Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কোহালিয়ানার দ্বিতীয় সত্তায় রক্ষা পেল ভারত

কে জানত, নিশ্চিন্ত ড্রয়ের প্রত্যাশিত স্ক্রিপ্ট পকেটে নিয়ে নয়, ভারত অধিনায়ককে রাজকোট পিচের পঞ্চম দিনে নামতে হবে টেস্ট বাঁচাতে! বাইশ গজে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে যে, তাঁর বিশ্বসেরা টেস্ট টিমও চাপে পড়লে কেঁপে যায়। কেঁপে যায় ঘরের মাঠে, দেড় সেশন ব্যাট করতে গিয়েও তারা সৃষ্টি করতে পারে অসহ্য টেনশনের অবাক পৃথিবী। বিরাট কোহালিকে দেখতে হবে যে, প্যানিক বাটনে চাপ পড়লে আজও তাঁর টিমের প্রধান উদ্ধারকর্তা আদতে ঘুরেফিরে সেই একজন।

ভরসার হাত। টেস্ট বাঁচিয়ে ফিরছেন বিরাট ও জাডেজা। ছবি: পিটিআই

ভরসার হাত। টেস্ট বাঁচিয়ে ফিরছেন বিরাট ও জাডেজা। ছবি: পিটিআই

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
রাজকোট শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:০০
Share: Save:

আপাত-দৃষ্টিতে এক নিষ্ফলা টেস্ট যে তার শেষ পর্বে এসে এমন নাটকীয়তা উপস্থিত করবে, আতঙ্কের মেঘে ঢেকে দেবে ভারতীয় টিমের আকাশ, কে জানত।

কে জানত, নিশ্চিন্ত ড্রয়ের প্রত্যাশিত স্ক্রিপ্ট পকেটে নিয়ে নয়, ভারত অধিনায়ককে রাজকোট পিচের পঞ্চম দিনে নামতে হবে টেস্ট বাঁচাতে! বাইশ গজে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে যে, তাঁর বিশ্বসেরা টেস্ট টিমও চাপে পড়লে কেঁপে যায়। কেঁপে যায় ঘরের মাঠে, দেড় সেশন ব্যাট করতে গিয়েও তারা সৃষ্টি করতে পারে অসহ্য টেনশনের অবাক পৃথিবী। বিরাট কোহালিকে দেখতে হবে যে, প্যানিক বাটনে চাপ পড়লে আজও তাঁর টিমের প্রধান উদ্ধারকর্তা আদতে ঘুরেফিরে সেই একজন।

তিনি নিজে।

ভারত আজ হারেনি। সিরিজের প্রথম টেস্ট বাঁচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রবিবাসরীয় রাজকোটে ইংল্যান্ড যদি আর একটু আগে ডিক্লেয়ার করে দিত, ভারতকে যদি খেলতে হত আরও গোটা পনেরো ওভার, সর্বোপরি কোনও বেয়াড়া ফাটলে পড়ে কোনও বল যদি অতর্কিত তুলে নিয়ে যেত কোহালিকে, কে বলতে পারে দুর্ঘটনা ঘটত না? চল্লিশ ওভার ব্যাট করতে না করতে ভারতের কিন্তু ছ’টা বেরিয়ে গিয়েছিল।

দুপুর তিনটে নাগাদ দেখা গেল, ভারতীয় টিমের সঙ্গে থাকা একজন প্রেসবক্সের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের পর সিগারেট টানছেন আর অবশিষ্ট ওভার গুনছেন। কুড়ি, আঠারো, ষোলো...। মিডিয়াকুল ততক্ষণে আবার অতীতের ধুলো সরিয়ে ঝেড়েমুছে বার করে ফেলেছে দশ বছর আগে ওয়াংখেড়ের এক ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট, যা দেখাচ্ছে শেষ দিনে ৩১৩ তাড়া করতে গিয়ে কী ভাবে একশো রানে শেষ হয়ে গিয়েছিল রাহুল দ্রাবিড়ের ভারত। শেষ দিনের যুদ্ধে জীবিত ছিল মাত্র আটচল্লিশ ওভার। দশ বছর পূর্বের ওয়াংখেড়ের মতো রবিবারের রাজকোটে নব্বই ওভার খেলার ব্যাপার ছিল না ভারতের। নিয়মমাফিক ৪৯ ওভার খেলতে হত, সময় বাঁচলে আর দু’তিনটে বেশি। টার্গেট এ বার ৩১০। প্রতিকুলতার বিচারে দু’টো তুলনায় আসে না ঠিকই। কিন্তু নাটকীয়তার বিচারে? ৭০ রানের মধ্যে যদি চারটে চলে যায়, বাকিটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হবে না? তখনও তিরিশটা ওভার পড়ে। আর সবচেয়ে বড় হল, কিছুতেই এই ব্যাটিংয়ের সঙ্গে টেস্টের প্রথম ইনিংসের ভারতীয় ব্যাটিংকে মেলানো যাচ্ছে না। দু’টো ভিন্ন গ্রহের মনে হচ্ছে। চরিত্রদের দেখতে এক, নাম এক। শুধু কার্যকারিতায় আকাশ-পাতাল তফাত। কেউ যেন প্রথম ইনিংস ব্যাটিংয়ের ওই অকুতোভয় মনোভাবকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে দিয়েছে!

চেতেশ্বর পূজারা প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিকারী। কিন্তু এ দিন আদিল রশিদের নিরীহ লেগস্পিনে পুশ করতে গিয়ে এলবিডব্লিউ। বলটা লেগস্টাম্প লাইনের বাইরে পড়েছিল। কিন্তু ভারত আশ্চর্যজনক ভাবে রিভিউ করাল না।

মুরলী বিজয়— ইনিও তাই। প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরিকারী। চা বিরতির পর নেমেই ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ক্যাচ।

অজিঙ্ক রাহানে— মইন আলির বলটা ফাটলে পড়ে অতর্কিত ঘুরে গিয়েছিল। রাহানে যে ভাবে সামলাতে গেলেন, অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। এবং বোল্ড।

এক-এক সময় ভাবলে আতঙ্কিত লাগবে যে, ওই সময় কোহালি-অশ্বিন দাঁড়িয়ে না গেলে কী হত। ক্রিকেট-পৃথিবী জানে, রান তাড়া করায় কোহালি কী বিষম বস্তু, কত দুর্ধর্ষ ‘চেজমাস্টার’। কিন্তু টেস্ট বাঁচানোর সময়? রাজকোট দর্শক নিজেদের ভাগব্যান মনে করতে পারে। নিজেদের উদ্বোধনী টেস্টেই তারা কোহালিয়ানার দ্বিতীয় সত্তাকেও দেখে নিতে পারল বলে। এ ব্যাটিং তো কোহালি শেষ কবে করেছেন? যেখানে ড্রাইভ বা কাট মারার লোভনীয় প্রস্তাবেও ন্যূনতম প্রভাবিত হচ্ছেন না, বলকে শেষ পর্যন্ত দেখে যেতে দিচ্ছেন কিপারের গ্লাভসে। নিজের ব্যাটের কাছে পাঁচ-ছ’জন ক্ষুধার্ত ইংরেজ ফিল্ডারকে ওঁত পেতে থাকতে দেখেও যিনি অবিচল থাকছেন, পার্টনারকে বলে আসছেন বহু দিন এমন পরিস্থিতি আসেনি রে! এত দিন হয় জিততাম, নয় হারতাম। চল, আজ উপভোগ করি!

সেলাম-যোগ্য মনন। কোহালি ৩৫ ওভার ব্যাট করে ৪৯ নটআউট থাকলেন। সেলাম-যোগ্য তাঁর এক পার্টনারও। তিনি, রবিচন্দ্রন অশ্বিন। বোলার অশ্বিনের তেজ রাজকোট টেস্ট দেখেনি। কিন্তু ব্যাটসম্যান রবির রোষ দু’ইনিংসেই দেখল ইংল্যান্ড। হিসেব বলছে, অশ্বিনের প্রথম ইনিংসের ৭০ রান না থাকলে ভারতের কপালে আজ দুঃখ লেখা থাকতেও পারত। ইংল্যান্ড তিনশোর উপর চলে যেত তখন বহু আগে, ভারতকে খেলতেও হত অনেক-অনেক বেশি ওভার। দ্বিতীয় ইনিংসে অশ্বিন ৩২ করলেন। কিন্তু পরিস্থিতি বিচারে, ওটা ১৩২। তিনি দ্রুত চলে গেলে কোহালির ভরসার সঙ্গী হিসেবে পড়ে থাকতেন জাডেজা আর ঋদ্ধিমান। ইংরেজ অধিনায়ক—তিনিও বুঝে গিয়েছিলেন, বাকি কিছু নয়। শুধু এই পার্টনারশিপটাকে ভাঙতে হবে। ক্রিকেট-কেরিয়ারে নিজের তিরিশ নম্বর টেস্ট সেঞ্চুরি, ভারতের মাটিতে সেঞ্চুরির বিচারে এভার্টন উইকস-ক্লাইভ লয়েডদের হারিয়ে দেওয়ার দিনটা (কুকের এখন পাঁচ, লয়েডদের চার) তা হলে আরও হয়তো উপভোগ্য হতে পারে। আসলেও আসতে পারে অত্যাশ্চর্য জয়। অনিন্দ্যসুন্দর কুক হিংস্র স্ট্র্যাটেজিও নিলেন। ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ, শর্ট লেগ, লেগ স্লিপ, স্লিপ, সিলি পয়েন্ট রেখে মইন-রশিদ ছেড়ে দিলেন। টার্গেট প্যাভিলিয়ন প্রান্তের একটা মারণ-ফাটল। যা রাহানের মতো দারুণ টেকনিকসম্পন্নকেও বিমূঢ় করে ছেড়ে দিয়েছে। সাক্ষাৎ মৃত্যুগহ্বর!

কিন্তু লাভ হয়নি। কোহালি-অশ্বিন অমূল্য পনেরোটা ওভার খেলে দিলেন। পরে ঋদ্ধিমান অহেতুক স্টেপ আউট করতে গিয়ে আউট হলেও রক্তচাপ বৃদ্ধি ঘটেনি জাডেজা ঘরের মাঠে বাকিটা অধিনায়কের সঙ্গে ধরে নেওয়ায়। অসম্মান আসেনি আর, শুধু একটা দুঃখ থাকল। টেস্টটা শেষ হতে পারত অন্তত সমানে-সমানে কিন্তু তা আর হল না। বরং পাঁচ টেস্টের দীর্ঘ সিরিজে যে জিনিসটা অতীব প্রয়োজন তা আপাতত বিশাখাপত্তনম টেস্টে ভারত নয়, ইংল্যান্ড নিয়ে ঢুকছে। তিন অক্ষরের একটা শব্দ। পোশাকি নাম?

বিশ্বাস।

ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস: ৫৩৭

ভারত প্রথম ইনিংস: ৪৮৮

ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ১১৪-০-এর পর) কুক ক জাডেজা বো অশ্বিন ১৩০, হামিদ ক ও বো মিশ্র ৮২, রুট ক ঋদ্ধি বো মিশ্র ৪, স্টোকস অপরাজিত ২৯, অতিরিক্ত ১৫, মোট ২৬০-৩ ডিঃ। পতন: ১৮০, ১৯২, ২৬০। বোলিং: শামি ১১-১-২৯-০, জাডেজা ১৫-১-৪৭-০, অশ্বিন ২৩.৩-৪-৬৩-১, উমেশ ১৩-২-৪৭-০, মিশ্র ১৩-০-৬০-২। ভারত দ্বিতীয় ইনিংস: বিজয় ক হামিদ বো রশিদ ৩১, গম্ভীর ক রুট বো ওকস ০, পূজারা এলবিডব্লু রশিদ ১৮, কোহালি অপরাজিত ৪৯, রাহানে বো আলি ১, অশ্বিন ক রুট বো আনসারি ৩২, ঋদ্ধি ক ও বো রশিদ ৯, জাডেজা অপরাজিত ৩২, অতিরিক্ত ০, মোট ১৭২-৬। পতন: ১, ৪৭, ৬৮, ৭১, ১১৮, ১৩২। বোলিং: ব্রড ৩-২-৮-০, ওকস ৪-১-৬-১, আনসারি ৮-১-৪১-১, আলি ১৯-৫-৪৭-১, রশিদ ১৪.৩-১-৬৪-৩, স্টোকস ২-১-১-০, রুট ২-০-৫-০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Virat Kohli Rajkot
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE