Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মলিনার পিছনে থাকল না হাবাস-ছায়া

হাবাস যখন এ বছরও কোচিং করার জন্য প্রায় দেড় গুণ টাকা হেঁকেছিলেন, সে সময় দিনকয়েক দু’তরফের চিঠি চালাচালির পর তাঁকে বদলে ফেলার জন্য আটলেটিকো মাদ্রিদ কর্তাদের সবুজ সঙ্কেত দিয়েছিলেন এখানকার কর্তারা। হাবাসের বায়নাক্কা আর সহ্য হচ্ছিল না কলকাতা কর্তাদের।

ট্রফির রং ফের লাল-সাদা। রবিবার কোচিতে। ছবি: পিটিআই

ট্রফির রং ফের লাল-সাদা। রবিবার কোচিতে। ছবি: পিটিআই

রতন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৪:০৭
Share: Save:

হাবাস যখন এ বছরও কোচিং করার জন্য প্রায় দেড় গুণ টাকা হেঁকেছিলেন, সে সময় দিনকয়েক দু’তরফের চিঠি চালাচালির পর তাঁকে বদলে ফেলার জন্য আটলেটিকো মাদ্রিদ কর্তাদের সবুজ সঙ্কেত দিয়েছিলেন এখানকার কর্তারা। হাবাসের বায়নাক্কা আর সহ্য হচ্ছিল না কলকাতা কর্তাদের।

বিপণনে ক্ষতি হবে, সমালোচনার মুখে পড়তে হতে পারে ভেবে প্রথম বছরের চ্যাম্পিয়ন কোচকে এ বার ঝুঁকি নিয়েও বিদায় করে দেওয়া হয়েছিল দু’টো কারণে।
এক) এটিকে টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে প্রধান হয়ে উঠেছিল ড্রেসিংরুমে শান্তি বজায় রাখা। যে ভাবে হোক টিমে শৃঙ্খলা ফেরানো। হাবাস জমানার শেষ দিকে প্রতিদিন যা নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হত কর্তাদের।
দুই) টিমের স্প্যানিশদের সঙ্গে ভারতীয়দের একটা বিভেদ তৈরি হয়েছিল। নির্দিষ্ট কিছু ফুটবলারকে জার্সিই দিতেন না হাবাস। সে সব বন্ধ করতে চেয়েছিলেন এটিকে কর্তারা। তবে আসল হল, হাবাসকে তাঁদের সরাতে সুবিধে হয়ে গিয়েছিল তিনি নতুন চুক্তির জন্য প্রচুর বেশি টাকা দাবি করায়।

ভাইচুং ভুটিয়ার মতো কারও উপর নির্ভর না করে আই লিগ ও ঘরোয়া টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স দেখে এ বার বাছা হয়েছিল দেবজিৎ, জুয়েল, প্রীতম, প্রবীরদের। কারণ আগের দু’বছরের অভিজ্ঞতায় এটিকে কর্ণধার সঞ্জীব গোয়েন্কার ধারণা হয়, ভাইচুং বা কোনও একজনের উপর ভারতীয় ফুটবলার বাছাইয়ের দায়িত্ব দিলে ‘ভালবাসা’ প্রাধান্য পায়। যে সুযোগে দলে ঢুকে পড়ে লাখ লাখ টাকা নিয়েছেন রাকেশ মাসি, সুশীল সিংহ, রহিম নবির মতো বাতিল ফুটবলাররা। তাতে আসল ক্ষতিটা হচ্ছিল টিমের। কোচের হাতে পরিবর্ত কমে যাচ্ছিল। তবে বিদেশি বাছা হয়েছিল মাদ্রিদ কর্তাদের মাধ্যমেই।

মার্কি বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও দিয়েগো ফোরলানকে প্রায় পাকা করেও তিনি বেশি টাকা দাবি করায় নেওয়া হয়নি। ফিরিয়ে আনা হয় আগের বার ব্যর্থ হেল্ডার পস্টিগাকেই। পারফরম্যান্সের পাশাপাশি তিনি একজন প্রকৃত টিমম্যান হওয়ার কারণে। এবং তাঁকে নেওয়ার সময় কথা বলে নেওয়া হয়েছিল নতুন কোচ জোসে মলিনার সঙ্গে।

সবথেকে বড় কথা, এ বার টিম ম্যানেজমেন্টে করা হয়েছিল বড়সড় পরিবর্তন। আরও কড়া কর্পোরেট কালচার ফিরিয়ে আনা হয়েছিল টিমের অন্দরে। আগের দু’বারের মাথাভারী প্রশাসন কমিয়ে মাত্র দু’-তিন জনের উপর দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়েছিল টিম-প্রশাসনের। শুধু তাই নয়, টিমের চার মালিক এখানে থাকা সত্ত্বেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেন স়ঞ্জীব গোয়েন্কা স্বয়ং। তা সেটা কোচের পদে মলিনার নির্বাচন হোক, বা পস্টিগাকেই ফের মার্কি ফুটবলার করা। গত তিন মাস মাঝেমধ্যেই সঞ্জীব গোয়েন্কা তাঁর ধর্মতলার অফিসে মলিনার সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন। জানতে চেয়েছেন কোনও সমস্য হচ্ছে কি না। বারবার কোচকে বলেছেন, ‘‘টিম নিয়ে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আপনি নেবেন। কেউ মাথা গলাবে না। কোনও সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন।’’ ফিরতি সেমিফাইনালে একসঙ্গে ন’জন ফুটবলার পাল্টে দেওয়ার পর কর্তাদের কেউ কেউ মলিনাকে ‘অ্যাডভেঞ্চার কোচ’ বললেও টিমের কর্ণধার পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন কোচের। ফাইনালের আগের দিন তাই মলিনাকে কোচি থেকে ফোনে বলতে শুনেছি, ‘‘মালিকরা খুশি হলেই সবাই খুশি থাকবে। কলকাতায় কোচিং করতে এসে চ্যাম্পিয়ন হতে পারি বা না পারি, আমি কিন্তু খুশি।’’

তিন বারের আইএসএলে দু’বার চ্যাম্পিয়ন। আটলেটিকো দে কলকাতা-র এহেন আগুনে পারফরম্যান্সের পিছনের কারণ খুঁজতে বসলে এ সব রসায়নই আসছে সামনে।

জোসে মলিনার টিমগেমের সঠিক প্রয়োগ যদি হয় কলকাতার সাফল্যের প্রধান কারণ, তা হলে পর্দার পিছনের আসল কাজ করে গিয়েছে এটিকে টিম ম্যানেজমেন্ট। হাবাসের মতো মেজাজি নন মলিনা। শান্ত স্বভাবের। রাগেন না তা নয়, তবে রাগ পুষে রাখেন না। কর্তাদের সঙ্গে তিনি যেমন, ফুটবলার-সাপোর্ট স্টাফের সঙ্গেও তেমন। যা হাবাসের সঙ্গে মলিনার বড় পার্থক্য তৈরি করেছে।

প্রথম মরসুমে সেমিফাইনালের আগে ফিকরুর মতো গোল গেটারকে হাবাস টিম হোটেলে ঢুকতেই দেননি। কর্তারা অনুরোধ করা সত্ত্বেও। নিজের জেদ বহাল রেখেছেন। কর্তাদের মুখেই শোনা গিয়েছে, নর্থ-ইস্টের বিরুদ্ধে রবীন্দ্র সরোবরে বেলেনকোসো প্রচুর গোল নষ্ট করে দলকে ডোবালেও তাঁকে আড়াল করেন মলিনা। তাঁকে আলাদা ডেকে ভুলগুলো ধরিয়েছেন। খেলিয়েছেন সেমিফাইনালে।

ব্যারেটো বা বাস্তব রায়ের মতো সহকারীদের টিম মিটিংয়ে গুরুত্ব দিতেন না হাবাস। অনেক সময় থাকতেও দিতেন না সেই বৈঠকে। মাদ্রিদ থেকেই আসা কলকাতার আর এক স্প্যানিশ কোচ মলিনা সেখানে বিপরীত চরিত্র। নিজে অন্য হোটেলে থাকলেও সর্বদা যোগাযোগ রেখেছেন টিম হোটেলে। প্লেয়ারদের খাওয়াদাওয়া, জিম, পুল সেশন সব কিছুতেই নজর রেখেছেন নিয়মিত। টিমের স্প্যানিশরা তো বটেই, বাস্তবরাও গুরুত্ব পেয়েছেন টিম মিটিংয়ে। বিদ্যানন্দ সিংহের মতো জুনিয়র থেকে বিশ্বকাপার পস্টিগা—সবাইকে সমান চোখে দেখেছেন মলিনা।

সাধারণত সব কোচই তাঁর সব ফুটবলারকে ‘অপরিহার্য’ বলে থাকেন। কিন্তু হাবাস-সহ কোনও কোচই অন্তত ভারতের মাঠে সেই কথাকে কাজে করে দেখানোর সাহস দেখাননি। মলিনা সেই ধারণাও দলে দিয়েছেন। সেমিফাইনালে ন’জন ফুটবলারকে বদলেই নয়, সব ম্যাচেই অপ্রত্যাশিত সব বদল ঘটিয়েছেন। ফলে বোরহা ফার্নান্দেজ ছাড়া আর টিমের কোনও ফুটবলারই সব ম্যাচ খেলেননি। যা থেকে এটিকে সত্যিই একটা দল হয়ে উঠতে পেরেছে এ বার। ম্যাচের আগে সবাই তাই ধরে নিতেন, তিনি খেলবেন। আবার এ-ও ভাবতেন, রিজার্ভ বেঞ্চেও বসতে হতে পারে। ফাইনাল পর্যন্ত যা ছিল অটুট।

দেবজিৎ থেকে জুয়েল রাজা বা পস্টিগা থেকে জাভি লারা, সবাইকে ম্যাচের আগের দিন বলতে শুনেছি, ‘কাল নামব কি না কোচ জানেন’। আর মলিনা প্রতিদিন বলে যেতেন, ‘‘আমার টিমে কেউ অপরিহার্য নয়। সবাই প্রথম একাদশের ফুটবলার।’’ ফুটবল বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, যে টিম গোল খেলে রিজার্ভ বেঞ্চ মাথা চাপড়ায় আর গোল দিলে একসঙ্গে লাফিয়ে ওঠে, তাদের সাফল্য পাওয়া সহজ। সেই কারণে মলিনার টিম লিগে আটটা ড্র করা সত্ত্বেও এবং অনেকগুলো বিশ্রী গোল হজম করেও উঠে দাঁড়াতে পেরেছে বারবার। সর্ষে খেতের মতো কোচির হলুদ গ্যালারির শব্দব্রহ্মকে হারিয়ে শেষ পর্যন্ত পরেছে চ্যাম্পিয়নের মুকুটও।

রবিবাসরীয় রাতের পর হাবাস জমানা তাই ফিকে হয়ে গিয়েছে। মলিনাকে আর আগের দু’বছরের স্বদেশীয় কোচের সঙ্গে তুলনা করতে যাবে না কেউই। প্রথমবার কোচিং করতে এসেই কলকাতাকে চ্যাম্পিয়ন করে মলিনা মুছে দিয়েছেন হাবাস ছায়া। যা আর তাঁর পিছু নেবে না কোনও দিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Atletico de Kolkata ISL 2016 Jose Molina
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE