আট হাজার মিটার বা তার বেশি উচ্চতার শৃঙ্গে উঠতে গিয়ে গত পাঁচ বছরে মারা গিয়েছেন সাত জন বাঙালি। যে তালিকায় রয়েছেন ছন্দা গায়েন-সহ সদ্য কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে প্রাণ হারানো কুন্তল কাঁড়ার (৪৬) ও বিপ্লব বৈদ্যও (৪৮)।
প্রশ্ন উঠছে, ৮ হাজার মিটার বা তার চেয়ে বেশি উচ্চতার শৃঙ্গে ওঠার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছাড়াই কি বাঙালি পর্বতারোহীরা অভিযানে ছুটছেন?
বসন্ত সিংহরায়, উজ্জ্বল রায়, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মতো রাজ্যের সফল পর্বতারোহীরা মেনে নিচ্ছেন, ইচ্ছা থাকলেও সঠিক প্রস্তুতি নিয়ে অনেকেই ইদানিং অভিযানে যাচ্ছেন না। তার ফলে কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো দুর্গম অভিযানে দুর্ঘটনা বাড়ছে। সরকারি সংস্থা দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের সদস্য অমূল্য সেন বলছেন, ‘‘বাঙালি পাহাড়ে যেতে ভালবাসে। কিন্তু পাহাড়ে গিয়ে গোঁয়ার্তুমি চলে না।’’ ন’য়ের দশকে প্রথম বাঙালি অভিযাত্রীদের দল নিয়ে চিনের দিক থেকে এভারেস্ট অভিযান চালিয়েছিলেন অমূল্যবাবু। তিনি বলছেন, ‘‘অনেক বাঙালি পর্বতারোহীর কাছে ব্যাপারটা গ্ল্যামার বাড়ানোর মতো। তাঁরা বুঝতে পারেন না, পাহাড়ে উঠে শরীর না পারলে বা প্রতিকূল আবহাওয়ায় জেদ না দেখিয়ে ফিরে আসতে হয়। কিন্তু কিছু বাঙালি তা না মানাতেই মৃত্যু বাড়ছে।’’
পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ২০১৪ সালে এভারেস্ট জয়ী দেবব্রতবাবু বলছেন, ‘‘আর্থিক সক্ষমতা থাকলে আর পর্বত অভিযানে আগ্রহ থাকলে অনেকেই এভারেস্টে উঠে পড়ছেন। কিন্তু তার আগে বা তার পরে কোন কোন অভিযানে গিয়েছেন, তা আর জানা যায় না। তিন চার বছর পরে হঠাৎ আবার টাকা জোগাড় করে অভিযানে গেলে বিপদ তো আসবেই। এটা তো আর প্যাকেজ ট্যুর নয়।’’ উদাহরণ দিয়ে দেবব্রতবাবু আরও বলছেন, ‘‘২০১৪ সালে এভারেস্টে আমার সঙ্গে সদ্য প্রয়াত বিপ্লব বৈদ্যও উঠেছিলেন। কিন্তু সে বার উঠতে গিয়েই বিপ্লবের ফ্রস্ট বাইট হয়। যার অর্থ ওই উচ্চতায় বিপ্লবের শরীরে অক্সিজেনের অভাব ঘটছে। তাই ওকে নিষেধ করেছিলাম ফের আট হাজার মিটার বা তার বেশি উচ্চতায় না উঠতে।’’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘কাঞ্চনজঙ্ঘায় উঠতে গেলে বছরে এক বার অন্তত সাড়ে ছয় বা সাত হাজার মিটার পর্যন্ত অভিযান করা উচিত। কিন্তু এই নিয়ম ক’জন মানে।’’
কলকাতা পুলিসের অতিরিক্ত নগরপাল (দক্ষিণ) উজ্জ্বল রায় এভারেস্টে উঠেছেন। পাঁচ বছর আগে ছন্দা গায়েন ইয়ালুন কাং শৃঙ্গে উঠতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়ার পরে উদ্ধারকারী দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন উজ্জ্বলবাবু। তিনি বলছেন, ‘‘অনেকে মনে করেন, এভারেস্টে যখন উঠে গিয়েছি, তখন কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানেও যেতে পারব। কিন্তু চারটে অভিযান সব চেয়ে কঠিন। তার মধ্যে প্রথম নেপালের অন্নপূর্ণা, দ্বিতীয় কে টু, তৃতীয় নাঙ্গা পর্বত ও চতুর্থ কাঞ্চনজঙ্ঘা। এভারেস্টের চেয়েও দশগুণ শক্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযান। এভারেস্টের মতো দড়ি বেয়ে ওঠা যাবে না। কাঞ্চনজঙ্ঘায় সামিট ক্যাম্প থেকে প্রায় ১২০০ মিটার তুষারাবৃত পাহাড়ের গা বেয়ে খাড়া উঠতে হবে ও নামতে হবে।’’ যোগ করেন বেশির ভাগ অভিযাত্রী মধ্যবিত্ত পরিবারের। অনেকেই শেরপা চয়নে ভুল করে সস্তার লোক নেন। এই শেরপারা অর্থ পেলেই খুশি। বাঙালি অভিযাত্রীদের অজ্ঞতার সুযোগ নেয়। এ বারও তো শুনলাম কুন্তলের বিপদ দেখে শেরপা চলে গিয়েছিল।’’
এভারেস্ট ও কাঞ্চনজঙ্ঘা দুই শৃঙ্গেই উঠেছেন বসন্ত সিংহরায়। তিনি বলছেন, ‘‘অনেকে হুজুগে পড়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। ভারতে থাকা হিমালয়ের শৃঙ্গগুলিতে (কামেট, চৌখাম্বা ওয়ান) উঠতে খরচ পাঁচ লক্ষ টাকার মতো। এভারেস্টে উঠতে সেই খরচ দাঁড়ায় প্রায় ২২ লক্ষ টাকা। কারণ, এভারেস্ট শৃঙ্গে ওঠার অনুমতি পেতে নেপাল সরকারকে ১১ হাজার ডলার দিতে লাগে। কাঞ্চনজঙ্ঘার ক্ষেত্রে খরচটা ১৫-১৬ লক্ষ টাকার মতো।’’ তাঁর যুক্তি, ‘‘বেশির ভাগ বাঙালি অর্থের সংস্থান করতে গিয়ে শারীরিক প্রস্তুতিতে নজর দেন না।’’
দেবব্রতবাবু সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘খতিয়ে দেখবেন বেশির ভাগ মৃত্যু কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে নামার সময়ে। জানা দরকার, ওঠার সময়ে অক্সিজেন ও পরিশ্রম চল্লিশ শতাংশ হলে, ফেরার সময়ে ৬০ শতাংশ পরিশ্রম ও অক্সিজেন বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কারণ, যে ভাবে খাড়া বরফাবৃত পাহাড় বেয়ে উঠতে হয়েছে, সে ভাবেই নামতে হবে। কিন্তু সবাই করেন উল্টোটা। আবহাওয়া সম্পর্কেও জ্ঞান থাকতে হয়। বিষয়টা টেকনিক্যাল।’’ দেবব্রতবাবু যোগ করেন, ‘‘রেগুলেটর কমিয়ে রাখলে একটা সিলিন্ডার ৮ ঘণ্টা চলবে। বাড়ালে ৬ ঘণ্টায় শেষ হবে। সর্বোচ্চ তিনটে সিলিন্ডার ও দক্ষ শেরপা নিয়ে গেলেও খারাপ আবহাওয়ার সামনে পড়লে সামিট ক্যাম্প থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গ ঘুরে ফের শিবিরে ফিরতে ২৭-২৮ ঘণ্টা লাগে। তাই অক্সিজেনহীন পরিবেশে বাঁচার প্রস্তুতি নিয়েই বেরোতে হয়। সেটা ক’জন করেন?’’
তা হলে? বসন্তবাবু ও পুলিশ কর্তা উজ্জ্বলবাবু বলছেন, ‘‘কাঞ্চনজঙ্ঘায় উঠতে গেলে পাঁচ-সাত বছর ধরে ছয় হাজার মিটার উচ্চতায় শৃঙ্গে ওঠা অভ্যাস করতে হবে। বয়স চল্লিশের মধ্যে থাকলে ভাল। তা হলে গতি ও ক্ষিপ্রতা কাজে লাগে। প্রস্তুতির জন্য এক বছর আগে দম বাড়াতে লম্বা দূরত্বে সাঁতার কাঁটা বা রোজ এক ঘণ্টা দৌড়তে পারলে ভাল। তা হলে ফুসফুসের কার্য়কারিতা বাড়বে। না হলে অক্সিজেনহীন পরিবেশের মোকাবিলা করা যাবে না।’’
দেবব্রতবাবুর পরামর্শ আরও একটু কঠোর। তিনি বলছেন, ‘‘যদি ভাবেন অর্থ আছে, ভাল শেরপা জোগাড় করেছি, তা হলে কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে যাবেন না। বেঁচে থাকার দক্ষতা আপনাকেই দেখাতে হবে। শেরপা যদি কুন্তলের মতো আপনাকে ছেড়ে যায় বা নিজে অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন বেঁচে ফেরার রাস্তা আপনাকেই বার করতে হবে। সেটা সম্ভব ঠিক প্রস্তুতি থাকলেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy