Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
রবিবাসরীয় পার্‌থে উত্তেজনার আগুন বিরাটের ‘ক্যাচ’ ঘিরে

কোহালির আউট বিতর্কে ফিরল মাঙ্কিগেটের স্মৃতি

ফের কি মুখ দেখাদেখি বন্ধ আর যুযুধান দু’দলের মধ্যে তিক্ততা দিয়ে নতুন বছরে পা দেবে ক্রিকেট?

কোহালির সেই বিতর্কিত ‘ক্যাচ’ নিচ্ছেন হ্যান্ডসকম্ব। এপি

কোহালির সেই বিতর্কিত ‘ক্যাচ’ নিচ্ছেন হ্যান্ডসকম্ব। এপি

সুমিত ঘোষ
পার্থ শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০২:৫৯
Share: Save:

মাঙ্কিগেটের পরে কি ক্যাচিংগেট?

আবারও কি বিতর্কের আগুনে পুড়তে চলেছে ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ?

ফের কি মুখ দেখাদেখি বন্ধ আর যুযুধান দু’দলের মধ্যে তিক্ততা দিয়ে নতুন বছরে পা দেবে ক্রিকেট?

অস্বস্তিকর নানান প্রশ্ন এসে ভিড় করতে শুরু করেছে মাঝ ডিসেম্বরের বিকেলে। বিতর্কের কেন্দ্রে বিরাট কোহালির আউট। ভারতীয় শিবির রীতিমতো ফুঁসছে যে, ম্যাচের মোক্ষম সময়ে অন্যায় ভাবে অধিনায়ককে আউট দেওয়া হয়েছে। মাঠের আম্পায়ার, টিভি আম্পায়ার দু’জনকে নিয়েই তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়েছে ভারতীয় শিবিরে। এমনকি, বোর্ডের সঙ্গেও কথা বলা হোক বলে দিনের শেষে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় উত্তেজিত ভাবে দাবি তুলেছেন দলের কোনও কোনও সদস্য।

কী ভাবে আউট হয়েছিলেন কোহালি? ২৫৭ বলে ১২৩ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস খেলে প্যাট কামিন্সের আউটসুইংয়ে ব্যাট সরাতে পারলেন না ভারত অধিনায়ক। ব্যাটের কাণা নিয়ে বল গেল দ্বিতীয় স্লিপে। সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যাচ নেওয়ার চেষ্টা করলেন পিটার হ্যান্ডসকম্ব। এর পরেই দু’আঙুলে বলটা তুলে ক্যাচের দাবি জানান হ্যান্ডসকম্ব। বোলার কামিন্সও উৎসব করার ভঙ্গিতে হাত তুলে ছুটে আসেন। বিভ্রান্ত কোহালি স্লিপ কর্ডনের দিকে জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে তাকাতে থাকেন। আম্পায়ারদের দিকে ঘুরে জানতে চান, ক্যাচ সঠিক ভাবে নিয়েছেন কি না? এই সময়ে হ্যান্ডসকম্বকে দেখা যায়, আঙুল তুলে আউট দেওয়ার ভঙ্গি করছেন।

মাঠের আম্পায়ার শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন ক্রিকেটার কুমার ধর্মসেনা টিভি আম্পায়ারের শরণাপন্ন হন। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, প্রযুক্তির সাহায্য নিলেও মাঠের আম্পায়ারকে জানিয়ে দিতে হয়, তাঁর কী মনে হচ্ছে। ব্যাটসম্যান আউট কি আউট না? এই সিদ্ধান্তকে বলা হয় ‘সফ‌্ট সিগন্যাল’। ধর্মসেনা ‘সফ্‌ট সিগন্যালে’ আঙুল তুলে জানান, তাঁর মতে কোহালি আউট। অর্থাৎ, হ্যান্ডসকম্ব পরিষ্কার ভাবে দ্বিতীয় স্লিপে ক্যাচ নিয়েছেন। দিনের শেষে যশপ্রীত বুমরা বলে যান, মাঠের আম্পায়ারের এই সিদ্ধান্তে তাঁরা অবাক হয়েছেন।

ধর্মসেনার এই ‘সফ্‌ট সিগন্যাল’ নিয়েই তীব্র বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় শিবির ক্ষিপ্ত। কোহালি ফুঁসছেন। ওদিকে মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনে বার বার রিপ্লে দেখানো হচ্ছে হ্যান্ডসকম্বের ক্যাচের। নানা কোণ থেকে দেখা হচ্ছে। তার পরেও বুঝে ওঠা যাচ্ছে না, ক্যাচ পরিষ্কার ভাবে নেওয়া হচ্ছে কি না। বরং আবছা হলেও দেখা যাচ্ছে দু’আঙুলের ফাঁক দিয়ে বল সম্ভবত ঘাসের ডগা ছুঁয়েছে।

নিয়ম হচ্ছে, যদি বলের সামান্যতম কোনও অংশও ঘাস ছুঁয়ে ফেলে, তা হলেই নট আউট। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ দিন এই ক্যাচের একটি ছবি ঘুরতে থাকে। টিভি ক্যামেরা থেকে ‘জুম’ করে তোলা। দিনের খেলা শেষে ড্রেসিংরুমে ফিরে ক্যাচের রিপ্লে এবং টুইটারে ঘোরা সব ছবি সম্পর্কে জানতে পারেন কোহালি এবং তাঁর টিম। তাতে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া উইকেট। একশো শতাংশ নিশ্চিত না হয়ে কী করে আউট দিতে পারেন আম্পায়াররা?

আউট হয়ে বেরনোর পথে ভারত অধিনায়ককে দেখা যায়, বাউন্ডারির ধারে এসে গ্লাভস খুলে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন। এর পরে মাথা নাড়তে নাড়তে, গজগজ করতে করতে ঢুকে যান ড্রেসিংরুমে। ভারতের প্রথম ইনিংসে ২৮৩ রানের মধ্যে কোহালি একাই করেন ১২৩। অন্য দিক থেকে উইকেট পড়তে থাকলেও একা কুম্ভ হয়ে তিনি টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন দলকে। অধিনায়ক যখন আউট হলেন, ভারত ২৫১-৬। ঘটনা হচ্ছে, হনুমা বিহারী আউট হওয়ার পরে তরুণ ঋষভ পন্থকে সঙ্গে নিয়ে ফের একটা পার্টনারশিপ গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন তিনি। ঠিক সেই সময়েই বিতর্কিত আউটের সিদ্ধান্তে ছন্দপতন। ষষ্ঠ উইকেট হিসেবে কোহালির পতন হতেই আর মাত্র ৩২ রানের মধ্যে গুটিয়ে যায় ভারতের প্রথম ইনিংস। পার্‌থের বোলার-বন্ধু পিচে ৪৩ রানের গুরুত্বপূর্ণ ‘লিড’ পেয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। কোহালি যে রকম শাসকের ভঙ্গিতে ব্যাট করছিলেন, সকলে আশা করেছিল তিনি ভারতকেই প্রথম ইনিংসে এগিয়ে দেবেন। তখন দ্বিতীয় ইনিংসে অনেক ভাল ভাবে ম্যাচে থাকা সম্ভব হত। যিনি ক্যাচটা নিয়েছেন, সেই হ্যান্ডসকম্ব সব চেয়ে বেশি করে বিতর্কের মুখে পড়েছেন। একে তো তাঁকে নিয়ে কোহালিদের একটা ইতিহাস আছে। ভারত সফরে যখন ডিআরএস কেলঙ্কারি ঘটেছিল, সেই অধ্যায়ে অন্যতম খলনায়ক ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার এই ব্যাটসম্যান। স্টিভ স্মিথকে তিনিই ইশারায় ড্রেসিংরুমের দিকে তাকিয়ে সিগন্যাল নিতে বলেন যে, ডিআরএস নেবেন কি নেবেন না। স্মিথ তখন ড্রেসিংরুমের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জানতে চান, কী করবেন। তাই হ্যান্ডসকম্বের সততা নিয়ে কোহালিদের শিবিরে আগে থেকেই প্রশ্ন ছিল। রবিবার অধিনায়কের ক্যাচ নিয়ে তাঁর কথাকে তাই কেউ গ্রহণ করতে পারছেন না। আশ্চর্যের হচ্ছে, হ্যান্ডসকম্ব নিজের দেশের প্রাক্তনদের দিক থেকেও বাউন্সার পাচ্ছেন। একে তো বার বার টিভি-তে তাঁর কুৎসিত ব্যাটিংয়ের ভঙ্গি দেখানো হচ্ছে। কোহালি যেখানে অস্ট্রেলিয়ায় এসে পার্‌থের ফুটন্ত উইকেটেও ক্রিজের অনেক বাইরে দাঁড়াচ্ছেন, সেখানে তিনি নিজের দেশের উইকেটে এতটাই পিছিয়ে দাঁড়াচ্ছেন যে, যখন-তখন হিট উইকেট হয়ে যেতে পারেন। রিকি পন্টিং, শেন ওয়ার্নরা প্রশ্ন তুলেছেন কী করে এমন টেকনিক নিয়ে কেউ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সফল হওয়ার আশা দেখতে পারে?

রবিবার সঠিক ভাবে ক্যাচ ধরার দাবি জানিয়ে আঙুল তোলার ভঙ্গি করা নিয়েও তুলোধনা হচ্ছেন হ্যান্ডসকম্ব। তাঁরই দেশের প্রাক্তন তারকা অ্যাডাম গিলক্রিস্ট মনে করিয়ে দিয়েছেন, মাঙ্কিগেট সিরিজে এ রকমই স্লিপে একটি ক্যাচ নিয়ে তুলকালাম হয়ে গিয়েছিল। সেই ক্যাচটি ছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের। স্লিপে সঠিক ভাবে সেই ক্যাচ ধরেছিলেন বলে দাবি করেন মাইকেল ক্লার্ক। সেই সিরিজে দুই দলের দুই অধিনায়ক অনিল কুম্বলে এবং রিকি পন্টিংয়ের মধ্যে সমঝোতা হয়েছিল যে, বিতর্কিত ক্যাচের ক্ষেত্রে অধিনায়কের কথাই শিরোধার্য হবে। সৌরভের ক্যাচের ক্ষেত্রে পন্টিং জানান, পরিষ্কার ভাবে ক্যাচ নেওয়া হয়েছে। ভারতীয় শিবির সেই দাবিতে একেবারেই সন্তুষ্ট হয়নি। সফরের মাঝপথেই ভেস্তে যায় ক্যাচ নিয়ে মউ সাক্ষর। এ বারেও স্লেজিং বন্ধ এবং নানা রকম আচরণগত বিধিনিষেধের কথাবার্তা দিয়ে সিরিজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু পার্‌থে দ্বিতীয় টেস্টে এসেই সৌজন্যের মুখোশ খুলে পড়ার উপক্রম হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করার সময়ে যেমন দুই অধিনায়কের মধ্যে বাগ্‌যুগ্ধ শুরু হয়ে গেল। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক টিম পেন ব্যাট করার সময়ে কোহালি স্লিপ থেকে টিপ্পনি কাটলেন, ‘‘ওহে, এ বারও যদি তুমি রান না করতে পারো, ২-০ হয়ে যাবে। তখন কথা বলারও তো কেউ থাকবে না তোমার দলে!’’ পেনও কম যান না। ভারতীয় স্লিপ কর্ডনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে কোহালিকে জবাব দিলেন, ‘‘তার জন্য তোমাদের ভাল ব্যাটও করে দেখাতে হবে।’’ দিনের খেলা শেষে মাঠ ছাড়ার সময়ে আবার দু’জনের মধ্যে লাগল। একই দিনে অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস ও হরভজন সিংহের মধ্যে পুরনো মাঙ্কিগেটের বিতর্ক নিয়েও লাগল। ভারত ও অস্ট্রেলিয়া— বন্ধুত্ব মনে হচ্ছে কিছুতেই হওয়ার নয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE