Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
একান্ত আলাপচারিতায় কোচ শাস্ত্রী: ফিটনেস নিয়ে আপস নয়

মিশন বিশ্বকাপে চাই বিশ্বাস আর জয়ের মানসিকতা

ক্রিকেটার হিসেবে তিনি দু’বার বিশ্ব জয়ের সাক্ষী। তিরাশিতে কপিলের দৈত্যদের এক জন। পঁচাশিতে অস্ট্রেলিয়ায় বেনসন অ্যান্ড হেজেস বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী দলের সেরা ক্রিকেটার।

কঠোর: ক্রিকেটারদের মানসিক দৃঢ়তা বাড়ানোর উপরেই জোর দিচ্ছেন কোচ রবি শাস্ত্রী। ফাইল চিত্র

কঠোর: ক্রিকেটারদের মানসিক দৃঢ়তা বাড়ানোর উপরেই জোর দিচ্ছেন কোচ রবি শাস্ত্রী। ফাইল চিত্র

সুমিত ঘোষ 
রাঁচী শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৯ ০২:১৬
Share: Save:

ক্রিকেটার হিসেবে তিনি দু’বার বিশ্ব জয়ের সাক্ষী। তিরাশিতে কপিলের দৈত্যদের এক জন। পঁচাশিতে অস্ট্রেলিয়ায় বেনসন অ্যান্ড হেজেস বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী দলের সেরা ক্রিকেটার। চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়ন্স হয়ে গাড়ি জেতার সেই ছবি দেখা গেল এখনও ঝুলছে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির শহরের ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ফটো গ্যালারিতে। ২০১৪-তে দলের ঘোর দুর্যোগের মধ্যে ডিরেক্টরের দায়িত্ব নেওয়া। সেখান থেকে বিরাট কোহালিদের অভাবনীয় উত্থান এবং টেস্ট, ওয়ান ডে-তে এক নম্বর আসন দখল। কী ভাবে দল পেরোল এই দুর্গম যাত্রা? কোন মন্ত্র ঘুরছে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে? কী ভাবে সাদা বল থেকে লাল বলে নিয়ে আসা হল যশপ্রীত বুমরাকে? কেন অশ্বিনদের বসিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল কুলদীপ, চহালের মতো রিস্টস্পিনার? ধোনির শহরে বসে সব কিছু নিয়ে আনন্দবাজারের সঙ্গে খোলামেলা আলাপচারিতায় ভারতীয় দলের হেড কোচ রবি শাস্ত্রী। আজ আলাপচারিচতার প্রথম পর্ব:

প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়ায় ইতিহাস সৃষ্টিকারী সিরিজ জয়ের প্রভাব কী?

রবি শাস্ত্রী: প্রভাবের দিক থেকে বিশাল। মনে আছে, অস্ট্রেলিয়ায় যখন আমরা সিরিজ জিতি, বলেছিলাম, কিছুটা সময় লাগবে উপলব্ধি করতে যে, ছেলেরা কত বড় ইতিহাস সৃষ্টি করল। আমি নিশ্চিত, এখন সকলে বুঝতে পারছে। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট খেলার জন্য সব চেয়ে কঠিন জায়গা। ওরা হারতে ঘৃণা বোধ করে। অস্ট্রেলিয়াকে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে হারানোটা সর্বোত্তম চ্যালেঞ্জ।

প্র: আপনি যখন ইংল্যান্ডে প্রথম ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব নিলেন, দলটার মনোবল তলানিতে। পর পর অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। র‌্যাঙ্কিংয়ে ভারত তখন সাত নম্বর। সেখান থেকে র‌্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর হওয়া কী ভাবে সম্ভব হল? দায়িত্ব নিয়ে টিমকে কী বলেছিলেন?

শাস্ত্রী: আমার বার্তাটা খুব সহজ ছিল— খেলাটাকে উপভোগ করো। এ রকম একদম ভেবো না যে, অফিসের ডেস্কে কম্পিউটারের সামনে বসে আছো আর তোমাকে সমস্ত চাপ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমি বলেছিলাম, সব সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার শপথ নিতে হবে তোমাদের। আমি শুনতে চাই না, কোথায় তোমরা খেলছ। ভারতে খেলছ না বিশ্বের অন্য কোনও প্রান্তে। শুনতে চাই না, পিচটা ভারতের না কি বিদেশের। কোনও অজুহাত দেব না। আমরা এমন এক ধরনের ক্রিকেট খেলব, যা হবে ভয়ডরহীন, আক্রমণাত্মক। এবং সব সময় চোখে চোখ রেখে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যাব।

প্র: এখন এই যাত্রাটার দিকে ফিরে তাকিয়ে কী মনে হচ্ছে?

শাস্ত্রী: সমস্ত কৃতিত্ব ছেলেদের। ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজ হারের পরে আমি দায়িত্বে এলাম। ওয়ান ডে সিরিজটাই আমরা জিতলাম। এক বার রক্তের স্বাদ পাওয়ার পরে ছেলেরা অন্য রকম হয়ে গেল। এর পর আত্মবিশ্বাস আসতে শুরু করল। ওরা ভাবতে শুরু করল, বিশ্বের সেরা দলগুলোর একটা হয়ে ওঠার ক্ষমতা আমাদের রয়েছে। ওরা বুঝতে শিখল, বিশ্বের যে কোনও দেশে গিয়ে ওরা শাসন করতে পারে। খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানসিকতাটা তৈরি হওয়া। আমি ছেলেদের বোঝাতে চেয়েছিলাম, এমন একটা দল হয়ে ওঠো যাদের নিয়ে লোকে বলবে, ওরা আনন্দ দিয়েছিল আর খেলাটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

প্র: সব চেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন কিসের উপরে?

শাস্ত্রী: সব সময় মানসিকতার উপর সব চেয়ে বেশি জোর দিয়েছি। অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজ হারার মধ্যেও বলেছিলাম (২০১৪-তে), হেরেছি ঠিকই কিন্তু হার মানতে না চাওয়া, অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জেতার ইচ্ছে দেখানোর মানসিকতাটাই প্রাপ্তি। এটাই টিমটাকে টগবগে ঘোড়ার মতো ছোটাবে আগামী কয়েক বছরে। তখন অনেকের মনে হয়েছিল, আমি বোধ হয় ফরাসি ভাষায় কথা বলছি। এখন তারা বুঝতে পারছে নিশ্চয়ই।

প্র: কোন কোন দিকে পরিবর্তন আনা দরকার বলে মনে করেছিলেন?

শাস্ত্রী: মনে হয়েছিল, এক জন বা দু’জনের উপরে নির্ভর করে চললে হবে না, দল গড়ে তুলতে হবে। একটা ভাল দল মানে অন্তত ছয় থেকে সাত জন বিশ্ব মানের ক্রিকেটার তাদের থাকবে। আমাদের দলে এ রকম ধরনের ক্রিকেটার ছিল দুই থেকে তিন জন। আস্তে আস্তে সেটা হল চার-পাঁচ। অস্ট্রেলিয়ায় যে দলটা টেস্ট সিরিজ জিতল, তার থেকে বিশ্ব মানের সাত থেকে আট জন ক্রিকেটার অনায়াসেই পাওয়া যাবে। অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে ফিল্ডিং এবং ফিটনেসে। সেটার প্রভাব তো সকলে দেখতেই পাচ্ছে। বোলিংয়ে দুর্দান্ত উন্নতি ঘটেছে। বিশেষ করে বিদেশের মাটিতে বোলিংয়ে। এই বিভাগটায় আমরা কোথায় ছিলাম আর এখন কোথায় আছি, মিলিয়ে দেখুন।

প্র: এই যে আপনার ‘জেতার জন্য খেলব’ মন্ত্র— সেটাকে বাস্তবায়িত করাটা কত কঠিন ছিল?

শাস্ত্রী: আত্মবিশ্বাস ধরে রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি জানি, ফল নির্ভর দেশে হারলেই কথা উঠবে। পণ্ডিতরা তো বসেই আছে মন্তব্য ছুড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, নিজের মনের কাছে পরিষ্কার থাকাটা খুব দরকার। যদি তুমি নিজের মধ্যে থেকে নিশ্চিত থাকো যে, শেষ বিন্দু দিয়ে লড়াই করেছো, যদি তোমার শরীরে নেতিবাচক হাড় না থাকে, পণ্ডিতদের বকবকানিতে কিছু এসে- যাবে না। খুব কাছাকাছি এসে কয়েক বার হারতে পারো, যেমন আমরা হেরেছি। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া। জেতার আগুন বলে একটা কথা আছে। সেই আগুনকে কখনও নিভতে দেওয়া যাবে না।

প্র: কাছে এসেও পারলাম না থেকে কী করে কাজ সম্পূর্ণ করার পদ্ধতিটা শিখছে দল?

শাস্ত্রী: জেতাটা একটা অভ্যেস। সেটা বুঝতে শিখেছে ছেলেরা। দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করতে হবে, যে কোনও পরিস্থিতি থেকে জিততে পারি। কেপ টাউন বা এজবাস্টনে যখন কাছে এসেও আমরা হেরে গেলাম, ছেলেদের বলেছিলাম, ভুল থেকে শিক্ষা নাও। অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের সিরিজ জয় সম্ভব হয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইংল্যান্ডে আমরা ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছি বলে। অস্ট্রেলিয়াতে ওরা সম্পূর্ণ ভাবে তৈরি ছিল। শপথ নিয়েছিল, ম্যাচের মোড় ঘোরানো মুহূর্তগুলো আর আমরা হাত থেকে বেরিয়ে যেতে দেব না।

প্র: আপনি ভারতের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য। পঁচাশিতে অস্ট্রেলিয়ায় বেনসন অ্যান্ড হেজেস বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী ভারতীয় দলের চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়ন্স। এই ভারতীয় দল ঠিক কতটা ভাল?

শাস্ত্রী: সমস্ত ধরনের ক্রিকেটকে ধরলে ইতিমধ্যেই ওরা ভারতের সর্বকালের সেরা দলগুলোর একটা। গত পাঁচ বছরে দেশ এবং বিদেশের মাটিতে সব ফর্ম্যাটের ক্রিকেটে এই দলটা কেমন খেলেছে দেখুন। কী রকম ধারাবাহিকতা এনেছে দেখুন। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে সমস্ত ধরনের ক্রিকেটে গত তিন-চার বছরে ওরা সত্তর শতাংশ ম্যাচ জিতেছে। পার্কে বেড়াতে বেরনোর মতো সহজ কাজ নয় নিশ্চয়ই।

প্র: এ বার মিশন বিশ্বকাপ। কাপ জিততে গেলে কী করতে হবে?

শাস্ত্রী: দু’টো জিনিস খুব দরকার। সঠিক মানসিকতা এবং নিজের দক্ষতায় গভীর বিশ্বাস। এই দলটা গত দু’তিন বছর ধরে একসঙ্গে খেলছে। বিশ্বকাপ বলেই খেলার ভঙ্গি বা মনোভাবে পরিবর্তন আনতে হবে, এমন ধারণায় আমি বিশ্বাসী নই। এই টিম একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেছে গত দু’তিন বছর ধরে। সেটাই ধরে রাখতে হবে। যা যা করে এসেছি, সেগুলোই ঠিকঠাক করতে হবে।

প্র: ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ। বিশেষ কোন ব্যাপার মাথায় রাখতে হচ্ছে?

শাস্ত্রী: গত বছরই আমরা ইংল্যান্ডে খেলেছি। তাই পরিবেশ, পিচ সম্পর্কে টিম ওয়াকিবহাল। ওয়ান ডে আর টেস্ট ক্রিকেটের মধ্যে অনেক তফাত। পিচ অন্য রকম হবে, বেশি রানও উঠবে। সাদা বল অবশ্যই লাল বলের মতো সুইং করবে না। আর সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বিশ্বকাপে সব দলকেই তো একই পরিবেশে খেলতে হবে। সো নো প্রব্লেম।

প্র: রবি শাস্ত্রীর টিম ম্যানেজমেন্টের দু’টো সিদ্ধান্ত মাস্টারস্ট্রোক হয়ে থাকছে। প্রথমত যশপ্রীত বুমরাকে টেস্টের জন্য নিয়ে আসা। অথচ সকলে বলেই দিয়েছিল, বুমরা শুধুই সাদা বলের বোলার। এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে কী ভাবনা ছিল?

শাস্ত্রী: আমাদের কোথাও কোনও সংশয় ছিল না বুমরার টেস্ট দক্ষতা নিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের তিন মাস আগে থেকে আমরা ওকে তৈরি করার পরিকল্পনা নিই। তখনই আমরা জানতাম, ও দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম টেস্টেই খেলবে। আবার বলছি, তিন মাস আগেই ঠিক করা ছিল, কেপ টাউনে প্রথম টেস্টেই বুমরা খেলবে। আমরা সোজা ওকে দক্ষিণ আফ্রিকায় নামাতে চেয়েছিলাম। তার আগে দেখাতে চাইনি কাউকে। ওকে বলা হয়েছিল, ট্রেনিং করতে। শারীরিক দিক থেকে কয়েকটা জিনিস ঠিক করার ছিল। যেটা টেস্ট খেলতে গেলে লাগত। সেগুলো ওকে করতে বলে দেওয়া হয়েছিল। আমরা জানতাম, সামনের চোদ্দো মাস আমাদের বিদেশে খেলতে হবে। সেই কথা ভেবেই তৈরি করা হয়েছিল বুমরাকে। বাকিটা ইতিহাস।

প্র: দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত ওয়ান ডে ক্রিকেটে রিস্টস্পিনারদের (কব্জির ব্যবহারে যাঁরা স্পিন করেন) নিয়ে আসা...

শাস্ত্রী: আমরা জানতাম, রিস্টস্পিনার রান দিয়ে ফেলতে পারে। একই সঙ্গে ওয়ান ডে-তে মাঝের দিকে খেলাটাকে প্রতিপক্ষের দিকে ঘুরে যেতেও দেওয়া যায় না। তখন উইকেট তুলতে হবে। সেখানেই দরকার পড়বে রিস্টস্পিনার। পরিবেশ যদি অনুকূল থাকে, তা হলে এমনকি দলে দু’জন রিস্টস্পিনারও খেলানো যেতে পারে। যেটা আমরা করেছি।

প্র: বেশ কিছু কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছে। ফিটনেস নিয়ে আপসহীন নীতি তার মধ্যে একটা।

শাস্ত্রী: ফিটনেস নিয়ে কোনও আপস নয়। আমরা যখন ইয়ো ইয়ো টেস্ট চালু করছিলাম, অনেকের পছন্দ হয়নি। খেলোয়াড়দের কারও কারও পছন্দ হয়নি। তাতেও পিছিয়ে আসিনি। যাদের পছন্দ হয়নি, তাদেরও তাই ইয়ো ইয়ো মানতে হয়েছে। যারা গাঁইগুই করেছে, তাদেরও প্রথমে ইয়ো ইয়ো পাশ করতে হয়েছে। না হলে টিমে জায়গা হয়নি। আজ ওরা নিজেরাই দেখতে পাচ্ছে, ফিটনেসে উন্নতি ঘটিয়ে ওদের পারফরম্যান্সই কত পাল্টে গিয়েছে। আমাদের দলে বিশ্বের সেরা ট্রেনারদের এক জন রয়েছে, ভাসু (শঙ্কর ভাসু)। খুবই অভিজ্ঞ ফিজিয়ো রয়েছে (প্যাট্রিক ফারহার্ট)। ওরাই ছেলেদের রুটিনের দিকটা দেখছে। কারও ভাল না লাগলেও কিছু করার নেই। ফিটনেস নিয়ে আপস নয়। যে-ই হও, ওটা মানতেই হবে। (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

World Cup 2019 Ravi Shastri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE