Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
একান্ত সাক্ষাৎকারে স্টিভ ওয়ের বিশ্বজয়ী দলের কোচ জন বুকানন

‘সৌরভও এমন আগ্রাসী ছিল, বিরাটকে নিয়ে অভিযোগ নেই’

বক্তা ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া মহাকাব্যিক সব সিরিজের সাক্ষী। স্টিভ ওয়ের বিশ্বজয়ী দলের কোচ। ২০০১-এ ইডেনে ফলো-অন বিতর্ক থেকে শুরু করে স্টিভের বিখ্যাত স্লেজিং-নীতি, সব কিছু নিয়ে ব্রিসবেন থেকে ফোনে খোলামেলা, একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সব চেয়ে সফল কোচ এবং আইপিএলের শুরুতে কেকেআরের দায়িত্ব সামলানো জন বুকানন।

আগ্রাসী: বিরাট কোহালি মনে করিয়ে দিচ্ছেন মাঠে সৌরভের আক্রমণাত্মক মেজাজকে। ফাইল চিত্র

আগ্রাসী: বিরাট কোহালি মনে করিয়ে দিচ্ছেন মাঠে সৌরভের আক্রমণাত্মক মেজাজকে। ফাইল চিত্র

সুমিত ঘোষ 
মেলবোর্ন শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৪:২৯
Share: Save:

বক্তা ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া মহাকাব্যিক সব সিরিজের সাক্ষী। স্টিভ ওয়ের বিশ্বজয়ী দলের কোচ। ২০০১-এ ইডেনে ফলো-অন বিতর্ক থেকে শুরু করে স্টিভের বিখ্যাত স্লেজিং-নীতি, সব কিছু নিয়ে ব্রিসবেন থেকে ফোনে খোলামেলা, একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সব চেয়ে সফল কোচ এবং আইপিএলের শুরুতে কেকেআরের দায়িত্ব সামলানো জন বুকানন।

প্রশ্ন: সিরিজ ১-১। মেলবোর্ন এবং সিডনি নিয়ে আপনার পূর্বাভাস কী?

জন বুকানন: পূর্বাভাস করা কঠিন। খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সিরিজ হচ্ছে। তবে আমার মতে, অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জিতবে। তার কারণ, এখনও পর্যন্ত যে দু’টো টেস্ট হয়েছে তাতে ওরা ভারতের চেয়ে ভাল ক্রিকেট খেলেছে। অ্যাডিলেডে ভারত জিতেছে কিন্তু দু’টো দলের মধ্যে ফারাক খুব কম ছিল। বলা যাবে না যে, ভারত সম্পূর্ণ ভাবে শাসন করেছে। কিন্তু পার্‌থে বেশির ভাগ সময়টাই অস্ট্রেলিয়া রাজ করেছে। তাই সামান্য হলেও ওদের আত্মবিশ্বাস বেশি থাকবে।

প্র: মেলবোর্নের পিচ নিয়ে নানা আশঙ্কা রয়েছে। আপনার কী মত?

বুকানন: হ্যাঁ, মেলবোর্নে ফল হওয়া হয়তো কঠিন হবে। মেলবোর্নের পিচের নিষ্প্রাণ ভাব নিয়ে আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটেও খুব কথাবার্তা হচ্ছে। তা ছাড়া মেলবোর্নের আবহাওয়াটাও বাধা হতে পারে। কখন বৃষ্টি এসে খেলা বন্ধ করে দেবে কেউ জানে না। আমার তাই মনে হচ্ছে, মেলবোর্নে ড্র হয়ে যাবে। সিডনিতে অবশ্যই ফল হবে এবং আমার মনে হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়া এ বার ফেভারিট। যদি জিজ্ঞেস করেন, আমি বলব, সিরিজের ফলাফল অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে ২-১।

প্র: এ বারে কিন্তু ভারতীয় দলকে নিয়ে অনেকে আশা দেখছিলেন, এখান থেকে সিরিজ জিতে ফিরবে।

বুকানন: সেটা ঠিকই এবং এই ভারতীয় দলটা যথেষ্টই ভাল। তবে একদম এই সিরিজের ফর্মের বিচারে আমি আমার মতামত জানালাম। ভারতকে কয়েকটা ব্যাপার উদ্বেগে রাখবে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে, ওপেনারদের খারাপ ফর্ম। দু’টো টেস্ট চলে গিয়েছে, একেবারেই স্বস্তিতে দেখাচ্ছে না ভারতের ওপেনারদের। বার বার শুরুতে ঝটকা লাগলে কী ভাবে টিমটা সামলাবে? অস্ট্রেলিয়া যে পার্‌থে জিতেছে, তার পিছনে প্রথম দিন সকালে ওদের ওপেনারদের দুর্দান্ত পার্টনারশিপ একটা অন্যতম বড় কারণ।

প্র: ভারতীয় ব্যাটিং কি খুব বেশি করে কোহালি-নির্ভর হয়ে পড়ছে?

বুকানন: না, আমি তা মনে করি না। নিঃসন্দেহে বিরাট এই টিমের সেরা আকর্ষণ। প্রতিপক্ষের কাছে সব চেয়ে দামী উইকেট। ওকে তুলে নিতে পারলে অনেক দলই মনে করতে চাইবে, ভারতকে চাপে ফেলে দিতে পেরেছে। কিন্তু আমার মনে হয়, চেতেশ্বর পূজারাও ভারতীয় দলের খুব কার্যকরী এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটসম্যান। এই সিরিজেও সেটা পূজারা দেখাচ্ছে। অজিঙ্ক রাহানে আছে। অস্ট্রেলিয়ায় রান করার অভিজ্ঞতা রয়েছে রাহানের। মিডল-অর্ডার নিয়ে ভারতের খুব বেশি ভাবনা নেই। তিন জন দারুণ ব্যাটসম্যান রয়েছে। ওদের সমস্যাটা ওপেনিংয়ে এবং সিরিজ যত এগোচ্ছে, তত সেটা কমে যাওয়ার বদলে বেশ বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

প্র: অস্ট্রেলিয়ায় তোলপাড় চলেছে বল-বিকৃতি বিতর্ক নিয়ে। স্টিভ স্মিথ ও ডেভিড ওয়ার্নার নির্বাসিত। আপনি সমর্থন করেন?

বুকানন: হ্যাঁ, করি। নির্বাসনটা দিতেই হত। জীবনের যে কোনও খাতেই প্রতারণা করার কোনও জায়গা নেই। অস্ট্রেলীয়রা আগ্রাসী ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করে ঠিকই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, মাঠে দাঁড়িয়ে প্রতারণা করতে হবে। সেই অন্যায়কে কখনও প্রশ্রয় দেওয়া যায় না এবং অস্ট্রেলিয়ার মানুষের অধিকার আছে এ নিয়ে প্রতিবাদ করার। দেশের কেউ টিভি-তে সিরিশ কাগজ দিয়ে বল ঘষার দৃশ্যটা দেখে মেনে নিতে পারেনি এবং যে-হেতু আইসিসি-র নির্বাসন খুব বড় ছিল না, অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব শাস্তি দিতেই হত। আমি বিশ্বাস করি, অস্ট্রেলিয়ার অবশ্যই পথপ্রদর্শক হওয়া উচিত কারণ তারা ক্রিকেটে বড় একটা দেশ। তাদের উচিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করা এবং সেটা যে করা হয়েছে, তা দেখে আমি খুশি।

প্র: আপনার কোচিংয়ে বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ান দল স্লেজিংয়ে বিশ্বাস করত। অধিনায়ক স্টিভ ওয়ের বিখ্যাত সেই ফর্মুলা, ‘মেন্টাল ডিসইন্টিগ্রেশন’। অর্থাৎ মানসিক ভাবে চুরমার করে দাও প্রতিপক্ষকে। আপনার সময়কার সেই স্লেজিং নীতিকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

বুকানন: স্টিভ এবং আমার সময়ে যে প্রক্রিয়াটা চালু করা হয়েছিল, সেটা সীমানা অতিক্রম করত না। আমার মনে হয় না, কখনও সেগুলো ব্যক্তিগত স্তরে পৌঁছত। স্টিভের ফর্মুলাটা ছিল রণনীতির অঙ্গ। কোনও একটা দলের মানসিক অবস্থা যদি ভঙ্গুর প্রকৃতির হয়, তার উপরে আরও চাপ তৈরি করে তাকে কাবু করে ফেলা। সেটা ক্রিকেট রণনীতিরই অঙ্গ হিসেবে আনা হয়েছিল, কখনও এমন উদ্দেশ্য ছিল না যে, প্রতিপক্ষের কোনও ক্রিকেটারকে অযথা ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হবে। আমাদের সময়ে অনেক ক্ষেত্রে কিন্তু মুখে কথা বলা হত না। হয়তো নতুন কোনও ব্যাটসম্যান ক্রিজে এসেছে। অধিনায়ক ফাস্ট বোলারকে হাত নেড়ে দাঁড়াতে বলে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ আর সিলি পয়েন্ট নিয়ে এলেন। মানে নতুন ব্যাটসম্যানের মনে উপর চাপ তৈরি করা যে, দুরন্ত গতিতে বাউন্সারে তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি। নিঃশব্দেও অনেক কিছু করা যায়। আমরা সেটা করেছি। সব সময় যে কথার যুদ্ধ চলেছে, তা নয়।

প্র: সেই সময়ে কোনও ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে দেখলে কোচ হিসেবে কী ভাবে সামলাতেন?

বুকানন: খেলা চলাকালীন তৎক্ষণাৎ তো কিছু করা সম্ভব হত না। মাঠের ব্যাপারটা ক্রিকেটারদের উপরেই ছাড়তে হত। অধিনায়ক মাঠের মধ্যে নেতা। তাকেই সেগুলো সামলাতে হয়। তবে দিনের খেলা শেষে আমরা পর্যালোচনা করতাম। যদি কোথাও কোনও সমস্যা হয়ে থাকে, সেটা মিটমাট করে নেওয়ার চেষ্টা করা হত। অনেক সময়ে আমাদের দলের খেলোয়াড়রা প্রতিপক্ষ ড্রেসিংরুমে গিয়েও পরিস্থিতি হাল্কা করার চেষ্টা করেছে।

প্র: কোহালির আগ্রাসন নিয়ে নানা কথা উঠছে। আপনার মত কী?

বুকানন: আমি অভিযোগ করার মতো কিছু দেখছি না। বিরাট আবেগ প্রকাশ করতে পছন্দ করে, আগ্রাসী ভঙ্গিতে নেতৃত্ব দিতে ভালবাসে। আমি যখন অস্ট্রেলিয়ার কোচ ছিলাম, তখন ভারতের অধিনায়ক ছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তখন আমি এ রকম আগ্রাসী ভঙ্গিতেই ওকে ক্যাপ্টেন্সি করতে দেখেছি। আর সেটা কিন্তু দু’টো দলের মধ্যে ক্রিকেটকে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণই করে তুলেছিল। আমার মনে হয়, এই আগ্রাসনটা ক্রিকেট দর্শকদের জন্যও খুব ভাল। যত ক্ষণ না সীমানা অতিক্রম করছে, বিরাটের আগ্রাসন নিয়ে আপত্তি তুলতে যাব কেন? আর সত্যিই সীমানা অতিক্রম করলে তো আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারি আছেন। তাঁরা আগে বলুন তো যে, ঠিক হচ্ছে না। তার পর না হয় দেখা যাবে।

প্র: ইডেনের সেই মহাকাব্যিক টেস্টকে কতটা মনে আছে?

বুকানন: সব কিছুই গত কালের মতো পরিষ্কার গেঁথে রয়েছে স্মৃতিতে। জীবনের সব চেয়ে স্মরণীয় ম্যাচগুলোর একটা। অবশ্যই আমরা হেরে গিয়েছিলাম বলে স্মৃতি খুব সুখের হয়নি।

প্র: শোনা যায়, ইডেনের সেই ম্যাচেও আপনি ফলো-অন করাতে চাননি। অধিনায়ক স্টিভ ওয় নিজের সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করে ফলো-অন করান এবং ফল ভুগতে হয়। ফিরে তাকিয়ে কী মনে হয়?

বুকানন: আমি কোচ থাকাকালীন, বেশ কয়েক বার ইডেন টেস্টের আগে ফলো-অন করানোর সুযোগ থাকলেও আমরা করাইনি। তার কারণ, আমার মনে হয়েছিল, শেষ ইনিংসে যদি ব্যাট করার প্রয়োজন হয়, সেই ঝুঁকিটা আমি নেব কেন? আমি তো সুবিধেজনক অবস্থায় থাকার চেষ্টা করব। সেই কারণে ফলো-অন প্রথা তুলে দিয়ে আমরা একটা নতুন স্ট্র্যাটেজি এনেছিলাম। দ্বিতীয় বার ব্যাট করে নিয়ে প্রতিপক্ষকে ম্যাচের বাইরে বের করে দাও। তার পর তাদের ফেলে দাও খারাপ হয়ে যাওয়া চতুর্থ ইনিংসের পিচে। ইডেনে ভারতকে ফলো-অন করানো হবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তার আগেই মুম্বইয়ে ভারত হেরেছিল। তখনও পর্যন্ত তিনটে ইনিংসে ব্যাটিংয়ে কিছুই করতে পারেনি ভারত। তা থেকে মনে হতেই পারে যে, মানসিক ভাবে দুমড়ে থাকা ভারতীয় ব্যাটিংকে এখানেই শেষ করে দেওয়া যাবে। তাই ফলো-অন করানর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কোচ হিসেবে আমার কাজ নানান দিক তুলে ধরা। সুবিধে-অসুবিধেগুলো সম্পর্কে ক্রিকেটারদের অবহিত করা। সিদ্ধান্ত সকলে মিলে নিতে হয় এবং ফিরে তাকিয়ে আমার মনে হয়, সে দিন ফলো-অন করানোর পক্ষেও নানা যুক্তি ছিল।

প্র: অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত আগ্রাসন পাল্টানোর দাবি উঠেছে। ভাবমূর্তি উদ্ধারের কথা উঠেছে। আপনি কী বলবেন এই বিতর্ক নিয়ে?

বুকানন: আগ্রাসন নিয়ে আপস করার পক্ষে আমি নই। অস্ট্রেলীয়রা নাছোড় ভঙ্গিতে ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করে। সেটা পাল্টাব কেন? তবে হ্যাঁ, বল-বিকৃতির মতো ঘটনা মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। ভাবমূর্তি ভাল করার অভিযান নেওয়া হলে ঠিক আছে। আমাদের সময়েও ‘যে কোনও মূল্যে জিততেই হবে’ এটা কিন্তু টিমের মন্ত্র ছিল না। ক্রিকেটের নিয়মের মধ্যে থেকে খেলে আমরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছি। দু’টো জিনিস আমি চাই না। খেলার মাঠে প্রতারণা এবং আগ্রাসী হওয়ার নামে ব্যক্তিগত স্তরে কাউকে আক্রমণ করা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE