট্রেলিয়ার পেসারদের হারিয়ে দিয়েছে ভারতীয় পেসাররা। আমার মনে হচ্ছে, এ রকম ঘাসের পিচ বানিয়ে বিরাট ঝুঁকি নিয়ে ফেলছে অস্ট্রেলিয়া।’’ তাঁর আরও ব্যাখ্যা, ‘‘একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, পিচের চরিত্রই শুধু ম্যাচে জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি করে না। অ্যাডিলেডে ভারত জিতেছে পিচের জন্য নয়, জিতেছে কারণ ওরা ভাল ক্রিকেট খেলেছে, ধারাবাহিক ভাবে কঠিন মুহূর্তগুলোতে সফল হয়েছে।’’

অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার প্রধান পেস-অস্ত্র বাঁ হাতি মিচেল স্টার্কের ব্যর্থতা আরও বেশি করে সবুজ পিচ বানানোর সিদ্ধান্তকে ঘিরে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। সেই সঙ্গে পাল্টে যাওয়া ভারতীয় ক্রিকেট পৃথিবী। একটা সময় ছিল যখন সবুজ উইকেট দেখলে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের কারও পেট গুড়গুড় করত। কারও হাত চিনচিন করত। অজানা এই সব রোগের উপসর্গ থেকে একটা নামকরণও হয়েছিল ক্রিকেট মহলে— গ্রিন উইকেটাইটিস। জলাতঙ্কের মতো সবুজ আতঙ্ক। এখন সে সবের প্রশ্নই নেই। অধিনায়কের নাম বিরাট কোহালি। তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে এসে পাল্টা বলে দিয়ে গেলেন, ‘‘আমি খুব খুশি হয়েছি সবুজ পিচ দেখে। এর মানে হল, প্রথম তিন দিন খুব প্রাণবন্ত ক্রিকেট দেখা যাবে।’’ এর পরেই ভারতীয় অধিনায়কদের সর্বকালের সেরা উক্তির তালিকায় ঢুকে পড়ার মতো মন্তব্য, ‘‘আমি আশা করব, আর ঘাস ছাঁটবে না ওরা। ঘাস দেখে এখন আর আমরা উদ্বিগ্ন হই না, উত্তেজিত হই।’’

কোহালির এমন ডাকাবুকো প্রেস কনফারেন্সের পরে পিচ-বিতর্ক আরও বেড়ে গিয়েছে। বরাবর ভারতীয় অধিনায়কদের উদ্দেশে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটমহল ‘চিন মিউজিক’ বাজানোর কথা শুনিয়েছে। এ বার কোহালি পাল্টা তোপ দাগায় ব্যাকফুটে চলে গিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। কর্তারাই এখন আতঙ্কে পড়ে গিয়েছেন, সত্যিই সবুজ পিচ ব্যুমেরাং হলে বল-বিকৃতির পরে ফের সমালোচনার ঝড় না তাড়া করে! কিউরেটর স্বয়ং সব চেয়ে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছেন অস্ট্রেলীয় বোর্ডের কর্তাদের।

অস্ট্রেলিয়ায় এক-একটা জায়গায় পিচের চরিত্র এক-এক রকম। অ্যাডিলেড যেমন ব্যাটিং-সহায়ক, ব্রিসবেন ও পার্‌থ পেস ও বাউন্সের জন্য পরিচিত, আবার সিডনিতে বল স্পিন করে। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড এত কাল দাবি করে এসেছে, পিচের এই চরিত্রটা ধরে রাখার কথাটুকুই তারা বলে, আলাদা ভাবে নির্দিষ্ট কোনও ধরনের বাইশ গজ প্রস্তুত করার জন্য চাপ দেয় না। শুধু তা-ই নয়, তাদের ক্রিকেটারেরা ভারতে এসে অতিরিক্ত স্পিন-সহায়ক পিচ নিয়ে অভিযোগ জানাতেও ছাড়েননি। এখন প্রশ্ন উঠছে, তা হলে পার্‌থে ‘প্রতিপক্ষের চোখে ভয় ধরাও’ নির্দেশ কোথা থেকে এল? তড়িঘড়ি কর্তারা সংবাদমাধ্যমকে বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করছেন যে, তাঁরা এ রকম নির্দেশ দেননি।

কিন্তু সেই প্রচেষ্টা খুব একটা সমর্থন জোটাতে পারছে না। পাল্টা প্রশ্ন উঠছে, যদি নির্দেশ এসেই না থাকবে, তা হলে কিউরেটর এত ফলাও করে বলতে যাবেন কেন? তাঁর কী স্বার্থ আছে এর মধ্যে? দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বল-বিকৃতি এবং যোগ্য প্রতিভার আকালে জেরবার অস্ট্রেলিয়া। পার্‌থ না ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের কাহিনি মনে করিয়ে দেয়! সবুজ দৈত্য না গিলতে আসে

তার স্রষ্টাকেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE