বত্রিশ বছর আগে সারা দেশের সঙ্গে যন্ত্রণাকাতর হতে হয়নি তাঁকে। দীপা কর্মকার তখন জন্মাননি।
গল্প শুনেছেন বড় হয়ে, ১৯৮৪-র লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক্সে এক ভারতীয় তরুণীকে ঘিরে কেমন তীব্র আশার ঢেউয়ে দুলছিল দেশের অলিম্পিক্স-স্বপ্ন। ৪০০ মিটার হার্ডলসে সেই তরুণী চতুর্থ হয়ে শেষ করেন। তাঁর ও অলিম্পিক্স ব্রোঞ্জের মধ্যে ফাঁক ছিল এক সেকেন্ডের একশো ভাগের এক ভাগ।
সেই তরুণী আজ ৫২। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা অ্যাথলিট তিনি। শুক্রবার সকালে রিওর গেমস ভিলেজে পৌঁছেই চলে এলেন দীপার ঘরে। ত্রিপুরার ২৩ বছরের বাঙালিকে বললেন, ‘‘তুমি পারবে। তুমি আমাদের গোল্ডেন গার্ল! তোমার হাতে পদক দেখতে চাই! আমি অপেক্ষায় থাকব।’’
পদক দেখতে চান! আমার পদকের অপেক্ষায় থাকবেন স্বয়ং পিটি উষা! দীপা তখন কেমন এক ঘোরে!
পরে অনুশীলনে বেরোনোর মুখে দীপা বলছিলেন, ‘‘উষার গল্প শুনেছি অনেক বার। কিন্তু চোখে দেখলাম এই প্রথম। উনি যখন বলছেন, মনে হচ্ছে পারব।’’ প্রথম ভারতীয় জিমন্যাস্ট হিসেবে অলিম্পিক্সে যাওয়া এবং ফাইনালে ওঠা মেয়ে এখন জানেন, ১৪ অগস্ট তাঁর জন্য দমবন্ধ করে রাত জাগবে দেশ। বত্রিশ বছর আগে উষা পারেননি। তাঁকে পারতেই হবে।
এই জেদটাই এখন তাড়া করে ফিরছে দীপাকে। কোচ বিশ্বেশ্বর নন্দী বলছিলেন, ‘‘প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠে ও আমার ঘরে আসে। তার পর একটা কথাই বলে, ‘স্যার আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা করবই। দেখবেন, আমি একটা মেডেল পাবই। কেউ আটকাতে পারবে না। প্রথম ভল্টটা শুধু ঠিক করতে হবে’।’’ আর দীপা বলছিলেন, ‘‘মাঝখানে সাত দিন সময় পেয়ে যাওয়ায় আমার একটা বাড়তি সুবিধে হয়েছে। ভুলগুলো শুধরে নিতে পারছি। সেগুলো ঠিক করতে পারলে পদক পাবই।’’
এই সাত দিন ছাত্রীকে কঠিন বাঁধনে বেঁধে দিয়েছেন স্যার। সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে সওয়া ৮টার বাস ধরে অলিম্পিক্স প্র্যাকটিস পার্ক। সেখানে আড়াই ঘণ্টা কাটিয়ে স্নান সেরে ডাইনিং হল। ঘণ্টা দুয়েকের বিশ্রাম। তার পর কিছু খেয়ে নিয়ে আবার সাড়ে তিন ঘণ্টা অনুশীলন। ফিরে এসে ইউটিউব নিয়ে বসা। প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধরে ধরে বিশ্লেষণ। নিজের ভুলত্রুটি
শুধরে নেওয়ার হোমওয়ার্কটাও চলতে থাকে এই সময়। রাত সাড়ে ৯টায় ঘুম। পরের দিন আবার একই রুটিন।
এই কড়া শিডিউলের জন্যই উসেইন বোল্ট আর মাইকেল ফেল্পসের সঙ্গে তাঁর নিজস্বী তোলা হয়ে ওঠেনি। আরও কত কী করা বাকি! দীপা বলেন, ‘‘আমি একটু আইসক্রিম খেতে ভালবাসি। কত রকম আইসক্রিম এখানে। পার্কে ঘোড়ায় চড়া যায়। আমাদের কাছে পাসও আছে। কিন্তু স্যার আমাকে কিছুই করতে দিচ্ছেন না। বলছেন যা করব, সব ১৫ তারিখ থেকে। অনেক সময় আছে।’’
ছাত্রীর অভিমান শুনে হাসেন কোচ বিশ্বেশ্বর। তার পর বলেন, ‘‘আমি ওকে বলেছি, ২১ তারিখ পর্যন্ত আমরা এখানে থাকব। সব দেখব তোকে নিয়ে। কিছু বাদ রাখব না। ও মেনে নিয়েছে। আসলে ও তো কিছুই চায় না। তাই কিছু চাইলে যদি সেটা না দিতে পারি, খারাপ লাগে।’’ আর সঙ্গে সঙ্গে দীপা বলে ওঠেন, ‘‘আইসক্রিম খেয়ে অসুস্থ হয়ে গেলে তো সমস্যা হবেই। এ রকম সুযোগ আর কখনও পাব না।’’ আর সেল্ফিগুলো? দীপা হাসেন, ‘‘সময় আছে। আগে পদক জিতি, তার পর ছবি তুলব।’’
অলিম্পিক্সের পরে আগরতলায় ফিরেই বসতে হবে এমএ পরীক্ষায়। তার পর আবার বিদেশ সফর। এত চাপের ফাঁকে দম ফেলবেন কী করে? এখনকার মতোই জোকস শুনে আর মোবাইলে মজার ভিডিও দেখে?
আপাতত ছাত্রীর মনে অন্য একটা ‘ভিডিও’ চালিয়ে রেখেছেন কোচ। ‘‘ডাইনিং হলে বিশাল একটা স্ক্রিন আছে’’— বিশ্বেশ্বর বলে চলেন, ‘‘যখনই কেউ মেডেল পাচ্ছে, দীপাকে ডেকে দেখাচ্ছি। বলছি, ওই ভিকট্রি স্ট্যান্ডে উঠতে হবে তোকে। চুমু খেতে হবে মেডেলে। গেরুয়া-সাদা-সবুজ জাতীয় পতাকা উঠবে। বাজবে জনগণমন। পারবি না উঠতে?
পারবি, পারবি।’’
দীপার কোচের গলা ছাপিয়ে জেগে উঠতে থাকে খ্যাপাটে একটা লোক। সুইমিং পুলের পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে গলা ফাটিয়ে। আর তার ছাত্রী, তার শেষ যুদ্ধের পাশুপত জল কেটে চলেছে প্রাণপণ—
‘কোনি’ আর ‘ক্ষিদ্দা’!
ফাইট দীপা, ফাইট!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy