Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মানিকপুর থেকে মোহনবাগান

গ্রামের দলের হয়ে খেলতে খেলতেই রেলের ফুটবল দলে সুযোগ। তারপর মোহনবাগান। সবুজ-মেরুন জার্সিতে খেলেছেন। একসময় ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন ময়দান থেকে। নন্দীগ্রামের সুযশ বেরার সঙ্গে কথা বললেন অভিষেক চট্টোপাধ্যায়গ্রামের দলের হয়ে খেলতে খেলতেই রেলের ফুটবল দলে সুযোগ। তারপর মোহনবাগান। সবুজ-মেরুন জার্সিতে খেলেছেন। একসময় ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন ময়দান থেকে।

মাঠে: ১৯৮২ সালে শিলিগুড়িতে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে বল পায়ে সুযশ বেরা। নিজস্ব চিত্র

মাঠে: ১৯৮২ সালে শিলিগুড়িতে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে বল পায়ে সুযশ বেরা। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৮ ০১:২৪
Share: Save:

প্রশ্ন: আপনার বাড়ি কোথায়?

উত্তর: পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম থানার মানিকপুর গ্রামে। এখন কলকাতার কুঁদঘাটে থাকি। মোহনবাগানে খেলতে খেলতেই কুঁদঘাটে জায়গা কিনে রেখেছিলাম। খেলা ছাড়ার পরে সেখানে বাড়ি করেছি।

প্রশ্ন: ফুটবলে প্রথম পা?

উত্তর: খুব ছোট থেকেই পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলছি। গ্রামে যেরকম হয় আর কী। তখন থেকেই আমার খেলা দেখে কয়েকজন বলত, ছেলেটার মধ্যে প্রতিভা রয়েছে। সেই সময়ে আমাদের গ্রাম মানিকপুরের শক্তিশালী ফুটবল দল ছিল। সেই দল বিভিন্ন জায়গায় খেলতে যেত। নবম শ্রেণি থেকে আমি সেই দলের নিয়মিত সদস্য ছিলাম। স্কুল দলের হয়েও নিয়মিত খেলেছি। দলের মধ্যে সবথেকে ছোট ছিলাম।

প্রশ্ন: আপনার স্কুল কোথায়?

উত্তর: নন্দীগ্রামের ব্রজমোহন তিওয়ারি শিক্ষানিকেতন।

প্রশ্ন: পাড়ার দলের হয়ে খেলার কোনও বিশেষ স্মৃতি?

উত্তর: আমাদের ছোটবেলায় নন্দীগ্রামে বিনয় স্মৃতি ফুটবল নামে বড় মাপের প্রতিযোগিতা হত। সেখানে কলকাতার দল খেলতে যেত। তখন স্টিল ইন্ডিয়া লিমিটেডের ইস্পাত নামে একটি ফুটবল দল ছিল। সেই দল একবার বিনয় স্মৃতি ফুটবলে খেলতে এসেছিল। মানিকপুরের সঙ্গে তাদের খেলা ছিল। ইস্পাতের সেই দলে কলকাতা ময়দানে খেলা কয়েকজন ফুটবলার ছিলেন। সেই খেলায় আমরা জিতেছিলাম। গ্রামের মানুষ খুব আনন্দ করেছিলেন। খেলা শেষ হওয়ার পরে ইস্পাতের ফুটবলারেরা আমার সঙ্গে যেচে আলাপ করেছিল। বলেছিল, তুমি কলকাতায় খেলতে এস।

প্রশ্ন: কলকাতায় এলেন কবে?

উত্তর: প্রথম কলকাতায় খেলা বলতে মোহনবাগান তাঁবুর পাশের ক্লাব সিএফসি-তে। ওরা তখন চতুর্থ নয়তো পঞ্চম ডিভিশনে খেলত। আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। তবে এক বছর খেলার পরে যাতায়াতের অসুবিধার জন্য গ্রামে ফিরে এসেছিলাম। তার মাঝে জেলা স্কুল দল, গ্রামীণ বাংলা দলের হয়ে খেলেছি।

প্রশ্ন: বড় দলে এলেন কী ভাবে?

উত্তর: উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে চাকরির চেষ্টা করছিলাম। আমার পাড়ার এক দাদা রেলের হয়ে খেলত। সালটা ১৯৭৫। তিনি আমায় খবর দিলেন মুম্বইতে রেল কিছু ফুটবলার নিয়োগ করবে। আমার তখন আঠারো বছর বয়স। মুম্বই চলে গেলাম। বাড়িতে তেমন কিছু জানত না। মুম্বইয়ের সেই শিবিরে নির্বাচকদের আমায় পছন্দ হল। দু’তিন ধরে বাছাই পর্ব চলার পরে জানানো হল, আমি নির্বাচিত হয়েছি। তবে চাকরি করতে হবে রাজস্থানের কোটায়। আমি রাজি হয়ে গেলাম। তারপর টানা ছয় বছর রেলের হয়ে সন্তোষ ট্রফি খেলেছি। অধিনায়কও হয়েছি। সন্তোষ ট্রফি তখন দেশের অন্যতম সেরা ফুটবল প্রতিযোগিতা। তার মধ্যে ১৯৮০ সালের সন্তোষ ট্রফি আমার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

প্রশ্ন: কেন?

উত্তর: ১৯৮২ সালের এশিয়ান গেমসে জাতীয় ফুটবল দল তৈরির জন্য বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নজর রাখা হচ্ছিল। নির্বাচকদের অন্যতম ছিলেন শৈলেন মান্না। ১৯৮০ সালে সন্তোষ ট্রফির খেলা হয়েছিল কটক এবং রউরকেল্লার মাঠে। তখন রেলের কোচ ছিলেন পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। সেবার আমরা সেমিফাইনালে বাংলাকে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছিলাম। তবে ফাইনালে পঞ্জাবের কাছে ১-২ গোলে হেরে যাই। সন্তোষ ট্রফি শেষ হওয়ার পরেই মোহনবাগানের অফার পাই।

প্রশ্ন: আপনি তো তখন রেলে চাকরি করেন?

উত্তর: হ্যাঁ। আমাকে মোহনবাগান কর্তারা বলেছিলেন, বাংলায় চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। তারপর আমি জাতীয় শিবিরে ডাক পেয়ে যাই। সেবার জাতীয় শিবির হয়েছিল সল্টলেকে। জাতীয় শিবির থেকে মোহনবাগানে সই করি। রেলের চাকরি ছেড়ে বেঙ্গল ইমিউনিটি নামে একটি ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থায় যোগ দিই। সেই সংস্থা ২০০৩ সালে বন্ধ হয়ে যায়। সব কর্মীকে স্বেচ্ছাবসর নিতে হয়।

প্রশ্ন: মোহনবাগানে কত দিন খেলেছেন?

উত্তর: টানা পাঁচ বছর। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬। ১৯৮৭ সালে মহমেডানে খেলেছি। তারপর কয়েকটি ছোট ক্লাবের হয়ে খেলে গিয়েছি। অফিস লিগ খেলেছি ২০০৩ সাল পর্যন্ত। অফিস ঝাঁপ বন্ধ করার পরে খেলা পুরোপুরি ছেড়ে দিই।

প্রশ্ন: শুরুর দিনগুলোর কথায় ফিরে আসি। আপনার বাবা তো ছোটবেলায় মারা গিয়েছিলেন। আপনার পরিবার ফুটবল খেলার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল?

উত্তর: আমার বড়দা তাপস বেরা খেলা ভালবাসতেন। তাঁর জন্য ছোটবেলায় সংসারের দায়িত্ব আমায় সেইভাবে নিতে হয়নি। আমি খোলা মনে খেলতে পেরেছিলাম।

প্রশ্ন: বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফি খেলেছেন?

উত্তর: না। বাংলা দল তো তখন তারকা সমৃদ্ধ। সেই দলে সুযোগ পাওয়া সত্যিই শক্ত ছিল।

প্রশ্ন: তখন মোহনবাগান দলও তো তারকা সমৃদ্ধ। সেখানে টানা পাঁচ বছর খেলছেন, কিন্তু সন্তোষ ট্রফির বাংলা দলে সুযোগ পাননি। এটা মানাটা একটু কঠিন। এই নিয়ে কোনও অভিমান রয়েছে?

উত্তর: অভিমান থাকতে যাবে কেন? যতটুকু পেয়েছি তাতে আমি সন্তুষ্ট।

প্রশ্ন: আপনার প্রিয় কোচ?

উত্তর: (একটু ভেবে) প্রদীপ (পিকে) বন্দ্যোপাধ্যায়। কয়েকজন কোচকে দেখতাম, তিনি প্রথম একাদশের ফুটবলারদের দিকেই শুধু নজর দিচ্ছেন। রিজার্ভ বেঞ্চের ফুটবলারেরা কী করছেন, সেটা খেয়াল করছেন না। কিন্তু প্রদীপদার নিয়ম ছিল অন্যরকম। উনি দলের সবাইকে ফিট রাখতেন। যে ছেলেটি প্রথম একাদশে একদিনও সুযোগ পায়নি, প্রদীপদা তাকেও নিয়মিত অনুশীলন করাতেন। যাতে দরকারে সেই ছেলেটিকেও টানা ৯০ মিনিট খেলানো যেতে পারে। এছাড়া প্রদীপদার ‘ভোকাল টনিকে’র কথা তো সবাই জানে। সত্যি বলতে কী, আমি ১৮-১৯ বছর পর্যন্ত কোথাও প্রশিক্ষণ নেওয়ার সেভাবে সুযোগ পাইনি। নিজে যেটা ভাল মনে করেছি সেটাই করেছি। কিন্তু প্রদীপদার সংস্পর্শে আসার পরে বুঝলাম, আগে নিজে নিজে যা শিখেছি তার অনেক কিছুই ভুল ছিল! তত দিন তো কিছুটা হলেও দেরি হয়ে গিয়েছে। তার জন্য কিছুটা পিছিয়েও পড়েছিলাম। তবে তার জন্য আমার কোনও খেদ নেই। কারণ নন্দীগ্রাম তখন অজ গ্রাম। সেখান থেকে মোহনবাগানে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম, সেটাই আমার কাছে বড় প্রাপ্তি ছিল।

প্রশ্ন: মোহনবাগান মনে রেখেছে?

উত্তর: অবশ্যই। আমি মোহনবাগানের আজীবন সদস্য। ক্লাবে বড় অনুষ্ঠান হলে ডাকে। সম্ভব হলে যাই।

প্রশ্ন: জীবনের সেরা তিন ম্যাচ?

উত্তর: ইডেনে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল খেলা। সালটা ১৯৮৪ সাল। প্রদীপদা তখন মোহনবাগানের কোচ। ওই ম্যাচে উনি আমাকে মাঝমাঠ সামলানোর বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেই ম্যাচে বাবু মানির গোলে মোহনবাগান জিতেছিল। এ ছাড়া ১৯৮৪ সালেই ডুরান্ড কাপ সেমিফাইনালের কথা বলতে হয়। পঞ্জাব পুলিশের বিরুদ্ধে আমার করা গোলে মোহনবাগান ফাইনালে ওঠে। ফাইনালে আমরা ইস্টবেঙ্গলকে ২ গোলে হারিয়েছিলাম।

প্রশ্ন: গ্রামে যান? যোগাযোগ করেছে?

উত্তর: গ্রামেই তো আমার শিকড়। আমার স্ত্রী মোটামুটি প্রতি মাসেই যাওয়ার চেষ্টা করেন। আমি চার-ছয় মাস ছাড়া যাই।

প্রশ্ন: আপনাদের সময়ে জেলার ফুটবল যে অবস্থায় ছিল, এখন তার থেকে কতটা বদলেছে?

উত্তর: অনেকটা বদলেছে। তার কারণ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। আমাদের সময়ে নন্দীগ্রাম থেকে কলকাতা আসতেই হাফ বেলা শেষ হয়ে যেত। এই প্রসঙ্গে আমাদের গ্রামের দু’জনের কথা খুব মনে পড়ছে। (একটু চুপ করে গিয়ে) শ্রীজীব পণ্ডা ও কানাই সাউ। শ্রীজীব মারা গিয়েছেন। কানাই বেঁচে রয়েছেন। এঁরা অনেক বড় ফুটবলার ছিলেন। কিন্তু গ্রামের ছেলে তো, কলকাতার মাঠে নামার সুযোগটাই পেল না। গ্রামের কত প্রতিভাই এইভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমি সেই ক্ষেত্রে ভাগ্যবান। সেই অবস্থাটা তো এখন বদলেছে। গ্রামের অনেক ছেলে এখন কলকাতা ময়দানে খেলছে। এটা ভাল বিষয়।

প্রশ্ন: এখন সত্যিই অনেক সুযোগ। কিন্তু তারপরেও বাংলার ছেলেরা জাতীয় দলে সেই ভাবে সুযোগ পাচ্ছে না কেন?

উত্তর: শারীরিক সক্ষমতায় পিছিয়ে যাচ্ছেন। কারণ যাঁরা ফুটবল খেলেন তাঁরা মূলত গরিব বা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসেন। সেখানে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার মেলে না।

প্রশ্ন: এখন কী করেন?

উত্তর: নিজেকে ফিট রাখার জন্য বাড়ির পাশের মাঠে ব্যায়াম করি। বাকি সময় বাড়িতেই থাকি।

প্রশ্ন: আইএসএল না আই লিগ?

উত্তর: আমার মতে, আইএসএলের থেকে আই লিগের দলগত মান ভাল। তবে আইএলএলের মোড়কটা খুব চকচকে। আই লিগ সেখানেই পিছিয়ে। এটাও মানতে হবে, আইএসএলে খুবই ভাল মানের কয়েকজন বিদেশি খেলেন।

প্রশ্ন: খুদে ফুটবল প্রতিভা তুলে আনার জন্য এআইএফএফ ‘বেবি লিগ’ চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেখানে চার থেকে বারো বছর বয়সী ছেলে-মেয়েরা একই দলে খেলতে পারবে। উত্তর-পূর্বের কিছু রাজ্যে ইতিমধ্যেই এই লিগ শুরু হয়ে গিয়েছে এবং জনপ্রিয় হয়েছে। সম্প্রতি আইএফএ অফিসে এই নিয়ে বৈঠক হয়েছে। সেখানে আপনার জেলা পূর্ব মেদিনীপুর জানিয়েছে, তারা এই লিগ আয়োজনে আগ্রহী। আপনাকে ডাকলে সহযোগিতা পাওয়া যাবে?

উত্তর: এই বিষয়ে আমাকে এখনও কেউ কিছু জানাননি। তবে এটা খুবই ভাল উদ্যোগ। নিজের জেলাকে সহযোগিতা করার জন্য আমি সব সময় প্রস্তুত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Football Nandigram Mohun Bagan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE