জিমন্যাস্ট দীপার আঁতুড়ঘরের পাশেই তৈরি ব্যানার। আগরতলায় শনিবার। ছবি: বাপি রায়চৌধুরী।
সোনালি স্বপ্নের রোদ যেন প্রবল উৎকণ্ঠার মেঘে ঢাকা!
অটুট বিশ্বাসের আগুনে আছড়ে পড়ছে আশঙ্কার ঢেউ!
আস্থার মধ্যে লেপ্টে অদৃশ্য আতঙ্কের ছায়া!
উজান অভয় নগরের বাসিন্দাদের মুখগুলোয় দু’রকম ছবি ভেসে উঠলেও, তাঁদের হৃদয়ে এখন একটাই নাম— দীপা কর্মকার।
বাবার আদরের ‘গুড্ডু’ এবং মায়ের সবচেয়ে কাছের বান্ধবী ‘টিনা’ আর কর্মকার পরিবারের ছোট্ট সাদামাঠা মেয়ে নেই! দীপা এখন গোটা আগরতলার সম্পদ। পাড়ার মুদির দোকানের জেঠু থেকে শুরু করে সূর্যচৌমণির সেই পরোটার দোকানের কাকু, সবাই প্রার্থনায় ডুবে— হে ঠাকুর, আমাদের মেয়েটা যেন পদক জিতে ফিরতে পারে!
শনিবার সকাল থেকেই উৎসবের মেজাজে আগরতলা। দীপার বাড়ির সামনে ছবি, জায়ান্ট স্ক্রিন লাগানোর কাজ তো চলছেই, শহরের বিভিন্ন মন্দিরেও পুজো দেওয়ার ধুম জোরকদমে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে শুভেচ্ছা বার্তার পোস্টার। চায়ের দোকান, হাট-বাজার সর্বত্র একটাই আলোচনা— দীপা কর্মকার। তবে গোটা আগরতলাবাসীর উৎসাহ-উৎকণ্ঠার সঙ্গে বোধহয় এক জনের আবেগকে কিছুতেই মেলানো যাবে না।
সারাক্ষণ জানলার দিকে তাকিয়ে। দু’টো চোখ অনবরত খুঁজে চলেছে কাউকে। কিন্তু পেয়ারা গাছের ডালটা জানলাটাকে এমন ভাবে আষ্টেপৃষ্টে পাহারা দিচ্ছে যে, বাইরের রাস্তায় চোখ রাখার উপায় নেই। তা-ও যতটুকু ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা যায় আর কী! পাড়ার মন্দিরের দিকে কোনও পূণ্যার্থীকে ঈশ্বর-নাম করতে করতে যেতে দেখলে, মুহূর্তে তিনি স্থির। তার পর চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণের প্রার্থনা।
কী চাইলেন ঈশ্বরের কাছে? প্রশ্ন করতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন দীপার মা গৌরীদেবী। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘‘মেয়ের সুস্বাস্থ্য কামনা করলাম। বাড়িতও হনুমানজির পুজো করছি। টিনা যে ভল্টটা দিতে চলেছে সেটা বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ভল্ট। তাই পদক আসুক বা না আসুক, আমার মেয়ের যেন কোনও ক্ষতি না হয়।’’ দীপার মতোই হাসি-খুশি মুখটা হঠাৎ গম্ভীর। চোখ ছলছল। মায়ের অন্দরমহলে কালবৈশাখী বইছে যে। আর রবিবার রাতের আগে সেটা থামবে বলেও মনে হয় না!
দীপার আরও দু’জন ‘মা’য়েরও অনেকটা একই রকম অবস্থা। এক জন জীবনের প্রথম স্পোর্টস শিক্ষিকা নিয়তি দেবনাথ। অন্য জন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা শোভনা দত্ত। আগরতলার সোনার মেয়েকে তাঁরা জন্ম না দিলেও, দীপার কাছে তাঁরা মায়ের চেয়ে কম নন। নিয়তিদেবী যেমন বলছিলেন, ‘‘দীপার জন্য শোভনাদির সঙ্গে কত লড়াই না করেছি। ওকে প্র্যাকটিসে ছাড়তে চাইতেন না। বলতেন, ওকে ছাড়লে তো বাকিরাও সুযোগ নিতে চাইবে। তখন বোঝাতাম, দীপা আর বাকিরা এক নয়।’’ শোভনাদেবী অবশ্য আরও সার্টিফিকেট দিলেন দীপাকে। বললেন, ‘‘স্পোর্টসম্যানরা দেখেছি পড়াশুনায় ভাল হয় না। পাশ করানোর জন্য এ দিক ও দিক থেকে নম্বর দিতে হয়। কিন্তু ওকে কোনও দিন দয়া করতে হয়নি।’’
দুই শিক্ষিকার মুখে আরও যে সব গল্প শোনা গেল, তাতে একটা কথা বলা যেতেই পারে— দীপা সবার থেকে আলাদা। বাড়িতে ট্রফি আর পদক রাখার জায়গা নেই ত্রিপুরার অন্যতম জনপ্রিয় কন্যার। তবু বাড়ি ফিরলেই ভাগ্নের সঙ্গে খুনসুটি করতে হাঁপান না। আর পাঁচটা সাধারণ ঘরের মেয়ের মতো টিভি-তে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে ভোলেন না। ফাস্ট ফুডের ভক্ত সময় পেলেই বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। পরোটা আর তরকারির লোভে। নিয়তিদেবী বলছিলেন, ‘‘দীপার মধ্যে কোনও অহংকার নেই। আমার মনে আছে, একটা সময়ের পর ওকে স্কুল স্পোর্টসে অংশ নিতে বারণ করে দিয়েছিলাম। কেন না যে ইভেন্টেই ও নামত, চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেত। তবে ওকে যে আমি বারণ করেছিলাম, তাতে ও কোনও সময় দাম্ভিক হয়ে পড়েনি। ভাবত না যে আমিই সেরা।’’
যোগ্যতার পাশাপাশি দীপার ব্যবহারই তাঁর জনপ্রিয়তার সবচেয়ে বড় টিআরপি। যেখান থেকে দীপার যাত্রা শুরু সেই বিবেকানন্দ ব্যায়ামাগারের সামনে একটা দশ ফুটের ছবি টাঙানো হয়েছে। ভিতরেও অজস্র শুভেচ্ছাবার্তা। যাতে লেখা— বিশ্বজয় করে এসো তুমি।
ইতিহাস গড়ে অলিম্পিক্স পদক নিয়ে দীপা ফিরতে পারবেন কি না, সেটা সময় বলবে। তবে অলিম্পিক্সের মঞ্চ দীপার একটা আফসোস চিরতরে মুছে দেবে। যে আফসোস নিয়ে একটা সময় রাস্তায় বেরোতে পারতেন না। লজ্জায়। কখনও রাগেও। আসলে কিছু লোকের মানসিকতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারতেন না। লোকে যে ঠাট্টা করত। বলত, ধুর মেয়েটা তো আসলে সার্কাস করে! জিমন্যাস্টিক্স আবার কী?
সোমবার থেকে অন্তত জিমন্যাস্টিক্স আর সার্কাসকে মেলানোর কেউ সাহস পাবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy