দর্শক: ময়দানে দুই প্রধানের ম্যাচে এখন দেখা যাচ্ছে মেয়েদেরও। ফাইল চিত্র
পুরো খেলা দেখা হল না। অসহায় অবস্থা বিরতির সময় ট্যাক্সি ধরে দ্রুত বাড়ি ফিরে গেলেন সল্টলেকের আই টি সেক্টরের কর্পোরেট কোম্পানির ম্যানেজার দেবারতি দত্ত।
এত দিন টিভিতে বসে বিদেশি ফুটবল দেখতেন। হঠাৎই অফিস সতীর্থদের পাল্লায় পড়ে ইস্টবেঙ্গলের একটি ফ্যান ক্লাবের সদস্য হয়েছেন। কয়েক দিন আগে লাল-হলুদ জার্সি পরে, মুখে রং মেখে বিদেশের গ্যালারিতে থাকা মেয়েদের মতো খেলা দেখতে এসেছিলেন। আবির উড়িয়ে, চিৎকার করে যাচ্ছিলেন নিরন্তর। কিন্তু বিরতির সময় বাথরুম খুঁজতে গিয়েই সমস্যায় পড়লেন বছর পঁচিশের মেয়েটি। খাওয়ার জলের বোতল কিনেছিলেন, কিন্তু বাথরুম না পেয়ে গড়িয়ার বাড়িতে ফিরে গিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন, ‘‘যেখানে মাঠে সামান্যতম সুবিধাটুকু নেই, সেখানে মেয়েদের মাঠে যাওয়াটা নিরাপদ নয়। ছেলেদের যে ভাবে প্রকাশ্যে বাথরুম করতে দেখলাম, সেটাও খুব খারাপ। দুর্গন্ধময়।’’
মোহনবাগান মাঠে গেলেই দেখা যায় মৌসুমী ভৌমিক আর চৈতালি পাত্রকে। অনুশীলনে বা ম্যাচে বড় একটা পতাকা নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই দুই ছাত্রী আসেন নিয়মিত। একটি ফ্যান ক্লাবের সদস্য ওঁরা। ছেলে বন্ধুদের মতোই সবুজ-মেরুন বলতে পাগল। একটু দ্বিধা নিয়েই ওঁরা বলছিলেন, ‘‘আমরা টিকিট কেটে মাঠে ঢুকি। মাঠে আসার আগে কম জল খাই। খুব বাথরুমের প্রয়োজন হলে ধর্মতলার বাসস্ট্যান্ডে যাই। কোনও বন্ধুর বাইকে চেপে। আসলে ক্লাবকে এত ভালবাসি যে, কষ্ট হলেও মাঠে আসি।’’
গত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের খেলা দেখতে আসছেন মেয়েরা। ময়দানে রাতের আলোয় এ বার কলকাতা লিগ হওয়ায় গড়ে প্রতি ম্যাচে তিনশো থেকে চারশো মহিলা সমর্থক আসছেন। দুই ক্লাবেরই প্রচুর ফেস বুক গ্রুপ বা ফ্যান ক্লাব আছে। কখনও প্রেমিক বা কখনও স্বামীর সঙ্গী হতে ওগুলোর সদস্য হয়েছেন অনেকেই। স্কুল-কলেজ বন্ধুদের সঙ্গে এই গ্রুপ বা ফ্যান ক্লাবের সদস্য হয়েছেন বেশির ভাগ। গ্যালারিতে বসে ওঁরা আবির ওড়ান, স্মোক বম্ব ফাটান, গান করেন, মশাল জ্বালেন, পতাকা ওড়ান—যা রঙিন করে তোলে মাঠকে। অথচ ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান মাঠে এঁদের জন্য ন্যূনতম পরিষেবাই নেই। খাবার জল, বাথরুম তো নেই-ই, আলাদা লাইনে টিকিট বিক্রির ব্যবস্থাও নেই। মুখে পেশাদার, কাজে অপেশাদার কর্তারা জল বা অস্থায়ী বাথরুমের কথাও ভাবেননি কোনও দিন। সেনা-নিয়মের দিকে বা সরকারের দিকে আঙুল তুলে দায় সারেন ওঁরা। বলার সময় মনে রাখেন না, মেয়েরা তাদের ক্লাবেরই সমর্থক। প্রতি বছর দশ-বারো কোটির দল গড়েন দুই প্রধানের কর্তারা, অথচ দশ-বারো লাখ টাকা খরচ করে দশটি ম্যাচের জন্য দর্শকদের স্বাচ্ছন্দের কথা ভাবেন না।
দুই ক্লাবেই সাতশো থেকে আটশো মেয়ে সদস্য আছেন। যাঁরা ক্লাবের ভোটে অংশ নেন। দুই ক্লাবেই কর্মসমিতিতে আছেন অথবা ছিলেন দুই ঝকঝকে, শিক্ষিত মেয়ে-কর্তা। মোহনবাগান সচিব অঞ্জন মিত্রের মেয়ে সোহিনী চৌবে এখনও ক্লাব কর্মসমিতির সদস্য। আর ইস্টবেঙ্গলের ফুটবল সচিব রজত গুহর মেয়ে দেবপ্রিয়া গত বছরও ছিলেন কর্ম- সমিতিতে। সোহিনী এবং দেবপ্রিয়া দু’জনেই ক্লাবের কাজে প্রচণ্ড সক্রিয়। দু’জনেই স্বীকার করছেন, ইডেনের মতো এ বার প্রচুর মেয়ে খেলা দেখতে আসছেন তাদের মাঠে। এবং এসে নানা সমস্যায় পড়ছেন। বিশেষ করে সমর্থক গ্যালারিতে। সোহিনী বলছিলেন, ‘‘ম্যাচ থাকলে আমি নিজেই সমস্যায় পড়ি। তখন তাঁবুর ভিতরেও যেতে পারি না। অনেক বলেকয়ে সদস্য গ্যালারির নীচে একটা অস্থায়ী বাথরুম করিয়েছি এ বার। বাকি গ্যালারির নীচে তো তা-ও নেই।’’ একই রকম কথা শোনা গেল দেবপ্রিয়ার গলায়। ‘‘মহিলা সদস্যদের জন্য একটা বাথরুম আছে। তবে জায়গাটা ঠিক নয়। অন্য গ্যালারিতে তো তাও নেই। খেলা দেখতে আসা মেয়েরা বিপদে পড়ে মাঝেমধ্যেই আমার কাছে আসে। তখন সাহায্য করতে পারি না। খুবই সমস্যা।’’
বিশ্বায়নের এই যুগে শতবর্ষ পেরোনো বা ছুঁতে যাওয়া দুই ক্লাবের কর্তারা পেশাদারিত্বের কথা বলছেন। তারা এখনও বুঝতে পারছে না, সদস্য-সমর্থকদের ন্যুনতম স্বাচ্ছ্বন্দ না দিতে পারলে পেশাদার হওয়া সম্ভব নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy