Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

আর্জেন্তিনার জাভি হয়েও মেসি একশোয় একশো

স্কোরলাইনটা দেখাচ্ছে আর্জেন্তিনা ৬, মেসি ০। কিন্তু আমার কাছে স্কোরটা একটু অন্য রকম। ওটা হবে আর্জেন্তিনা ৬, মেসি ৩! ম্যাচটা শেষ হয়ে গিয়েছে বেশ কয়েক ঘণ্টা। কিন্তু চোখের সামনে অবিশ্বাস্য সব মুভ এখনও ভেসে বেড়াচ্ছে। স্কোরলাইন বলবে মেসি গোল করেনি।

সুব্রত ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৫ ০৩:০৪
Share: Save:

আর্জেন্তিনা ৬ (রোখো, পাস্তোরে, দি’মারিয়া-২, আগেরো, ইগুয়াইন)
প্যারাগুয়ে ১ (ব্যারিওস)

স্কোরলাইনটা দেখাচ্ছে আর্জেন্তিনা ৬, মেসি ০। কিন্তু আমার কাছে স্কোরটা একটু অন্য রকম। ওটা হবে আর্জেন্তিনা ৬, মেসি ৩!
ম্যাচটা শেষ হয়ে গিয়েছে বেশ কয়েক ঘণ্টা। কিন্তু চোখের সামনে অবিশ্বাস্য সব মুভ এখনও ভেসে বেড়াচ্ছে। স্কোরলাইন বলবে মেসি গোল করেনি। কিন্তু আমরা, যারা ম্যাচটা দেখে উঠলাম, তারা বলব, নিজে নেটে বল পাঠায়নি ঠিকই, কিন্তু অন্তত তিনটে গোলের পিছনে ছিল মেসি-স্কিল। যারা বলে মেসি নাকি দেশের জার্সিতে পারফর্ম করতে পারে না, ভবিষ্যতে তাদের এই প্যারাগুয়ে ম্যাচের ভিডিও দেখা উচিত। তা হলে সব ভুল ভেঙে যাবে। প্রমাণ পেয়ে যাবে যে, সত্যিকারের প্রতিভা যে কোনও পরিস্থিতিতে নিজের সেরাটা দিতে পারে।
এই কোপা কিন্তু ফুটবলার হিসেবে মেসির বিবর্তন দেখছে। দেখছে, পাশে যোগ্য ফুটবলার না থাকলেও কী ভাবে খেলাটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কী ভাবে নিজে গোল না করে অন্যকে দিয়ে গোল করাতে হয়। এর জন্য আর্জেন্তিনা কোচ জেরার্দো মার্টিনোকেও কৃতিত্ব দেব। প্যারাগুয়ের বিরুদ্ধে মেসি এক অদ্ভুত পজিশনে খেলল। না পুরোপুরি সেন্টার ফরোয়ার্ড। না পুরোপুরি মাঝমাঠ। বরং দুটোর মাঝামাঝি জায়গায় দেখতে পেলাম মেসিকে। যাকে বলা হয় রোমিং ফরোয়ার্ড। যেখানে জায়গা পেল সেখান থেকেই পাস বাড়ানোর চেষ্টা করল। আক্রমণ তৈরি করল। সতীর্থদের সাপোর্টে আনল। আবার দরকার পড়লে গোলে শটও নিল। প্যারাগুয়ে ভেবেই নেমেছিল মেসিকে জোনাল মার্কিং করবে। শুরু থেকে সেটাই হল। কলম্বিয়া ম্যাচের মতো যেখানে মেসি গেল, পিছনে দু’তিনজন ডিফেন্ডার। তাতেও কোনও উত্তর খুঁজে পেল না মেসির বাঁ পায়ের সামনে। বলে বলে ড্রিবল। প্যারাগুয়ে ডিফেন্ডারদের তো তখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। অপেক্ষা করছে, কখন নব্বই মিনিট শেষ হবে। আর এই অবিশ্বাস্য প্রতিভার অত্যাচারের হাত থেকে তারা মুক্তি পাবে।

মেসির গোলের পাসগুলোর প্রথমটা ছিল ফ্রি কিক থেকে। মাপা বল বলতে যা বোঝায়। প্যারাগুয়ে ডিফেন্ডাররা ভেবেছিল হেডে ক্লিয়ার করতে পারবে, কিন্তু বলের ফ্লাইটই বুঝতে পারেনি। রোখোর পায়ে বলটা পড়ল। প্রথম গোলটা হল। দ্বিতীয় অ্যাসিস্ট ছিল প্রতিআক্রমণে। বলটা নিয়ে প্যারাগুয়ে মাঝমাঠ ফালাফালা করে দিয়ে বলটা বাড়াল পাস্তোরেকে। নিটফল দ্বিতীয় গোল।

এ বার আসি আর্জেন্তিনার শেষ গোল আর মেসির তৃতীয় পাসের কথায়। আমার কাছে এটাই সেরা। প্যারাগুয়ে রক্ষণের ভিড়ের মধ্যে ব্যালান্স হারিয়ে পড়ে গিয়েছিল মেসি। সেই অবস্থাতেও বলটা ঠিক ইগুয়াইনকে গলিয়ে দিল। এক কথায় অসাধারণ।

গোলের পাস ছাড়াও চোখধাঁধানো ড্রিবল করল। প্যারাগুয়ে ডিফেন্ডাররা উচ্চতায় বেশি হতে পারে, কিন্তু ছোট চেহারা হওয়াটা শক্তি হিসাবে ব্যবহার করে মেসি। প্রায় অসম্ভব সব অ্যাঙ্গলে বলটা নিয়ে যেতে পারে। আর্জেন্তিনার চতুর্থ গোলটার সময় মেসির ড্রিবলটা দেখলেন! আগুইলারকে হোল্ড আপ করেও সামনে যখন ব্রুনো ভালদেজ ট্যাকল করতে এল তখন ওর পায়ের তলা দিয়ে নাটমেগ। তাতে কী করুণ অবস্থা হল দুই ডিফেন্ডারের। এই ভাবে ডিফেন্ডারদের একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য খুব কমই দেখা যায়। এ সব কঠিন জিনিসও কতটা সহজ করে তুলেছে মেসি।

আর্জেন্তিনার এই পারফরম্যান্সের পিছনে মেসি তো ছিলই, তবে ওর সতীর্থদেরও যথেষ্ট অবদান আছে। আমি বারবার বলেছি, এক জনের ব্যক্তিগত প্রতিভা যতই অসাধারণ হোক না কেন, একা কারও ঘাড়ে সমস্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে হবে না। মেসিকে দেখলে খোঁড়া হওয়ার রোগটা কিছুটা হলেও কাটিয়েছে দল। আগেরো, পাস্তোরেরা সব সময়ে সাপোর্ট করে গেল মেসিকে। যে আগেরো অন্য ম্যাচে অদৃশ্য ছিল, তাকে বুধবার ভোরে দেখে খুব ভাল লাগল। সেন্টার ফরোয়ার্ডে দাঁড়িয়ে না থেকে নড়াচড়া করল। মেসির আশেপাশেই মুভ করল।

প্যারাগুয়ের স্ট্র্যাটেজিটা ছিল মেসি যেখানে যাবে, দু’তিনজন করে ডিফেন্ডার ওকে গার্ড দেবে। এতে অবশ্য বাকিরা ফ্রি হয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল ইচ্ছা করেই মেসি হয়তো বল হোল্ড করছিল। যাতে দু’তিন জন ওর কাছে চলে আসে আর ও ফ্রি হওয়া ফুটবলারদের পাস দিতে পারে। প্যারাগুয়ের বিরুদ্ধে গ্রুপ ম্যাচে দু’গোলে এগিয়ে গিয়ে অনেকটা স্লো হয়ে যায় আর্জেন্তিনা। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে বলেই প্যারাগুয়ে ২-১ করার পরেও এক বারও মনে হয়নি সে দিনের মতো কিছু হবে।

আর্জেন্তিনার হয়ে মেসির এত ডিপ খেলার কারণ হচ্ছে ওর পাস দেওয়ার ক্ষমতা। সঠিক পাস দেওয়ার ক্ষমতা একশো শতাংশ। আমি তো বলব, মারাদোনার থেকেও বেশি ভাল পাস বাড়াতে পারে। এটা কিন্তু বার্সেলোনার লা মাসিয়ার কৃতিত্ব। যেখানে হাতেখড়ি থেকে স্নাতক— পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে পাসিং ফুটবলের উপর। এই ট্রেনিংটা আছে বলেই তো বলের উপর এত সুন্দর কন্ট্রোল আর পাসিং ক্ষমতা। স্প্যানিশ ঘরানার ফুটবলের আদলেই ও আর্জেন্তিনাকে বদলে দিয়েছে। জাভি, ইনিয়েস্তা যে ভূমিকায় বার্সার হয়ে খেলে, মেসি সেটা খেলছে আর্জেন্তিনার হয়ে। অর্থাত্ স্কিমার বা প্লে-মেকার। আমার মনে হয় মার্টিনো দেখেছেন দলে গোল করার লোকের অভাব নেই। অভাব আছে ভাল প্লে-মেকারের। সে দায়িত্বটাই দেওয়া হয়েছে মেসিকে। ওকে ফরোয়ার্ডের বদলে তাই প্লে-মেকার হিসেবে খেলতে হচ্ছে। হয়ে উঠতে হয়েছে আর্জেন্তিনার জাভি। আর সেটাতেও ও একশোয় একশো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE