Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
আমার মৃতদেহও আর ইডেনে ঢুকবে না: প্রবীর

লজ্জা আর কলঙ্কের চুল্লিতে ডালমিয়া স্মৃতি ম্যাচ

ক্লাবহাউসের দোতলায় চোখ যেন ধকধক করছে ঘোষিত সিএবি প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের। এক-একবার করে মাঠের ইন্সপেকশেন যাচ্ছেন আম্পায়াররা, আর সৌরভ ছুটছেন আড়াই তলার কাঁচের বড় জানালাটার দিকে। আপনাকে কেউ জানিয়েছিল যে মাঠটা সময়ে ঢাকা হয়নি? প্রশ্নটা শুনে দাঁড়িয়ে পড়লেন সৌরভ। তিতকুটে গলায় তির্যক উত্তর আসে, “যান, আগে প্রবীরবাবুকে জিজ্ঞেস করে আসুন উনি কী বলছেন। আপনাদের তো আজ ওঁর কাছ থেকে জানতে চাওয়া উচিত!”

জলকাদার ইডেনে প্রবীরের বিচরণ। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

জলকাদার ইডেনে প্রবীরের বিচরণ। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় ও রাজীব ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:১৯
Share: Save:

ক্লাবহাউসের দোতলায় চোখ যেন ধকধক করছে ঘোষিত সিএবি প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের। এক-একবার করে মাঠের ইন্সপেকশেন যাচ্ছেন আম্পায়াররা, আর সৌরভ ছুটছেন আড়াই তলার কাঁচের বড় জানালাটার দিকে। আপনাকে কেউ জানিয়েছিল যে মাঠটা সময়ে ঢাকা হয়নি? প্রশ্নটা শুনে দাঁড়িয়ে পড়লেন সৌরভ। তিতকুটে গলায় তির্যক উত্তর আসে, “যান, আগে প্রবীরবাবুকে জিজ্ঞেস করে আসুন উনি কী বলছেন। আপনাদের তো আজ ওঁর কাছ থেকে জানতে চাওয়া উচিত!”

রাত সাড়ে ন’টার সময় ইডেনের প্রবীণ কিউরেটর প্রবীর মুখোপাধ্যায়কে দেখা গেল, বাউন্ডারি লাইনের ধারের চেয়ারে। ক্রুদ্ধ গর্জন তুলছেন একের পর এক। সিএবি-র তুলোধোনা করছেন। প্রবীরকে জিজ্ঞেস করা হল, এর পর ইডেনে আর তিনি আসবেন কি না? সিএবি চাইছে, তিনি নিজে সরে যান। নইলে সরিয়ে দেওয়া হবে। কথাটা শুনে ক্ষিপ্ত প্রবীরের হিংস্র জবাব, “সিএবির লোকদের বলার জন্য আমি বসে আছি নাকি? লিখে দিন, প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের এটাই ইডেনে শেষ দিন। আমার ডেডবডিও আর ইডেনে ঢুকবে না!”

একগুঁয়ে। উদ্ধত। গোঁয়ার। বাংলা শব্দকোষ থেকে যা যা বিশেষণ পাওয়া সম্ভব, সব তুলে এনে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইডেন কিউরেটরের নামের পাশে। এবং বসাচ্ছেন সিএবি-র কর্তারা। কেউ বলছেন, তাঁর জমানা থাকলে প্রবীরকে পিচের দায়িত্বে কখনও ঢুকতেই দিতেন না। কেউ বলছেন, প্রবীর যা করে গেলেন তাতে ইডেনের কয়েক কোটি টাকা ক্ষতিতে সিলমোহর পড়ে গেল। বিমা কোম্পানি তো এর পর একটা পয়সাও ছোঁয়াবে না!

যে ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যের ম্যাচ, যে ম্যাচকে উৎসর্গ করা হচ্ছিল ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ প্রশাসকের উদ্দেশ্যে, দুপুরের মাত্র আধ ঘণ্টার বৃষ্টিতে তা দাঁড়াল বঙ্গ ক্রিকেটের অন্যতম লজ্জার ম্যাচ। ইডেন ইতিহাসের কলঙ্কের আরও এক সন্ধে। সিএবি প্রশাসনের ন্যক্কারজনক ব্যর্থতায় এবং হাতে আউটফিল্ড কভার থাকা সত্ত্বেও তা ফেলে রাখার সিদ্ধান্তে।

বৃহস্পতিবার দুপুর একটা নাগাদ যখন বৃষ্টি নামে ইডেনে স্রেফ পিচ, বোলার্স রান আপ আর প্র্যাকটিস পিচের কয়েকটা অংশ শুধু ঢাকা দেওয়া ছিল। সিএবি কর্তারা কেউ তখন নেই। সৌরভ গাড়িতে। সিএবিতে ঢুকবেন। কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে ঘুরে বেরিয়ে গিয়েছেন। ইডেন রক্ষার দায়িত্বে তখন শুধু প্রবীর মুখোপাধ্যায় এবং সিএবির গ্রাউন্ডস কমিটির চেয়ারম্যান দেবব্রত দাস। সৌরভ ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত দেবব্রত পরে বলছিলেন, ‘‘আমি শুধু প্রবীরদার পায়ে ধরতে বাকি রেখেছিলাম।’’ প্রবীর নাকি তাতে কর্ণপাত করেননি। বৃষ্টি নামতে দেখেও এতটুকু প্রয়োজন মনে করেননি গোটা মাঠটা ঢেকে ফেলার। যার পরিণতি— তিন বার মাঠ ঘুরে দেখার পর, বৃষ্টি শেষের আট ঘণ্টা পর রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রডের ঘোষণা করে দেওয়া, ম্যাচ পরিত্যক্ত। পরিণতি— প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার দীর্ঘ অপেক্ষার পর আশাহত হাজার পঁয়ত্রিশ ইডেন সমর্থকের বাড়ি ফেরা।

কিন্তু কেন হল এমন?

প্রবীরবাবু যে ব্যাখ্যা দিলেন, এক কথায় হাস্যকর। বললেন, পুরো মাঠ ঢাকার মতো তাঁর হাতে নাকি যথেষ্ট লোক নেই। মানে, মাঠকর্মী। মোটে সাতাশ জন দিয়ে তাঁকে নাকি নিত্য কাজ চালাতে হচ্ছে। বাড়তি লোকের পারিশ্রমিকের জন্য যে টাকা প্রয়োজন তা নাকি সিএবি দিতে রাজি হয়নি। যা শুনে রাতে সৌরভ বললেন, “আমি তো ওঁকে কখনও বলতে শুনিনি বাড়তি লোক প্রয়োজন। আইপিএলে তো পুরো মাঠ ঢাকার লোক ছিল। তা হলে এখন কেন থাকবে না?” সৌরভ তবু রেখেঢেকে বলছেন। বাকিরা জ্বলছেন তেলেবেগুনে। সিএবির প্রাক্তন সচিব গৌতম দাশগুপ্ত বলছিলেন, “আরে, মাঠটা তো সকাল থেকেই ঢেকে রাখা যেত। সেটা তো কেউ ওঁকে বারণ করেনি। উনি তো দেখতে পেয়েছিলেন আকাশ মেঘলা। সোজাসুজি বলছি, এর চেয়ে বড় লজ্জা সিএবিকে কখনও সহ্য করতে হয়নি। আর সেটা হল, একটা লোকের জন্য।” আর এক প্রাক্তন যুগ্ম সচিব তথা বোর্ডের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট চিত্রক মিত্র আবার সর্বসমক্ষে পত্রপাঠ প্রবীরের বিদায়ের দাবি তুলে গেলেন। বললেন, “ভাবলেই লজ্জা হচ্ছে। যে অপমান হল, তার পর এখুনি ওকে সরানো উচিত।”

সিএবির যে ব্যর্থতার পর প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে, এর পর আগামী ৩ এপ্রিল ইডেনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনাল সম্ভব কি না। অনেকের মনেই প্রশ্ন যে, ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রড এর পর আইসিসিতে কী রিপোর্ট দেন। বলাবলি চলছে, কড়া ধাতের ম্যাচ রেফারি হিসেবে পরিচিত ব্রড যদি ইডেনের পরিকাঠামো নিয়ে নেগেটিভ রিপোর্ট জমা করেন, তখন ইডেনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালের ভাগ্যে কী হবে? সৌরভ আশাবাদী, ইডেন থেকে ফাইনাল সরাবে না আইসিসি। কিন্তু তার পরেও কেউ কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, কিউরেটরের মতো বেতনভুক কর্মচারীকেই যখন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না সিএবি, তা হলে ফাইনাল সামলাবে কী করে? গভীর রাতের খবর, সিএবির এসজিএম মিটলে ইডেন-কাণ্ড নিয়ে তদন্ত কমিটি বসানো হবে। প্রবীর শুধু নন, ডাকা হতে পারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে।

প্রশাসক সৌরভকে কেউ এখনই কাঠগড়ায় তুলছেন না। তিনি সহানুভূতিই পাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর অনুগতরা নন। সংস্থার কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ বলে গেলেন, “সৌরভ একা কী করবে? ও যাদের উপর ভরসা করল, তারাই ওকে ডুবিয়ে দিল। এটা আমাদের সবার ব্যর্থতা।” সিএবি-র একাংশ বলছে, প্রবীর তো বটেই। নেপথ্য খলনায়ক হিসেবে গ্রাউন্ডস কমিটির চেয়ারম্যান দেবব্রত দাসও আছেন। তাঁর কাছে জবাবদিহি চাওয়া হলে তিনি নাকি সিএবি কর্তাদের বলেন যে, প্রবীরকে মাঠ ঢাকার কথা বলে লাভ হয়নি। পাল্টা প্রশ্ন উঠছে, সেটা হচ্ছে না দেখেও কেন উপরমহলে তা জানাননি দেবব্রত? এমনকী বোর্ডের আঞ্চলিক কিউরেটর আশিস ভৌমিককেও ছাড়া হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, বৃষ্টির সময় ইডেনে তিনিও ছিলেন। পদে তিনি প্রবীরের উপরে। তা হলে তিনি কেন কিছু করলেন না? আর প্রবীর? তাঁকে নাকি সকাল থেকেই সৌরভ বারবার ফোন করে গিয়েছেন মাঠ নিয়ে। অবিরত বলা হয়েছে যে, আপনি মাঠটা ঢাকুন। প্রবীর পাত্তাও দেননি। কেউ কেউ বললেন, ওই দুপুর একটা নাগাদ সমস্ত মাঠকর্মী নাকি একযোগে খেতে চলে গিয়েছিলেন! মাঠকর্মীরা যা আবার ওড়ালেন। তাঁদের বক্তব্য, তাঁরা যা করেছেন চিফ কিউরেটরের নির্দেশে করেছেন। ততটুকুই ঢেকেছেন, যতটুকু ঢাকতে বলা হয়েছিল। অর্থাৎ— পিচ। বোলার্স রান আপ। আর দু’একটা জায়গা!

গভীর রাতে দেখা গেল, সৌরভ-সহ পাঁচ সিএবি কর্তা ড্রেসিংরুম লনের সামনে বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো দাঁড়িয়ে। শোনা গেল, বিপর্যয়ের ময়নাতদন্ত চলছিল। কিন্তু তাতে তখন আর লাভ কী? চুরাশি বছরের ইডেন কিউরেটরও ততক্ষণে মৌখিক ইস্তফা দিয়ে ইডেন ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। ভগ্নপ্রায় অবস্থায়, বিধ্বস্ত চেহারায়।

পুরনো বন্ধুর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে ইডেনে এ দিন এসেছিলেন পঞ্জাব ক্রিকেট সংস্থার চেয়ারম্যান আইএস বিন্দ্রা। সন্ধেয় কর্পোরেট বক্সের বাইরে ডালমিয়া প্রসঙ্গ উঠতে ঝরঝর করে কাঁদতে দেখা গেল বিন্দ্রাকে। ইডেনে উত্তরসূরিদের অবস্থা দেখে তাঁর বন্ধুর আত্মাও কি যন্ত্রণা কম পেল? ম্যাচের ধ্বংসস্তুপে ডালমিয়াকে নিয়ে তথ্যচিত্র দেখানো হল। নেলসন ম্যান্ডেলার পুরনো ইডেন-বক্তৃতা চালানো হল। গেটে-গেটে তাঁর ছবি থাকল। সিএবিতে তাঁর ঘর ঢেকে দেওয়া হল ফুলে। বিশাল ছবিতে। কিন্তু লাভ কী হল? এত আয়োজনের পর লজ্জা ছাড়া আর কিছু তিনি পেলেন কি?

ক্রিকেট ডালমিয়ার ধর্ম ছিল। ইডেনে সেই ক্রিকেটটাই তো হল না।

ছবি: উৎপল সরকার, শঙ্কর নাগ দাস ও নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE