Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
বাংলার ফুটবলে আঁধার: আনন্দবাজারের ময়নাতদন্ত

সোনার খনি হাওড়াতেই হারিয়ে গিয়েছে প্রতিভা

কিংবদন্তিরা প্রত্যেকেই নজর কেড়েছিলেন জেলা লিগে খেলে। সেই হাওড়াতেই এখন শুধু জেলা লিগ নয়, ফুটবলই প্রায় ধ্বংসের মুখে!

অলিম্পিয়ান-ত্রয়ী: শৈলেন মান্না, বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অরুণ ঘোষ

অলিম্পিয়ান-ত্রয়ী: শৈলেন মান্না, বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অরুণ ঘোষ

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৮ ০৩:৫৫
Share: Save:

শৈলেন মান্না, সমর বন্দ্যোপাধ্যায় (বদ্রু), অরুণ ঘোষ, সুদীপ চট্টোপাধ্যায় সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায় থেকে তরুণ দে, বিকাশ পাঁজি—ফুটবলে এক সময় সোনার খনি ছিল হাওড়া জেলায়। আর এখন? টিমটিম করে জ্বলে তাদের ফুটবল শিখা।

কিংবদন্তিরা প্রত্যেকেই নজর কেড়েছিলেন জেলা লিগে খেলে। সেই হাওড়াতেই এখন শুধু জেলা লিগ নয়, ফুটবলই প্রায় ধ্বংসের মুখে! শুধু তাই নয়, হাওড়া স্টেডিয়ামেই কলকাতা লিগের ম্যাচ খেলতে গিয়ে আইএফএ-র এক কর্তার হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন ফুটবলারেরা।

১৯৪৮ সালে লন্ডন অলিম্পিক্সে ভারতের প্রতিনিধি শৈলেন মান্না প্রয়াত হয়েছেন বছর ছয়েক আগে। ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিক্সে ভারতীয় দলের অন্যতম সদস্য বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষোভ উগরে দিয়ে বললেন, ‘‘ফুটবল ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে, অনেক দিন আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। কারণ, মানুষ এখন ব্যস্ত মারামারি, লোক ঠকানোর খেলায়। ফুটবলের উন্নতির কথা কেউ ভাবে না।’’ বদ্রু হতাশ হাওড়া জেলায় আন্তঃস্কুল ও কলেজ ফুটবল প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। বলছিলেন, ‘‘আমার উত্থানও জেলা লিগ থেকে। কলকাতা ময়দানে অভিষেক বালি প্রতিভার হয়ে ১৯৪৮ সালে। মোহনবাগানে সই করি চার বছর পরে। আমরা ধাপে ধাপে উঠে এসেছি।’’

আরও পড়ুন
স্পটার রাখতেই হবে, প্রবল দাবি প্রাক্তনদের

১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিক্সে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করা অরুণ ঘোষের উত্থানও হাওড়া জেলা লিগ থেকে। তিনি বলছিলেন, ‘‘আমাদের কোচ ছিলেন দাশু মিত্র। আইএফএ শিল্ড চ্যাম্পিয়ন এরিয়ান দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। অফিস না গিয়ে সারা দিন মাঠে-মাঠে ঘুরে প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলার খুঁজতেন। বেতনও ঠিকঠাক পেতেন না। ফুটবলের প্রতি ভালবাসায় তা নিয়ে কোনও ক্ষোভও ছিল না। দাশুদার জন্যই আমি এই জায়গায় পৌঁছতে পেরেছি। অথচ হাওড়া থেকে এখন ফুটবলটাই প্রায় উঠে গিয়েছে।’’ কেন এই হাল? প্রাক্তন তারকার ব্যখ্যা, ‘‘ফুটবলের আগ্রহ অনেক কমে গিয়েছে। এখন যেখানে হাওড়া স্টেডিয়াম, সেখানে আগে দু’টো মাঠ ছিল। আমাদের খেলা দেখতে ভিড় জমে যেত মাঠের ধারে। এখন তো মাঠ খালি পড়ে থাকে।’’ তিনি যোগ করেন, ‘‘জেলা লিগ থেকেই উঠে আসত ফুটবলারেরা। অথচ সেই লিগ এখন ধুঁকছে।’’

হাওড়া জেলা থেকেই উঠেছেন সত্যজিৎ। মোহনবাগানের প্রাক্তন তারকা বলছিলেন, ‘‘সব চেয়ে কষ্ট হয় হাওড়া ময়দানের হাল দেখলে। আমাদের ছোটবেলায় খেলার জন্য ফাঁকা জায়গাই পাওয়া যেত না। সারা দিনই ফুটবল খেলা চলত। অধিকাংশই কলকাতা লিগের প্রথম ডিভিশনে খেলতেন। অথচ এখন খেলার কেউ নেই।’’ ভারতীয় ফুটবলে একাধিক তারকা উপহার দেওয়া হাওড়ার জেলার এই হাল কেন? সত্যজিতের ব্যাখ্যা, ‘‘ল্যাংচা মিত্র, রবিন পাত্রের মতো জহুরিরা প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলার খুঁজে এনে অনুশীলন করাতেন। ওঁদের শূন্যস্থান পূর্ণ করার মতো কেউ নেই।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ছেলে ফুটবল খেলে প্রতিষ্ঠিত হবে, এই ঝুঁকি অধিকাংশ অভিভাবকই নিতে চান না। তাঁরা চান ছেলে লেখাপড়া করে চাকরি করুক।’’ নিজের উদাহরণ দিয়ে সত্যজিৎ যোগ করলেন, ‘‘আমার দাদু কার্তিক চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হাওড়া ইউনিয়নে খেলতেন। মোহনবাগান বারবার নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু দাদু ক্লাব ছাড়েননি। আমার ছোট কাকা কৃষ্ণকমল চট্টোপাধ্যায় কলকাতা লিগের প্রথম ডিভিশনে খেলেছেন। ফলে আমাদের পরিবারে ফুটবল খেলার চল ছিলই। পাশাপাশি লেখাপড়াও করতাম। এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে।’’

আরও পড়ুন
লাল-হলুদ শিবিরে হ্যাটট্রিকের স্বপ্ন

হাওড়া জেলায় ফুটবলার উঠে আসত সহযাত্রী, বালি অ্যাথলেটিক, সন্ধানী, স্বাধীন সেবকের মতো ক্লাব থেকে। সত্যজিৎ নিজেও বালি অ্যাথলেটিকের হয়ে জেলা লিগ খেলেছেন। এখন অধিকাংশ ক্লাবেরই বেহাল অবস্থা। জাতীয় দলের আর এক প্রাক্তন তারকা বিকাশ পাঁজি কাঠগড়ায় তুলছেন হাওড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থাকেই। তিনি বললেন, ‘‘সুষ্ঠু ভাবে প্রতিযোগিতা আয়োজন করার মতো কেউ নেই এখন। এই কারণেই ফুটবলের এই বেহাল অবস্থা।’’ তিনি যোগ করেন, ‘‘শুধু হাওড়া নয়, সব জেলারই এক হাল। বাংলা থেকেই ফুটবলার উঠছে না।’’ বিকাশের অভিযোগ, ‘‘ফুটবলের প্রতি ভালবাসাও কমছে তরুণ প্রজন্মের। আমরা ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতাম ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। জাতীয় দলের খেলার। এখনকার ছেলেদের ফুটবল নিয়ে খুব একটা আগ্রহ নেই।’’

এখনও কলকাতা লিগে হাওড়ার ১২টি দল খেলে। জেলার ক্রীড়া সংস্থার ফুটবল সচিব আবার মহমেডানের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর রঘু নন্দী। ফুটবল যে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে তা মেনে নিয়ে বললেন, ‘‘হাওড়া শহরের ছেলেদের ফুটবল খেলার প্রতি আগ্রহ কমছে। গ্রামের ছেলেরা খেলছে বলে এখনও টিকে রয়েছে আমাদের জেলার ফুটবল। আমরা চেষ্টা করছি, ছবিটা বদলানোর।’’ তাঁর আরও ব্যাখ্যা, ‘‘ফুটবলের প্রতি আগ্রহ হারানোর এই ছবিটা শুধু হাওড়ার নয়, সব জেলারই।’’ জেলা ক্রীড়াসংস্থার আর এক কর্তা বলছেন, ‘‘হাওড়া জেলায় মাঠের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। ফলে লিগের ম্যাচ আয়োজন করার জন্য যে মাঠের প্রয়োজন, তা পাওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া ক্লাবগুলোও জেলা লিগে খেলতে উৎসাহী নয়।’’ জেলা সংস্থা কেন ক্লাবগুলোকে উৎসাহ দিতে এগিয়ে আসছে না? তাঁর যুক্তি, ‘‘আর্থিক সঙ্কটে অনেক কিছুই আমরা করতে পারছি না। ক্লাবগুলোরও একই হাল। ভাল দল গড়তে গেলে ফুটবলারদের পয়সা দিতে হবে। ক্লাবগুলোর সেই ক্ষমতাই নেই। ফলে অধিকাংশ ক্লাবই দল গড়ছে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE