Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
মরিয়া মদ্রিচরা, তৃপ্ত নয় ফ্রান্সও

ব্যক্তিগত লক্ষ্য ভুলে যুযুধান দুই দলের চোখ খেতাবে

ক্রোয়েশিয়ার মাঝমাঠের রাজা শেষ করেন এই ভাবে—‘‘কাল যদি আমরা জিততে পারি, তা হলে দেশের ৪০ লক্ষ লোক রাস্তায় নেমে আনন্দ করবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যারা ক্রোয়েশিয়ার জার্সি  পরে এখন ঘুরছে তারা আনন্দ পাবে। সবাই আমাদের হাতে প্রথম বিশ্বকাপটা দেখতে চাইছে।  আমরা একটা দল হিসেবে নামব। এই দিনটা স্মরণীয় করে রাখতেই হবে।’’

মহড়া: ফ্রান্সের অনুশীলনে তাদের সেরা অস্ত্র এমবাপে।

মহড়া: ফ্রান্সের অনুশীলনে তাদের সেরা অস্ত্র এমবাপে।

রতন চক্রবর্তী
মস্কো শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৮ ০৪:৪১
Share: Save:

প্রশ্নটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর চোখ মূহূর্তে যেন জ্বলে ওঠে! পরের মিনিটেই অবশ্য একেবারে শান্ত তিনি। ‘‘মেসি বা রোনাল্ডোর সঙ্গে তুলনা করলে আমি খুশি হই না। ওরা বড় খেলোয়াড়। আমি শুধু ভাল খেলে যেতে চাই। বিশ্বকাপটা জিততে চাই।’’ বলে ফেলেন লুকা মদ্রিচ। এত দিন খুব বেশি প্রচার না পাওয়ার জন্য অভিমানী মনে হয় তাঁকে। ঠোটটা চেটে নিলেন কথাগুলো বলার পরে। শিকার ধরতে যাওয়ার মুখে যেমন করে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।

লুঝনিকি স্টেডিয়ামে সাংবাদিক সম্মেলন গৃহে শনিবার দুপুরে উপচে পড়া ভিড়। কপালে, কানের পাশ দিয়ে নেমে আসা সোনালি চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে কথা বলছিলেন এ বারের প্রতিযোগিতার নতুন নায়ক। প্রথম প্রশ্নটাই ক্রোয়েশিয়া অধিনায়ককে করা হল তাঁর রোগাপাতলা চেহারা আর বয়স নিয়ে। পরেরটা মেসি-রোনাল্ডোর এগারো বছরের জমানা থামিয়ে তাঁর জীবনের সূর্যোদয় প্রসঙ্গে। লুকা বলে দেন, ‘‘জীবনের অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যেখানে এসেছি, তাতেই আমি তৃপ্ত। মাঠে নামলে বয়স বা রুগ্ণ চেহারা আমাকে থামাতে পারে না। আমি দৌড়েই চলি দলকে জেতাতে। সোনার বল নয়, আমাকে দৌড়তে শক্তি যোগায় দেশকে জেতানোর তাগিদ।’’

ক্রোয়েশিয়ার মাঝমাঠের রাজা শেষ করেন এই ভাবে—‘‘কাল যদি আমরা জিততে পারি, তা হলে দেশের ৪০ লক্ষ লোক রাস্তায় নেমে আনন্দ করবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যারা ক্রোয়েশিয়ার জার্সি পরে এখন ঘুরছে তারা আনন্দ পাবে। সবাই আমাদের হাতে প্রথম বিশ্বকাপটা দেখতে চাইছে। আমরা একটা দল হিসেবে নামব। এই দিনটা স্মরণীয় করে রাখতেই হবে।’’

লুকার সঙ্গে উগো লরিসের শরীরী ভাষার কোনও মিল নেই। অনেক শান্ত। খোঁচা মারা প্রশ্নেও মুখ থেকে হাসি সরে না ফ্রান্স অধিনায়কের!

কিলিয়ান এমবাপের দুর্দান্ত গতি কি ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণকেও ভেঙে চুরমার করে দেবে? ফ্রান্স অধিনায়ক মাঠে যেভাবে শরীর ছুঁড়ে অসাধারণ সব গোল বাঁচান, সে রকমই দিলেন উত্তরটা। ‘‘কাল সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি আমিও (হাসি)। এমবাপে আমাদের দলের বিস্ময় বালক। ক্রোয়েশিয়া মেসি বা হ্যারি কেনকেও আটকেছে। দেখি ওরা কী করে,’’ বললেন লরিস।

পর-পর তিনটি ম্যাচে ১২০ মিনিট করে খেলেছে ক্রোয়েশিয়া। আপনারা একদিন বেশি বিশ্রাম পেয়েছেন। এটা তো আপনাদের সুবিধা? লরিস প্রশ্নটা শেষ করতে না দিয়ে বলে ওঠেন, ‘‘এটা বিশ্বকাপ ফাইনাল। এখানে সবাই সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করে। কেউ পিছিয়ে থাকতে চায় না। ক্রোয়েশিয়া শক্তিশালী দল। অনেক অভিজ্ঞ ফুটবলার আছে টিমে। ওরা ক্লান্ত হয় না।’’

ক্রোয়েশিয়াকে বলা হয় ইউরোপের যোদ্ধার দেশ। আর ফ্রান্সের পরিচিতি ছবি ও কবিতার সাম্রাজ্য হিসাবে। আজ রবিবার রাতে ফুটবলের সেরা মঞ্চে এ সবের প্রভাব পড়বেই। আগের দিন দুই অধিনায়কের শরীরী ভাষায় যা আরও স্পষ্ট। ফ্রান্সের গতিশীল, শিল্পের ফুটবলের সামনে ক্রোয়েশিয়ার প্রধান অস্ত্র হার-না-মানা মনোভাব।

শক্তির ফুটবলে ক্রোটরা অদম্য। দু’দিন আগে ইংল্যান্ড সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। ফ্রান্স কী করবে? হুগো লরিস, গ্রিজম্যানদের দেশে শনিবার ছিল বাস্তিল দূর্গ পতনের বাৎসরিক উৎসব। প্যারিসের রাস্তায়, আইফেল টাওয়ারের সামনে অসংখ্য মানুষ মেতেছিলেন আনন্দে। সেই উচ্ছ্বাস রাশিয়ার মাটিতে আছড়ে পড়ে কি না সেটা বড় প্রশ্ন।

দেশঁর হাতে এমবাপের গতি, গ্রিজম্যানের সেট পিস আর পল পোগবার মতো পাসার আছে। তেমনই জ্লাটকো দালিচের হাতে আছে ইভান পেরিসিচ, মারিয়ো মাঞ্জুকিচের মতো ফরোয়ার্ড। যে কোনও জায়গা থেকে গোল করে যেতে পারেন তাঁরা। দু’জনেই হেডে খুব শক্তিশালী। তবে হাতে যে অস্ত্রই থাকুক, মনে হচ্ছে, লেনিনের দেশের মাটিতে হওয়া ফাইনালে আক্রমণের ঢেউ তুলতে চাইবে না কোনও দলই। রক্ষণ আঁটোসাঁটো করে পাল্টা আক্রমণে যাওয়ার কৌশলই নিতে চাইবেন দুই কোচ। আর এ জন্য যে কাজটা সব চেয়ে জরুরি তা হল, মাঝমাঠের দখল নেওয়া। সেখানে অপেক্ষা করছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি। ক্রোয়েশিয়ার রিয়াল-বার্সা যুগলবন্দি লুকা মদ্রিচ আর ইভান রাকিতিচের সঙ্গে মাঝমাঠের লড়াই এনগোলো কঁতে ও ব্লেজ মাতুইদির।

ফ্রান্সের অনুশীলনে দেখলাম উঁচু বল এলে কী ভাবে তা সামাল দেওয়া হবে, তার প্রস্তুতি চলছে। মদ্রিচ বা রাকিতিচ উঁচু করে যে বলগুলি তোলেন, তা থেকেই গোল করেন পেরিসিচরা। সেটা হতে দিতে চান না দিদিয়ে দেশঁ। তবে ফ্রান্সের বড় সুবিধা ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণের সমঝোতার অভাব। এমবাপের সেই ইউসেইন বোল্ট মার্কা গতি কী ভাবে সামলায় দালিচের রক্ষণ, সেটাই দেখার। লরিস এ দিন বলে দিয়েছেন, ‘‘রক্ষণ শক্তিশালী করলেই, যে কোনও দল জেতে। বেলজিয়াম ম্যাচ নিয়ে যে সমালোচনাই হোক আমাদের কোচ ঠিক কাজই করেছেন।’’

আর মদ্রিচ তো তাঁর দেশের কোচকে প্রশংসার বন্যায় ভরিয়ে দিয়েছেন এ দিনও। ‘‘আমরা যখন যোগ্যতা নির্ণায়ক পর্বে সমস্যায় পড়েছিলাম, তখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন উনি। সেখান থেকে দালিচ আমাদের সাহস জুগিয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন।’’

যোদ্ধা আর শিল্পীর লড়াইয়ে আরও একটা বিষয়ের দিকে সবার নজর থাকবে— বয়সের পার্থক্য। ফ্রান্স টিমটার গড় বয়স ২৩। সেখানে ক্রোয়েশিয়ার প্রথম দলের সাত জন ফুটবলারের বয়স তিরিশের কোঠায়। এমনিতে মস্কোয় এখন তেমন ঠান্ডা নেই। ফুল হাতা জামা পরে ঘুরে বেড়ানো যাচ্ছে। রাতে তা বেশ কিছুটা বাড়ছে। এ দিন অবশ্য বৃষ্টি হয়েছে। লুকা মদ্রিচ, মারিয়ো মাঞ্জুরিকরা ফুরফুরে আবহাওয়া পেয়ে টানা তিনটি ম্যাচে ৩৬০ মিনিট খেলেও
এখনও অক্লান্ত।

লুঝনিকি স্টেডিয়াম চত্বরে শনিবার সন্ধ্যায় যেন রথের মেলা বসেছে। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সামনে রাস্তার মতো দেখাচ্ছে জায়গাটা। টিকিট পাওয়ার সুযোগ নেই। হাজার হাজার মানুষ আসছেন শুধু স্টেডিয়াম ও সংলগ্ন এলাকা দেখতে, ছবি তুলতে। বিশ্বকাপের একটা বড় ‘রেপ্লিকা’ রাখা রয়েছে একটি স্পনসর কোম্পানির স্টলে। তার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন অনেকেই। লুকা বা লরিসও কিন্তু চান ও রকমই একটা ছবি তুলতে। তবে আসল কাপের সঙ্গে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE