Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
ইডেনের পিচ নিয়ে খুশি আইসিসি

এক পরীক্ষার পরেই অন্য পরীক্ষার ভাবনা সৌরভের

ভাঙা হাট বোধহয় একেই বলে। সোমবার সন্ধ্যায় ইডেনে যা দেখা গেল। ক্লাব হাউস জনমানবহীন। ক্লান্তিময় ছুটির ছবি। শুধু নৈঃশব্দ। ইডেনের ফাঁকা গ্যালারি নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘন সবুজ মাঠের দিকে। কে বলবে চব্বিশ ঘন্টা আগেই এখানেই চলছিল মানুষ ও যন্ত্রের শব্দ-প্রতিযোগিতা? কে বলবে আগের রাতেই এক ঝাঁক কৃষ্ণকায় যুবক-যুবতী রীতিমতো ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটিয়ে এখান থেকেই বিশ্বজয় করে দেশে ফিরল?

ট্রফি দিলেন, ‘ট্রফি’ও পেলেন সংগঠক সৌরভ। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

ট্রফি দিলেন, ‘ট্রফি’ও পেলেন সংগঠক সৌরভ। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

রাজীব ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৩২
Share: Save:

ভাঙা হাট বোধহয় একেই বলে। সোমবার সন্ধ্যায় ইডেনে যা দেখা গেল।

ক্লাব হাউস জনমানবহীন। ক্লান্তিময় ছুটির ছবি। শুধু নৈঃশব্দ। ইডেনের ফাঁকা গ্যালারি নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘন সবুজ মাঠের দিকে। কে বলবে চব্বিশ ঘন্টা আগেই এখানেই চলছিল মানুষ ও যন্ত্রের শব্দ-প্রতিযোগিতা? কে বলবে আগের রাতেই এক ঝাঁক কৃষ্ণকায় যুবক-যুবতী রীতিমতো ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটিয়ে এখান থেকেই বিশ্বজয় করে দেশে ফিরল?

এ যেন একাদশীর মন খারাপ করা বিকেল। পুজো শেষে ভাঙতে শুরু করা মণ্ডপের সাজসজ্জা। এত দিনের আনন্দ-উল্লাসের শেষে ভাঙা হাটের নিস্তব্ধতা।

আর এই যজ্ঞের যিনি সর্বময় কর্তা, সেই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আপাতত বিশ্রামে। সোমবার সকাল থেকে কোথাও যাওয়া ছিল না, মিটিং ছিল না। শহরের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে দৌড়নো ছিল না। হাজারো ফোন ছিল না। সকালে বিছানা ছেড়ে উঠতেও নাকি তাঁর বেশ দেরি হয়েছে। তার পর সারা দিনটা বাড়িতে। আগের রাতে বেহালার ছেলের বেহালায় ফিরতেই যে মধ্যরাত পেরিয়ে গিয়েছিল।

ড্রেসিংরুমে যখন ক্যারিবিয়ান উৎসব চলছে, তখনও ইডেনে দাঁড়িয়ে তিনি। যেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের আর এক চ্যাম্পিয়ন টিমের ক্যাপ্টেন।

টিম সিএবি-র ক্যাপ্টেন সৌরভ।

ইডেনের সবুজ গালিচায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিলেন সাফল্যোত্তর মুহূর্তগুলি। আইসিসি-র এক কর্মী এসে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বলে গেলেন, ‘‘টুনাইট ইউ আর আ চ্যাম্পিয়ন টু।’’ মন ভরে উপভোগ করলেন সেই তারিফ। কেনই বা করবেন না, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাইশ গজের বাইরে অজস্র ইয়র্কার, বাউন্সার সামলেছেন তিনি ও তাঁর টিমের ব্যাটিং লাইন-আপ। তার পর এই প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য।

এমন এক টানটান উত্তেজনাকর ম্যাচ জেতার পর ইডেনের মহারাজ ইডেনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘‘স্বস্তির চেয়ে যেন আনন্দ হচ্ছে বেশি। কী অসাধারণ একটা ম্যাচ হল! ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল এমনই হওয়া উচিত।’’ ইডেনের গ্যালারি তাঁর বহু দিনের চেনা। কিন্তু রবিবার রাতে যেন নতুন করে চিনলেন সেই গ্যালারিকে। বললেন, ‘‘কী অসাধারণ সাপোর্ট পেল ওরা সারা গ্যালারি থেকে। এ ইডেনই পারে। যেমন অভাবনীয় ম্যাচ, তেমনই অভাবনীয় ক্রাউড। যে ভাবে শেষ হল ম্যাচটা, এর জন্যই ইডেনের এই ফাইনাল চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, দেখে নেবেন। সমস্ত পরিশ্রম সার্থক হল আমাদের।’’

তার একটু আগেই মাঠে দাঁড়িয়ে ফাইনালের শেষ ওভারের নায়ক ব্রেথওয়েট নিজেদের দেশের টিভি চ্যানেলকে বলেছিলেন, ‘‘মনে হচ্ছিল নিজেদের দেশের কোনও মাঠে খেলছি। অন্য দেশে নয়। ইডেন আজ আমাদের যা সাপোর্ট করেছে, তা কোনও দিন ভুলব না।’’

শুনে সৌরভের প্রতিক্রিয়া, ‘‘কত বড় কমপ্লিমেন্ট বলুন তো এটা।’’

কথা বলতে বলতে আচমকা যে হাতটা তাঁর পিঠে এসে পড়ল, তাঁর মালিককে ঘুরে দেখেই উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন সৌরভ, ‘‘আরে বীরু, হাউ আর ইউ’’। বীরেন্দ্র সহবাগ।

স্বর্ণযুগের সেই টিম ইন্ডিয়ার অন্যতম দুই সেরা ব্যাটসম্যানের মুখোমুখিতে একে অপরের প্রশংসা। সহবাগের মুখে ক্রিকেট প্রশাসক সৌরভের প্রশংসা আর সৌরভের মুখে কমেন্ট্রির জগতে সদ্য পা রাখা বীরুর প্রশংসা।

সেই পর্ব শেষ হওয়ার পর রবিবারের ম্যাচ নিয়ে বলা শুরু করলেন সিএবি প্রেসিডেন্ট সৌরভ, ‘‘আমি বলেছিলাম না, ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল ইজ ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল। ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ম্যাচের থেকেও কিন্তু এটার রোমাঞ্চ অনেক বেশি ছিল। একেবারে খাঁটি ফাইনাল বাবা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানদের কী পাওয়ার! পাওয়ার দিয়েই ওরা ম্যাচটা বার করে নিল।’’

একটা সময় সারা ইডেনে স্যামিদের নিয়ে অশনি সঙ্কেত দেখা দিলেও প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের ভরসা ছিল ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানদের প্রতি। বলেন, ‘‘আমার কিন্তু একবারও মনে হয়নি ওরা হারতে পারে। গত কয়েকটা ম্যাচে ওরা যে ভাবে ব্যাট করেছে, তাতে শেষ বল না পড়া পর্যন্ত যে ওরা লড়বে, তা জানতাম। সেটাই হল। কী অসাধারণ ফিনিশ করল ছেলেটা (ব্রেথওয়েট)! এই আগ্রাসনটা যেন ওদের রক্তে।’’

ই়ডেনের যে মাঠ ও উইকেট নিয়ে এত দুশ্চিন্তা, সেই মাঠ ও উইকেট দেখে সকলেই এ দিন ধন্য ধন্য করেছেন। বোর্ডসচিব অনুরাগ ঠাকুর পর্যন্ত বলে গেলেন, ‘‘মাত্র এই ক’দিনে ইডেনকে কী বানিয়ে ফেলেছে সিএবি! এ সৌরভের কৃতিত্ব। হ্যাটস অফ টু হিম।’’ এ দিন কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায়ও বলেন, আইসিসি পিচ উপদেষ্টা অ্যান্ডি অ্যাটকিনসনও প্রশংসা করে গিয়েছেন মাঠকর্মীদের। কিন্তু মাঠকর্মীদের আফসোস, সারা বিশ্বকাপে একটা টাকাও বোনাস পাননি তাঁরা। রবিবার রাতে মাঠে দাঁড়িয়েই তাঁদের কথা দিলেন সৌরভ, ‘‘এই সপ্তাহেই তোমাদের বোনাসের ব্যবস্থা করে দেব।’’

আর ক্রিকেট প্রশাসনে তাঁর ‘রাহুল দ্রাবিড়’? অভিষেক ডালমিয়া রীতিমতো উত্তেজনায় কাঁপছিলেন। ‘‘কী ম্যাচ! কী উত্তেজনা! এ ইডেনই পারে, কলকাতাই পারে’’ বলতে বলতে আবেগে যেন গলা বুজে আসছিল তাঁর।

যাঁর আনা বিশ্বকাপ ফাইনাল, সেই জগমোহন ডালমিয়া তাঁর মন্দির ইডেন গার্ডেন্সে না থাকলেও ছিলেন তাঁর গোটা পরিবার। ইডেনের জায়ান্ট স্ক্রিনে তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র দেখতে দেখতে প্রেসিডেন্টস বক্সে বসে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি স্ত্রী চন্দ্রলেখা ও মেয়ে বৈশালী। বৈশালী নিজেই জানালেন সে কথা।

শ্রীমতি ডালমিয়া বলেন, ‘‘আসবই না ভেবেছিলাম। কিন্তু ওঁকে নিয়ে ডকুমেন্টারিটা দেখানো হবে শুনে চলে এলাম। খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এত বড় একটা ম্যাচ। যা ওঁরই চেষ্টার ফসল। অথচ উনিই নেই। কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আনন্দও হল এই দেখে যে, জগমোহন ডালমিয়াকে কেউ ভোলেননি।’’

এই কঠিন পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই এ বার আর এক বড় পরীক্ষার ভাবনা ঢুকে পড়ল সৌরভের মাথায়। সিএবি প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘‘এ বার তো আর একটা বড় পরীক্ষা।’’ কী সেটা? সৌরভের জবাব, ‘‘কেন, ইলেকশন।’’

বোধহয় বিধানসভা নির্বাচনের ভাবনা মাথায় আসছে বুঝতে পেরে নিজেই ভুলটা শুধরে দিয়ে বললেন, ‘‘আরে না না, সিএবি-র ইলেকশন। ওটাও তো বড় পরীক্ষা। না কি?’’ একটা শেষ হতে না হতেই পরেরটা নিয়ে চিন্তা শুরু করে দিয়েছেন।

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ই পারেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sourav Ganguly icc Eden Gardens pitch
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE