Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

দ্যুতিকে বাঁচিয়ে বঙ্গকন্যার লড়াই সেমেনিয়াদের জন্য

শরীর মহিলার। কিন্তু দেহে পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরনের আধিক্য। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘হাইপারঅ্যান্ড্রোজিনিজ়ম’।

ভরসা: দ্যুতিচন্দের সাফল্যের নেপথ্যে কলকাতার পয়োষ্ণী (বাঁ দিকে)। নিজস্ব চিত্র

ভরসা: দ্যুতিচন্দের সাফল্যের নেপথ্যে কলকাতার পয়োষ্ণী (বাঁ দিকে)। নিজস্ব চিত্র

দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৪:৪৭
Share: Save:

শরীর মহিলার। কিন্তু দেহে পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরনের আধিক্য। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘হাইপারঅ্যান্ড্রোজিনিজ়ম’।

ঠিক এই কারণেই চার বছর আগে কমনওয়েলথ গেমস থেকে বাদ পড়ায় অন্ধকার নেমে এসেছিল ভারতীয় অ্যাথলিট দ্যুতি চন্দের জীবনে। চার বছর পরে এ বারের এশিয়ান গেমস থেকে সেই দ্যুতিই দেশকে জোড়া পদক এনে দিয়ে গড়েছেন নতুন নজির।

পি টি উষার ৩২ বছর পরে এশিয়ান গেমসের ১০০ মিটার থেকে রুপো, আর ১৬ বছর পরে ২০০ মিটারে দেশকে রুপো দিয়েছেন ওড়িশার এই অ্যাথলিট। তাঁকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত ভিভিএস লক্ষ্মণ, সচিন তেন্ডুলকর, পি ভি সিন্ধু, গোপীচন্দরা। সংবর্ধনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও।

কিন্তু দ্যুতি চন্দ এই সাফল্য উৎসর্গ করছেন এক বঙ্গললনাকে। তিনি পয়োষ্ণী মিত্র। এ বারের এশিয়ান গেমসে তাঁর সাফল্য নিয়ে আলোচনা শুরু হতেই দ্যুতি বলে দেন, ‘‘এই জোড়া রুপোর পদক উৎসর্গ করছি পয়োষ্ণী ম্যাডামকে। উনি আমার হয়ে না লড়াই করলে এশিয়াডেই নামা হত না।’’

কে এই পয়োষ্ণী? দ্যুতি চন্দ তাঁর সাফল্যের নেপথ্য কাহিনি শোনাতে গিয়ে বলেন, ‘‘চার বছর আগে শরীরে পুরুষ হরমোনের আধিক্য থাকায় গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসে নামা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিক্স সংস্থার নিয়মের ফাঁসে। মনে হয়েছিল অ্যাথলিট জীবনটা শেষ। ঠিক সেই সময়ে ঈশ্বরের মতো উদয় হন পয়োষ্ণী ম্যাডাম।’’ দ্যুতি বলে চলেন, ‘‘উনিই নিজের উদ্যোগে ওড়িশায় আমার গ্রামে এসে কথা বলেন। তার পরে ভারত সরকারের তরফে পরামর্শদাতা হিসেবে লোজানের ক্রীড়া-আদালতে চ্যালেঞ্জ করেন আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের নিয়মকে। যে নিয়মে বলা ছিল, মহিলা অ্যাথলিটদের শরীরে পুরুষ হরমোনের মাত্রা বেশি থাকলে হয় ওষুধ খেয়ে তা কমাতে হবে। না হলে পুরুষদের বিভাগে নামতে হবে। সেই মামলা জেতায় আমি এশিয়ান গেমসে নামতে পেরেছি।’’

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, বেহালার বাসিন্দা পয়োষ্ণী এই মুহূর্তে কর্মসূত্রে ইংল্যান্ডে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে খেলোয়াড়দের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন তিনি। রবিবার তাঁকে যখন ফোনে যোগাযোগ করা হল, তিনি তখন ওভালে হাজির ভারত বনাম ইংল্যান্ডের পঞ্চম টেস্ট ম্যাচ দেখতে। দ্যুতি তাঁকেই এই সাফল্য উৎসর্গ করেছেন শুনে বলছেন, ‘‘রুপো জয়ের পরেই কথা হয়েছে। ওঁকে বলেছি, এ বার অলিম্পিক্সের পদক আনতে হবে। ও আমার সন্তানের মতো।’’

বিরাট কোহালি-জো রুটদের দ্বৈরথ দেখার মাঝেই পয়োষ্ণী বলছিলেন, ‘‘ওই বিপর্যয়ের সময় শুরুতে আমাকে বিশ্বাস করতে পারছিল না দ্যুতিরা। বাধ্য হয়ে যোগাযোগ করি সাইয়ের তৎকালীন ডিরেক্টর জেনারেলের সঙ্গে। ভারত সরকার এর পরে আমাকে দ্যুতির পরামর্শদাতা ঘোষণা করে। তার পরে এই বিষয় নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার দুই গবেষক ক্যাটরিনা কার্কাজিস ও ব্রুস কিডের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বিশেষজ্ঞ আইনজীবী জেমস বন্টিংকে আসরে নামাই।’’ যোগ করেন, ‘‘দ্যুতি ব্যক্তিগত ভাবে আবেদন করলে বন্টিং বলেছিলেন কোনও অর্থ নেবেন না। দ্যুতিকে সেটা রাজি করাই। নিয়ে গিয়েছিলাম লোজানে। ২০১৫-র ফেব্রুয়ারিতে টানা চার দিন শুনানি হয়েছিল। তথ্য তুলে ধরে বলেছিলাম, দ্যুতি তো ডোপ করেনি। শরীরে পুরুষ হরমোনের মাত্রা বেশি থাকলে ওর দোষ কোথায়? কেন কোপটা ওর ঘাড়েই পড়বে?’’

শেষমেশ, জয় হয় দ্যুতির। ক্রীড়া-আদালত আগের নিয়ম সংশোধন করে রায় দেয়, যে সব মহিলা অ্যাথলিটের রক্তে প্রতি লিটারে পাঁচ ন্যানোমোল-এর বেশি টেস্টোস্টেরন রয়েছে, তাঁরা ১০০ ও ২০০ মিটারে নামতে পারবেন।

ইংল্যান্ড-প্রবাসী বঙ্গকন্যা বলছেন, ‘‘এই রায়ে শুধু দ্যুতির মতো বিশ্বের অনেক মহিলা স্প্রিন্টারের জীবনে বন্ধ হওয়া দরজা ফের খুলে গিয়েছে। কিন্তু মাঝারি পাল্লার অ্যাথলিটদের (৪০০, ৮০০ ও ১৫০০ মিটার, হেপ্টাথলন) জন্য আগের রায় বহাল রয়েছে। যার আওতায় পড়ছেন রিয়ো অলিম্পিক্সে ৮০০ মিটারে সোনা জয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার কাস্তের সেমেনিয়া। এ বার লড়তে তৈরি হচ্ছি তাঁদের জন্য। দ্যুতির মতো কাস্তেরকে আইনজীবীও খুঁজে দিয়েছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Athletics Dutee Chand Asian games 2018
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE