Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বাগানমুখো হলেন না ইডেনের বাঞ্ছারাম

বরাপানি লেক সাইড রেস্তোরাঁর জানলাটা খোলার চেষ্টা করছিলেন অনুরাগ ঠাকুর। পাহাড়ের মানুষ তিনি। কাচের বন্ধ ঘরে না থেকে উদ্দাম আকাশ আর জল দেখতে চান।

প্রবীর মুখোপাধ্যায়।— ফাইল চিত্র

প্রবীর মুখোপাধ্যায়।— ফাইল চিত্র

গৌতম ভট্টাচার্য
শিলং শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৬ ০৪:০২
Share: Save:

বরাপানি লেক সাইড রেস্তোরাঁর জানলাটা খোলার চেষ্টা করছিলেন অনুরাগ ঠাকুর। পাহাড়ের মানুষ তিনি। কাচের বন্ধ ঘরে না থেকে উদ্দাম আকাশ আর জল দেখতে চান। সেটা দেখামাত্র দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সফরে আসা বোর্ড প্রেসিডেন্টের কাছে চলে এসেছেন জনৈক ফটোগ্রাফার। লেক আর পাহাড়ের পিকচার পোস্টকার্ড ব্যাকগ্রাউন্ডে নতুন বোর্ড প্রধান— ছবিটা দারুণ হবে।

ঠিক এই সময়েই তাঁকে খবরটা কেউ জানাল— ইডেনের বিখ্যাত পিচ প্রস্তুতকারক মারা গিয়েছেন। অনুরাগ নির্বাক হয়ে গেলেন কয়েক মিনিটের জন্য। প্রবীর মুখুজ্জের জাতীয় ক্রিকেটে বরাবরের এমন সদর্প উপস্থিতি যে, তাঁকে পছন্দ করুন বা অরুচি থাক, অবজ্ঞার কোনও উপায় নেই। অনুরাগের ওই কয়েক মিনিটের বিবর্ণ চাউনিই ‘ইডেনের বাঞ্ছারামের’ চূড়ান্ত পুরস্কার হয়ে রইল যে, ‘তুমি বাবা তিনটে প্রজন্ম পরে এসেও আমার নাম জানতে বাধ্য হয়েছিলে।’

বিবর্ণ অবশ্য তখন সবচেয়ে বেশি দেখাচ্ছিল বোর্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ক্রিকেট কমিটির প্রধানকে। ফোনে তিনি, অভিষেক ডালমিয়া বারবার ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন প্রবীরবাবুর ছেলেকে। ভেবে পাচ্ছিলেন না, শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য আজ কী কী করা যায় সিএবিতে? পতাকা অর্ধনমিত রাখাটাখা তো হবেই। তার বাইরে কী করা যায়? ইডেন উইকেটের চার ধারে সাদা কাপড় ঘিরে দিয়ে কি তার ওপর কালোয় লেখা যায় যে, আমরা শোকাহত? ওই বাইশ গজই তো মন্দির ছিল মঙ্গলবার বেশি রাতে চলে যাওয়া মানুষটার। অভিষেকের বাবাই কি না তৈরি করেছিলেন এ হেন পিচ প্রস্তুতকারককে। ডালমিয়া-মুখুজ্জে কম্বিনেশন ভারতীয় ক্রিকেটকে ধারাবাহিক ভাবে বরণীয় সব মুহূর্ত এনে দিয়েছে। ইডেন তার চুরাশি বছরের ইতিহাসে অনেক পিচ প্রস্তুতকারক দেখেছে। ওই রকম বর্ণময় চরিত্র পায়নি!

‘বাঞ্ছারাম’ বলে তাঁকে ডাকা হচ্ছে শুনলে বলতেন, ‘‘আমার কাছে তো পিচটা বাগানের মতোই। যাকে-তাকে আমি ঢুকতে দেব না।’’ আর যাকে-তাকে কেন, বড় নামটামেরও তোয়াক্কা করেননি। মাইক আথারটন পিচের কাছে গিয়েছিলেন। সোজা বের করে দিয়েছেন। বয়কটকে ‘না’ বলে দেন। ইডেনে বছর কয়েক আগে তাঁর একরোখা মনোভাবের ঘাত-প্রতিঘাত কলকাতার কোনও সাংবাদিকের ফোনে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর হয়ে বেজেছিল।

শোনা যায়, ফোন করেছিলেন স্বয়ং সচিন তেন্ডুলকর। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ইডেন টেস্ট ম্যাচ অথচ ভারতীয় দাবি মেনে ঘাস ওড়াতে রাজি হচ্ছেন না প্রবীর।

পিচই যাঁর জীবন ছিল।

হাওয়া খারাপ দেখে ধোনি চুপচাপ। গম্ভীর। কোচ গ্যারি কার্স্টেন অনুরোধ করতে গিয়ে ‘না’ শুনেছেন। এ বার সচিন যদি পারেন। কিন্তু সচিনও বুঝে উঠতে পারছেন না, কী ভাবে প্রবীরকে সামলাবেন!

তখনকার মতো তেন্ডুলকর অবশ্য বিকট উত্তেজিত, ‘‘আমরা কি জোহানেসবার্গে খেলতে এসেছি নাকি যে, এই পিচ দেওয়া হবে?’’ অগত্যা সাংবাদিকের মাধ্যমে তখন ফোন যায় জগমোহন ডালমিয়ার কাছে। ডালমিয়াও ফোনে সরাসরি নির্দেশ দেওয়ার ভরসা পাননি। আলিপুরের বাড়িতে ডেকে পাঠিয়ে প্রবীরকে বোঝান। পরের দিন ঘাস কেটে ফেলা হয়েছিল।

গ্রেগ চ্যাপেলের কোচিংয়ে খেলা টিম ইন্ডিয়াকে অবশ্য তিনি সেই সৌজন্যও দেখাননি। এমন পুরু ঘাস রেখে দিয়েছিলেন আর এমন বাঁই বাঁই বল ছুটেছিল যে গ্রেম স্মিথ উল্লসিত ভাবে বলেছিলেন, ‘‘এ তো কিংগসমিড!’’ ভারত অধিনায়ক দ্রাবিড় ম্যাচের আগের দিন সিএবির অধুনা ট্রাস্টি বোর্ড প্রধানকে দিয়ে বলিয়েও কিছু করতে পারেননি। প্রবীরের সেই এক কথা, ওহে চ্যাপেল, আমাদের ছেলেটাকে ছোরা বসিয়েছিলি তো? দ্যাখ এ বার তোর কী হয়।

ক্রিকেট নিয়তির এমন পরিহাস যে, সেই সৌরভের আমলেই বহু গঞ্জনা বুকে নিয়ে প্রবীরকে সিএবি ছাড়তে হয়। তাঁর পরিবারের এ দিনের উত্তেজিত বক্তব্য অনুযায়ী, সিএবি থেকে অসম্মানের প্রস্থান-শক প্রবীর সামলাতে পারেননি। তাই এক রকম ক্রিকেট-উইল করে যান, ‘‘আমার মৃতদেহ যেন কিছুতেই ইডেনে না নেওয়া হয়।’’ যে মানুষটা জীবদ্দশায় স্ত্রী আর কন্যা পরপর চার দিনের মধ্যে মারা যাওয়ার পরেও নিয়ম করে মাঠে এসেছেন। ইডেন উইকেটের যত্ন করেছেন। তিনি স্ব-ইচ্ছায় মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে নিজেকে নির্বাসন দিলেন ইডেন থেকে! এ তো জীবন নয়, যেন গল্প।

কী এমন ঘটল, যে সৌরভকে তিনি পুত্রবৎ দেখেন, তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়া-উত্তর অসন্তোষ বরদাস্ত করতে পারলেন না? ছয় ফুটের ঋজু শরীর সেই যে পরের দিন ক্লাব হাউসের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল, আর ওমুখো হল না।

কাজ করতে গিয়ে কখনও টাকার পরোয়া করেননি। সিএবি এবং ডালমিয়ার দাক্ষিণ্য তাঁকে মোটা পারিশ্রমিক দিয়েছে মনে করলে একেবারেই ভুল হবে। কাজটা করতেন অপেশাদারের রোমান্টিসিজম নিয়ে। সুবার্বনের হয়ে ক্রিকেটার হিসেবে কিছু করেননি। সিএবি সচিব হিসেবেও আহামরি ছাপ নেই। কিন্তু পিচ প্রস্তুতকারক হিসেবে সেই নব্বইয়ের শুরু থেকে নিজেকে মহীরূহ সদৃশ করে ফেলেছিলেন। দিন নেই, রাত নেই, ঝড় নেই, জল নেই, সারাক্ষণ উইকেটের কাছে ওই লম্বা লোকটা।

উত্তরের সম্ভ্রান্ত পরিবার। নিজের রূপবান চেহারা। এক সময় চলচ্চিত্রে যাবেন ভেবেছিলেন। ছোটখাটো কাজও করেছেন। এমনকী বছরখানেক আগে একটা টিভি সিরিয়ালে। অথচ তাঁর নিজের জীবনটাই ফিল্মের বর্ণাঢ্য উপাদানে ভর্তি। ক্রিকেট মাঠের একটা আপাত অকিঞ্চিৎকর মানুষ যে কি না বল করেনি, ব্যাট করেনি, প্লেয়ার বাছেনি, বোর্ড চালায়নি। প্রকৃতিগত ভাবে ছিল হেড মালি, সে কী করে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে!

যাঁর বিদায়বেলাতেও ফিল্মি উপাদান আর অকথিত সব কাহিনি। গত অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ সামান্য বৃষ্টিতে যে করা যায়নি, তা অবশ্যই প্রবীরের ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য হবে। হাল্কা বৃষ্টি যখন হচ্ছিল তখন মাঠ ঢাকার লোকই ছিল না। ইডেনের মুখুজ্জেবাবু নাকি সব মালিকে একসঙ্গে লাঞ্চে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি যে মাটি কাটার লোককে লাগাতে বলেছিলেন, সে-ও নাকি নিকৃষ্ট পর্যায়ের মাটি সরবরাহ করেছিল। জল্পনা না সত্যি?

কোনও সন্দেহ নেই, শেষ দিকটায় যে বাঞ্ছারামীয় মেজাজে প্রচণ্ড একগুঁয়ে হয়ে প়ড়েছিলেন প্রবীর, তাঁকে সামলানো সমস্যা হয়ে যাচ্ছিল। সৌরভ যে আধুনিক ক্রিকেট প্রশাসন আমদানি করতে চাইছেন, তাতে এই জাতীয় মানসিকতার আত্মরক্ষা এমনিতেও কঠিন হতো।

কিন্তু সেই বিদায়টাই কি সহানুভূতিশীল আর মানবিক হতে পারত না? প্রকৃতিগত ভাবে মালি হয়েও সাম্প্রতিক ইডেনের ওপর তো প্রবীরের দীর্ঘস্থায়ী ক্রিকেটীয় ছাপ। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রাউন্ড কমিটির সেই সময় আনা অপবাদগুলো কি সব সত্যি ছিল? নাকি কেউ কেউ সৌরভের কান ভাঙাচ্ছিল?

জীবদ্দশাতেই প্রবীরের ওপর তোলা হয়ে যায় একটা ডকুমেন্টরি— ‘মালি’। তা অবশ্যই সেই সব ঘটনাপ্রবাহ অনুপুঙ্খ রেকর্ড করেছে। প্রবীর নাকি মৃত্যুর আগে সেটা দেখেও যান। তাঁর অসন্তোষ আর দীর্ঘশ্বাস অবশ্য নিজেকে নিয়ে তথ্যচিত্র হওয়াতেও কাটেনি।

প্রবীরের মৃত্যুশোকে এ দিন যাঁকে সবচেয়ে কাতর দেখলাম, তিনি শিলং পাহাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অভিষেক ডালমিয়া। প্রবীর যে তাঁর বাবার টিমের খাস প্লেয়ার!

কে বলতে পারে, গত সেপ্টেম্বরে চলে যাওয়া ডালমিয়া এত দিনে প্রয়াত সব ক্রিকেটার জড়ো করে দু’টো টিমকে ম্যাচ খেলানোর তোড়জোড় করছেন না? এ বার তো প্রিয় পিচ প্রস্তুতকারকও পেয়ে গেলেন তিনি! স্বর্গে ম্যাচের দিন ব্যাটসম্যান-বোলার দু’জনেই সমান সুযোগ পাবে, এমন উইকেট তৈরি এ বার আটকাচ্ছে কে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Eden curator Prabir Mukherjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE