প্রথম গোলের পর লাল-হলুদের উচ্ছ্বাস। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
বিনয়ের মুখোশ খুলে ঔদ্ধত্যের চাদর চাপানো। সাদামাঠা ছেলেটা হঠাৎ যেন বদলে গিয়েছে!
বিপক্ষ ডিফেন্ডারের অত্যাচারে যিনি টুঁ শব্দটি করতেন না, তিনি এখন গায়ে যেন হাওয়া লাগলেও মারতে ছুটছেন মার্কারকে। লাথিও মারলেন!
সরল মুখের বদলে যেন সর্বক্ষণ ভ্রু কুঁচকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। ধরাকে সরা জ্ঞান করার প্রবণতা!
ইস্টবেঙ্গলের অন্দরমহলে কান পাতলে এখন একটাই রহস্যের সন্ধান পাওয়া যায়— ডু ডং কো গুস্সা কিঁউ আতা হ্যায়!
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘যাহার যোগ্যতা যত অল্প, তাহার আড়ম্বর তত বেশি।’’ লাল-হলুদের কোরিয়ান মিডিওর যোগ্যতার বিচার করার সময় হয়তো আসেনি এখনও। সবে কলকাতা ময়দানে তাঁর দ্বিতীয় মরসুম শুরু হয়েছে। তবে কবিগুরুর প্রয়াণ দিবসের বিকেলে ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে ডংয়ের শরীরী ভাষায় ‘আড়ম্বর’-এর ছবিই যেন বেশি স্পষ্ট। ক্লাবকর্তারা এই আচরণ কত দিন সহ্য করবেন জানা নেই, তবে দলের ব্রিটিশ কোচ ট্রেভর যে বেজায় বিরক্ত ডং নিয়ে, বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। নইলে রবিবার ইস্টবেঙ্গল দু’গোলে জেতার পরেও মর্গ্যান কেন বলবেন, ‘‘সবাইকে নিজেদের দায়িত্ব বুঝতে হবে। ভুললে চলবে না, দলের চেয়ে বড় কেউ নয়।’’
মর্গ্যানের এই মানসিকতা অচেনা নয় মিডিয়ার। ইস্টবেঙ্গলে তাঁর প্রথম ইনিংসে যেমন টোলগে ওজবের সঙ্গে সাহেব কোচের বন্ধুত্ব-গাথা। একসঙ্গে থাকতেন, ঘুরতেন এমনকী ব্যক্তিগত জীবনের প্রায় সব সুখ-দুঃখ সমান ভাগ করে নিতেন গুরু-শিষ্য। কিন্তু সেটা মাঠে ঢোকার আগে পর্যন্ত। ব্যস! টোলগে মাঠে পা দিলে আর রেয়াত করেননি মর্গ্যান। কোনও দিন প্রশ্রয় দেননি অস্ট্রেলীয় স্ট্রাইকারকে। দলের স্বার্থে আঘাত লাগলে সটান দেখিয়ে দিয়েছেন বেরনোর দরজা। লাল-হলুদে নিজের দ্বিতীয় ইনিংসে মর্গ্যান যে ডংয়ের বদমেজাজও সহ্য করবেন না, সেটাই প্রত্যাশিত। বিশেষ করে যখন টিম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তখন তো কথাই নেই।
গোটা নব্বই মিনিট ডংয়ের মধ্যে কোনও বাড়তি প্রচেষ্টা দেখা গেল না। উল্টে পেনাল্টি থেকে শুরু করে ফ্রি-কিক, ওপেন নেট— সব নষ্ট করলেন একই ম্যাচে। যদিও এ সবই ফুটবলের অঙ্গ। রোনাল্ডো-মেসিও নষ্ট করেন। কিন্তু ডংয়ের সমস্যা হল, তাঁর স্বার্থপর ফুটবল এবং শরীরী ভাষা। যা তাঁর টিমমেটদের খেলাতেও কুপ্রভাব ফেলল এ দিন কল্যাণী স্টেডিয়ামে। মর্গ্যান বললেন, ‘‘পেনাল্টি নষ্ট করা বড় ব্যাপার নয়। তবে ম্যাচটা যে এত ক্লোজ ফিনিশ হবে ভাবতে পারিনি।’’
‘ক্লোজ ফিনিশ’-এর কথা ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিও বোধহয় ভাবেনি। কলকাতা লিগ মানে এখন তো গোলের সুনামি। সেখানে দু’টোয় কি আর মন ভরে লাল-হলুদ সমর্থকদের? তার উপর যদি চব্বিশ ঘণ্টা আগেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাঁচ গোলে জেতে! ইস্টবেঙ্গলেরও এ দিন অন্তত পাঁচ গোলে জেতার কথা। হল না দু’টো কারণে— প্রকৃত স্ট্রাইকারের অভাব এবং ডংয়ের স্বার্থপর ফুটবল।
এটাও অবশ্য সত্যি— জিতেন মুর্মু, নারায়ণ দাস, অবিনাশ রুইদাসের মতো ফুটবলারদের লাল-হলুদ জার্সির সঠিক ওজনটা বুঝতে হবে। যে জার্সি গায়ে একটা সময় সুধীর-সুভাষ-সুরজিৎ-গৌতম-কৃশানু-বিকাশরা খেলেছেন, তার পরম্পরা রক্ষা করার দায়িত্ব এখন তাঁদের। কলকাতা ময়দানে বিদেশিদের নিয়ে আদিখ্যেতার যুগে। যে দায়িত্ব লাল-হলুদে গত কয়েক বছর পালন করে চলেছেন অর্ণব মণ্ডল। প্রথম ম্যাচের ভুল শুধরে মর্গ্যান এ দিন শুরু থেকেই অর্ণবকে নামিয়েছিলেন। নিটফল, রাহুল বেকে ১-০ করার পর ২-০ তো করলেনই অর্ণব, (দু’টো গোলই মেহতাবের কর্নার থেকে হেডে) ডিফেন্সকে ভরসাও দিলেন। মর্গ্যান তো বলেই দিলেন, ‘‘শেষের দিকে অনেকগুলো সেভ হয়েছে আমাদের ডিফেন্সে।’’ ম্যাচের সেরাও অর্ণব।
একজন বঙ্গসন্তানকে দেখে আবার মন খারাপ হওয়ার কথা। কয়েক বছর আগেও যাঁকে মাথায় তুলে নাচত ইস্টবেঙ্গল জনতা, সেই রহিম নবির দিকে এখন কটূক্তি ধেয়ে আসছে গ্যালারি থেকে। তিনি যে এ বার পিয়ারলেসে! আর কলকাতার বড় দল কবে আবার নিজেদের প্রাক্তনকে প্রতিদ্বন্দ্বী দেখে স্পোর্টসম্যানশিপ দেখিয়েছে? সেই ফুটবলার ছোট দলের হয়ে চমৎকার খেললেও! পিয়ারলেস এ দিন যতটুকু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারল সেটা পাণ্ডুয়াবাসীর সৌজন্যেই। গতি কমলেও স্কিলে ভাঁটা পড়েনি। কথাতেই তো আছে— ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট, ফর্ম ইজ টেম্পোরারি।
তাই একটা কথা না বললেই নয়। নবিকে বোধহয় লাল-হলুদ জার্সিতেই বেশি মানায়। এখনও!
ইস্টবেঙ্গল: ব্যারেটো, রাহুল, অর্ণব, গুরবিন্দর, নারায়ণ, মেহতাব, রফিক, অবিনাশ (রবার্ট), ডং (অ্যঙ্গাস), জিতেন, আদিলেজা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy