Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Diego Maradona

‘এমন দেশভক্ত দেখিনি’

আসলে মারাদোনা নামটার মধ্যেই একটা আবেগ জড়িয়ে রয়েছে।

বুয়েনস আইরেসে মারাদোনার বাড়ির সামনে সমর্থকদের ভিড়। ছবি এএফপি।

বুয়েনস আইরেসে মারাদোনার বাড়ির সামনে সমর্থকদের ভিড়। ছবি এএফপি।

জোয়াকিন সাইমন পেদ্রোস
বুয়েনস আইরেস শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২০ ০৪:৫৮
Share: Save:

দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা শুধু কিংবদন্তি ফুটবলার নন। লড়াইয়ের প্রতীক। দুপুর বারোটা নাগাদ আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনের এক আধিকারিক যখন ফোন করে মারাদোনার প্রয়াণের খবরটা দিলেন, বিশ্বাসই হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, কেউ আবার গুজব রটিয়েছে। এর আগেও অনেক বার এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। দ্রুত টেলিভিশন অন করতেই ধাক্কা খেলাম। ফুটবল ঈশ্বর আর নেই।

এখন প্রায় বিকেল চারটে। গোটা বুয়েনস আইরেস শহরটা শোকস্তব্ধ। শপিং মল, দোকান সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একটু আগেই মারাদোনার বাড়ির সামনে গিয়েছিলাম। ইতিমধ্যেই কয়েক হাজার মানুষের ভিড় জমে গিয়েছে। সংখ্যাটা দ্রুত বাড়ছে। আমি মানসিক ভাবে এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, বাড়ি ফিরে এলাম।

নভেম্বরের শুরুতে যখন মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন মারাদোনা, করোনাভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্ক উপেক্ষা করেই সারা রাত অসংখ্য মানুষের সঙ্গে বাইরে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেছিলাম। যে দিন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন, মনে হচ্ছিল যেন আরও এক বার বিশ্বকাপ জিতলাম। মনে পড়ে যাচ্ছিল ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে ট্রফি নিয়ে মারাদোনা-বাহিনীর বুয়েনস আইরেসে ফেরার দৃশ্য। আমি তখন যদিও বেশ ছোট ছিলাম। তবুও সব মনে আছে।

আরও পড়ুন: একই ম্যাচে নিন্দিত ও প্রশংসিত, ফুটবলার হিসাবে যতটা সফল কোচিংয়ে ততটাই ব্যর্থ রাজপুত্র

আসলে মারাদোনা নামটার মধ্যেই একটা আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। এবং এটা শুধু আর্জেন্টিনাবাসীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে উদ্বেলিত করে।

পেশাগত কারণে আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে আমার সর্বক্ষণ যোগাযোগ রাখতে হয়। ফলে বেশ কয়েক বার মারাদোনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। এ রকম অদ্ভুত মানুষ আমি কখনও দেখেনি। বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার। তাঁকে একবার দেখার জন্য মানুষ জীবনের বাজি পর্যন্ত রাখতে রাজি। তারকারা সাধারণত সচেতন থাকেন নিজের ভাবমূর্তি নিয়ে। মারাদোনা ব্যতিক্রম। বুয়েনস আইরেসে মারাদোনা যেখানে থাকতেন, আমার বাড়ি সেখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। মাত্র আধ ঘণ্টার দূরত্ব। প্রায়ই ওঁর বাড়ির সামনে চলে যেতাম। কখনও দেখতাম লনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কখনও আবার বন্ধু-বান্ধব জুটিয়ে খোশমেজাজে আড্ডা দিচ্ছেন।

আরও পড়ুন: নায়ক, ফুটবলের ব্যাড বয়... সব বিতর্ক পেরিয়ে মারাদোনা শুধুই এক কিংবদন্তি

আর্জেন্টিনা বা ফিদেল কাস্ত্রো সম্পর্কে কেউ নেতিবাচক মন্তব্য করলেই প্রতিবাদে গর্জে উঠতেন মারাদোনা। ওঁর অতি ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘‘দিয়েগোর সব চেয়ে বড় শত্রু ওর আবেগ। এত বড় তারকা হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে পরিবর্তন করতে পারেনি। ওকে বহুবার বলেছি, বিশ্বের মানুষ তোমাকে ঈশ্বর জ্ঞানে পুজো করেন। প্রকাশ্যে তোমার সংযত হওয়া উচিত। ভেবে-চিন্তে কথা বলা উচিত। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বলত, বন্ধু যারা সফল হওয়ার পরে নিজেকে বদলে ফেলে, তাদের মেরুদণ্ড নেই। আমি চে, কাস্ত্রোর ভক্ত। প্রতিবাদ আমার রক্তে। যারা লড়াই করে আমি সব সময় তাদের পাশে থাকি। তাতে যে যা খুশি মনে করে করুক।’’

মারাদোনার মতো দেশভক্ত খুব কম দেখেছি। ফুটবল, টেনিস থেকে বেসবল— আর্জেন্টিনার প্রতিনিধিত্ব করা মানেই প্রচণ্ড উত্তেজিত। এক বার ওঁর দেওয়া সময়ে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ঘরে ঢুকেই চমকে গিয়েছিলাম। দেখলাম, আমাদের জাতীয় পতাকা গায়ে জড়িয়ে টিভিতে ডেভিস কাপের ম্যাচ দেখছেন। কথা বলার চেষ্টা করতেই ধমকে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘চুপ করে বসে খেলা দেখো। এখন কোনও কথাবার্তা হবে না। আমরা জিতলে তবে কথা বলব।’’

আরও পড়ুন: আমার হেড আর হ্যান্ড অব গডেই গোল, বলেছিলেন মারাদোনা

মারাদোনার মনটা ছিল শিশুর মতো। সব সময়ই মুখে সারল্যের হাসি লেগে থাকত। হাসপাতাল থেকেও সে দিন হাসিমুখেই বেরিয়েছিলেন। বিশ্বাস ছিল, দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন মারাদোনা। কাকতালীয় ভাবে ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যুদিনেই আমাদের কাদিয়ে চলে গেলেন ফুটবল ঈশ্বর!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE