Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘এই এভারেস্টে পৌঁছনো অসম্ভব’

এই বয়সে দু’সপ্তাহ ধরে একটা গ্র্যান্ড স্ল্যামে খেলার ধকল সামলে ফাইনালে ফের পাঁচ সেটে জেতা, অবিশ্বাস্য। টেনিসে একটা-দুটো গ্র্যান্ড স্ল্যামই অনেক খেলোয়াড়ের কাছে জীবনের সেরা কৃতিত্ব অর্জন হয়ে থাকে।

চ্যাম্পিয়ন: ট্রফিতে চুন্বন ফেডেরারের। ছবি: রয়টার্স

চ্যাম্পিয়ন: ট্রফিতে চুন্বন ফেডেরারের। ছবি: রয়টার্স

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:০৭
Share: Save:

এক মাত্র গাড়ির গিয়ার চেঞ্জের সঙ্গেই বোধহয় তুলনা করা যায় মুহূর্তটার। রবিবার অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালের পঞ্চম সেটে যেটা ঘটল।

টিভিতে দেখছিলাম, চতুর্থ সেটটা মারিন চিলিচ কী ভাবে দাপটে দখল করে নিল। তখন ভাবছিলাম, এটাই হয়তো টার্নিং পয়েন্ট। ম্যাচের মোড় ঘুরে যাওয়ার মতো মুহূর্ত। ৩৬ বছর বয়সি ফেডেরার আর পারবে না। পাঁচ সেটে খেলে জেতার মতো দম থাকবে না। ফেডেরারের জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো তখন ভাবতো, ঠিক আছে আমি যথেষ্ট লড়েছি, হেরে গেলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু ফেডেরার অন্য গ্রহের খেলোয়াড়।

ঠিক তার পরেই দেখলাম ফেডেরার নিজের খেলাটা একেবারে অন্য পর্যায়ে তুলে আনল। দ্বিতীয় গিয়ার থেকে যেন চতুর্থ, পঞ্চম গিয়ারে নিয়ে গেল খেলাটা। যার সামনে খর-কুটোর মতো উড়ে গেল চিলিচ। ফল ফেডেরারের পক্ষে ৬-২, ৬-৭ (৫-৭), ৬-৩, ৩-৬, ৬-১। যে কোনও সত্যিকারের চ্যাম্পিয়নের এটাই বৈশিষ্ট্য। সে চাপের মুখে নিজের চরম ফর্মটা বের করে নিয়ে আসতে পারে। বড় মঞ্চে ঠিক সময়ে জ্বলে উঠতে পারে।

কিন্তু এই বয়সে দু’সপ্তাহ ধরে একটা গ্র্যান্ড স্ল্যামে খেলার ধকল সামলে ফাইনালে ফের পাঁচ সেটে জেতা, অবিশ্বাস্য। টেনিসে একটা-দুটো গ্র্যান্ড স্ল্যামই অনেক খেলোয়াড়ের কাছে জীবনের সেরা কৃতিত্ব অর্জন হয়ে থাকে। সেখানে প্রায় ৩৭ বছর বয়সে একটা লোক ২০টা গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতছে, এটা বোধহয় বিশ্বে যে কোনও খেলাধুলোর ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ একটা নজির হয়ে থাকবে চিরকাল।

আরও পড়ুন: ২০তম গ্র্যান্ড স্লাম ফেডেরারের

জানি না ফেডেরার কী ভাবে এটা পারে। ওর তো কিছুর অভাব নেই। টেনিস বিশ্বের প্রায় সব ট্রফি জিতেছে। প্রচণ্ড ধনী, নিজের প্রাইভেট জেট-ঠেট সব রয়েছে। সে কী ভাবে দিনের পর দিন নিজেকে প্র্যাক্টিসে ডুবিয়ে দিতে পারে? কী ভাবে বয়সে আট-দশ বছরের ছোট খেলোয়াড়দের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে সমানে? রোজ সকালে উঠে একই ভাবে প্র্যাক্টিসে যাওয়ার জন্য নিজেকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

হয়তো টেনিসের প্রতি ওর প্রবল ভালবাসা একটা কারণ। ফেডেরারের প্রাক্তন কোচ ও আমার বন্ধু টোনি রোচের মুখে শুনেছি কী ভাবে প্রচণ্ড গরমে ও অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের জন্য প্রস্তুতি নিত দুবাইয়ে। দিনের পর দিন। ৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস গরমে অক্লান্ত ভাবে হিট করে যেত। যেন ওটা ছাড়া জীবনে আর কিছু নেই।

এটাই হয়তো কারণ ১৫ বছরে (২০০৩-২০১৮) ২০টা ট্রফি জিতে ফেডেরারের গ্র্যান্ড স্ল্যামের এভারেস্ট তৈরি করতে পারার। পুরুষদের মধ্যে যে রেকর্ড আর কারও নেই। মার্গারেট কোর্ট (২৪), সেরিনা উইলিয়ামস (২৩), স্টেফি গ্রাফ (২২) ছাড়া ২০টা গ্র্যান্ড স্ল্যামের এলিট ক্লাবে প্রথম পুরুষ খেলোয়াড় ফেডেরারই। ওপেন যুগে গ্র্যান্ড স্ল্যাম মোট ট্রফির ১০ শতাংশই জিতেছে ফেডেরার। আর কোনও টেনিস খেলোয়াড় এই এভারেস্টে কোনও দিন পৌঁছতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। নোভাক জকোভিচ হয়তো পারত। কিন্তু এখন পেশাদার টেনিসে চোট-আঘাত এড়িয়ে এত দীর্ঘ কেরিয়ার ধরে রাখা খুব খুব কঠিন। জকোভিচের পক্ষেও।

নিজে সর্বোচ্চ পর্যায়ের টেনিস খেলেছি, গ্র্যান্ড স্ল্যামে খেলেছি, ডেভিস কাপের ফাইনালে খেলেছি। তাই জানি কতটা চাপ সামলাতে হয় এই পর্যায়ের টেনিসে। একটা গ্র্যান্ড স্ল্যামে সাতটা ম্যাচ খেলার ধকল সামলে চ্যাম্পিয়ন হওয়া কতটা কঠিন। ফেডেরার সেটাই এই বয়সে এত অনায়াসে করে দেখাচ্ছে। তাও ওর থেকে ছ’সাত বছরের ছোট খেলোয়াড়দের ফিটনেসে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। আসলে ফেডেরারের খেলার স্টাইল যা তাতে শরীরের উপরে বেশি ধকল পড়ে না। নাদাল, জকোভিচ যে ভাবে শারীরিক শক্তির উপর বেশি নির্ভরশীল, ওদের খেলা অনেক বেশি ফিজিক্যাল, ফেডেরার সেখানে কোর্টে যেন উড়ে বেড়ায়। যেন একটা বাচ্চা ছেলে হাল্কা পায়ে গোটা কোর্টে রাজত্ব করছে।

অনেকের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে এই ফেডেরার কোথায় থামবে?

শুনেছি ‘সুইস ইন্ডোরস’ টুর্নামেন্টের সঙ্গে ফেডেরারের তিন বছরের চুক্তি রয়েছে। মানে আরও তিন বছর ও পেশাদার টেনিসে থাকছে এটা ধরে নেওয়াই যায়। যে রকম ফর্মে খেলছে তাতে অবসরের কোনও প্রশ্নই এখন উঠছে না। ফেডেরারকে দেখেও সেটা স্পষ্ট।

তবে তিন বছর খেললেও ওকে সব গ্র্যান্ড স্ল্যামে হয়তো দেখা যাবে না। গত বারের মতো এ বারও ক্লে-কোর্ট মরসুমে ফেডেরার বিশ্রাম নিতে পারে। বেছে বেছে টুর্নামেন্ট খেলার এই স্ট্র্যাটেজিটাই কিন্তু ওর গত দু’বছরে তিন নম্বর গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার অন্যতম কারণ। সেটাই নিশ্চয়ই ধরে রাখবে ও।

তবে মেলবোর্ন পার্কে রবিবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে ফেডেরার যে ভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিল তাতে হয়তো অনেক সমর্থকই চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। গ্রেট খেলোয়াড়রা এ রকমই নম্র হয়। যেমন আমাদের সচিন তেন্ডুলকর। কত নম্র, কত মাটির কাছাকাছি। রড লেভার এরিনায় ট্রফিটা হাতে নিয়ে কেঁদেই ফেলল ফেডেরার। স্বয়ং রড লেভার তখন দর্শকাসনে বসে।

দু’বছর আগে বলেছিলাম ফেডেরার আর গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে পারবে না। ফেডেরার আমাকে ভুল প্রমাণ করেছে গত বারই। এ বার বলছি, যত বার ফেডেরার আমাকে ভুল প্রমাণ করবে, সব চেয়ে বেশি খুশি যে লোকটা হবে সে— আমিই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Roger Federer Australian Open Tennis Grand Slam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE