Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
স্লেটের দৌড়ে জিতে এখন রিওর স্বপ্নে দ্যুতি

৩৬ বছর পর একশো মিটারে ভারতীয় মেয়ে

ওড়িশার গোপালপুর গ্রামে এক সময় খালি পায়ে ছুটতেন তিনি। সেই ছোটার তাগিদটা অবশ্য অন্য ছিল। রেস জিতলে স্কুল থেকে স্লেট, পেন্সিল পাওয়া যাবে। তাই জিততে ছুটতেন তিনি। দেখত গোটা গ্রাম। আবার ছুটবেন তিনি। এ বার সুদূর রিওয়। ছুটবেন দেশের জন্য।

সোহম দে
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৬ ০৫:০৩
Share: Save:

ওড়িশার গোপালপুর গ্রামে এক সময় খালি পায়ে ছুটতেন তিনি।

সেই ছোটার তাগিদটা অবশ্য অন্য ছিল। রেস জিতলে স্কুল থেকে স্লেট, পেন্সিল পাওয়া যাবে। তাই জিততে ছুটতেন তিনি। দেখত গোটা গ্রাম।

আবার ছুটবেন তিনি। এ বার সুদূর রিওয়। ছুটবেন দেশের জন্য। ছুটবেন অলিম্পিক্স পদকের জন্য। দেখবে গোটা দেশ। তিনি স্বপ্ন দেখেন, তাঁর গলায় ঝুলছে অলিম্পিক্স পদক। তিনি— দ্যুতিচাঁদ। রিও অলিম্পিক্সে মহিলাদের ১০০ মিটারে ভারতের প্রতিনিধি।

রিও রওনা হওয়ার আগে আনন্দবাজারকে ফোনে দ্যুতি বললেন, ‘‘আমি খুব খাটছি। দিনরাত ট্রেনিং করছি। দিনে তিন বার করে দৌড়চ্ছি। সকাল থেকে রাত শুধু রিও নিয়েই ভাবছি।’’ অলিম্পিক্সের গ্ল্যামার ইভেন্টের মধ্যে অন্যতম ১০০ মিটার দৌড়। ছত্রিশ বছর পরে কোনও ভারতীয় মহিলা ফের ১০০ মিটারে দৌড়তে চলেছেন। চাপ কতটা? দ্যুতি বললেন, ‘‘দেখুন আমি চাপ নিচ্ছি না। নিজের সেরাটা দিতে চাই। বাকিটা দেখা যাবে। আমি জিম করছি। শর্টস্প্রিন্টও করছি। আলাদা প্ল্যান তো থাকবেই।’’ ১০০ মিটার মানে মোটামুটি ১২-১৩ সেকেন্ডের মধ্যে স্বপ্নপূরণ বা স্বপ্নভঙ্গ। বিশেষ কোনও স্ট্র্যাটেজি কি থাকছে এ বার? ‘‘১০০ মিটারে খুব বেশি কিছু ভাবার সময় থাকে না। তাই আলাদা করে কোনও স্ট্র্যাটেজি সে রকম নেই। কিন্তু রিওয় গিয়ে ট্রেনিং না করার আগে অবধি বুঝতে পারছি না পরিস্থিতি কী হবে,’’ বললেন ভারতীয় স্প্রিন্টার। ড্যাফনি শিফার্স, শেলি অ্যান প্রাইসের মতো তারকা স্প্রিন্টারও ১০০ মিটারে দৌড়বেন। কিন্তু তাঁদের নাম শোনেননি দ্যুতি। ‘‘আমি কারও সম্পর্কে কিছু জানি না। রিও গিয়ে বুঝতে পারব।’’

রিও যাওয়ার ছাড়পত্র মিললেও কয়েক বছর আগে পর্যন্ত অলিম্পিক্সে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল দুরঅস্ত। বরং প্রতিদিনই ছিল নতুন যুদ্ধ। মা-বাবা সাধারণ তাঁতি। কাপড় বানানোর কাজ করেন। সেই বাড়ির চার বোনের মধ্যে একজন দ্যুতি। ছোটবেলা থেকেই দৌড়তে ভালবাসতেন। জুতো কেনার টাকা ছিল না। তাই খালিপায়ে ছুটতে হত। চোটও পেতেন। তাও মেয়ের দৌড়ের অদম্য ইচ্ছাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। সেই সব দিনে ফিরে দ্যুতি বলছিলেন, ‘‘খুব কষ্ট করেছি। ছোটবেলায় জুতো ছিল না। তাই খালিপায়ে দৌড়াতাম। পায়ে লাগত। কেটেও যেত। চোটও পেতাম। কিন্তু কোনও উপায় ছিল না।’’

দ্যুতির দৌড়ের অদম্য জেদ আরও বাড়িয়ে দেন তাঁর দিদি সরস্বতীচাঁদ। যিনি নিজেও অ্যাথলিট ছিলেন। ‘‘দিদি আমায় বলত তুই দৌড়ো। আরও বেশি করে প্র্যাকটিস করার অনুপ্রেরণা দিয়েছিল।’’ কিন্তু দিদির এই আবদারের পিছনেও ছিল অন্য কারণ। দ্যুতি যে স্কুলে পড়তেন সেখানে বার্ষিক স্পোর্টসে দৌড়ে জিততে পারলে শিক্ষার্থীদের, স্লেট-পেন্সিল দেওয়া হত। দ্যুতির কাছে তাই স্কুলের স্পোর্টস শুধু মাত্র একটা বার্ষিক ইভেন্ট ছিল না। বরং সেখানেও যুদ্ধ ছিল। ছিল স্লেট-পেন্সিল পাওয়ার যুদ্ধ। ‘‘দিদি আমায় বলত, জানিস তো স্কুলের প্রতিযোগিতায় জিততে পারলে পেন্সিল, স্লেট দেবে। তাই আমি আরও বেশি করে দৌড়তে চাইতাম। কারণ আমাদের আর্থিক অবস্থা অতটা ভাল ছিল না। সেখান থেকে দৌড়নোর ইচ্ছাটা আরও বাড়ে,’’ বলছেন দ্যুতি।


রিও পৌঁছে গেল ভারতীয় টিটি টিম। বাঁ-দিক থেকে শরথ কমল, মৌমা দাস, কোচ ভবানী মুখোপাধ্যায়, সৌম্যজিৎ ঘোষ ও মনিকা বাত্রা। -নিজস্ব চিত্র

কেরিয়ারের শুরুতে লম্বা ম্যারাথন দৌড়লেও বিভিন্ন কোচের পরামর্শে ১০০ মিটারে দৌড়তে শুরু করেন। তার পর তাঁর টুপিতে একটার পর একটা পালক। ২০১২ অনূর্ধ্ব-১৮ বিভাগে ১১.৮ সেকেন্ডে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। রাঁচিতে জাতীয় গেমসে প্রথম। কিন্তু দ্যুতির এই সোনার সময়ে হঠাৎ করে অন্ধকার নেমে আসে। কমনওয়েলথের আগে ‘হাইপার অ্যান্ড্রোজেনিসমের’ শিকার হন তিনি। অর্থাৎ যেখানে পুরুষ হরমন বেশি শক্তিশালী হয়ে পড়ে। কমনওয়েলথ গেমসে দ্যুতিকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

প্রতিদিন অসহ্য কষ্ট, যন্ত্রণার সঙ্গে লড়াই করতে হয় তাঁর। শুধু কাঁদতেন। ভাবতেন, নিজের প্রিয় ট্র্যাকে আবার কবে নামবেন? কিন্তু লড়াই ছাড়েননি। প্রতিবাদ করেছেন। শেষে যুদ্ধ জিতে ফিরেওছেন ট্র্যাকে। সে সব দিনের কথা উঠলে দ্যুতি বলেন, ‘‘প্রথমে যখন আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হল তখন বুঝতেও পারছিলাম না ঠিক কী হয়েছে। আমি ভাবতাম, কিছুই করিনি তো আমাকে দৌড়তে দেওয়া হচ্ছে না কেন? কিন্তু জানতাম যুদ্ধ আমিই জিতব।’’

রিওর প্রস্তুতির মধ্যে চলছে পড়াশুনোও। ২০১৩ থেকেই আইন নিয়ে পড়ছেন। দ্যুতির বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যারও তাঁর শিক্ষার্থীকে আগেভাগে বলে রেখেছেন, রিওতে সবাইকে চমকে দিতে। সবশেষে তাই তো দ্যুতি বলছেন, ‘‘আমি শুধু নিজেকে একটা কথাই বলছি। রিওতে নিজের সেরাটা দিতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dutee Chand Rio Rio Olympics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE