জনক: ডালমিয়ার চালু করা টুর্নামেন্ট বন্ধ করে দিচ্ছে আইসিসি।
জগমোহন ডালমিয়ার শহরে বসে তাঁরই চালু করা বহুল জনপ্রিয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতা তুলে দিল আইসিসি। এবং, আইসিসি প্রধান হিসেবে এক ভারতীয় সেই পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিলেন। ডালমিয়া আইসিসি প্রধান হয়ে মিনি বিশ্বকাপ চালু করেছিলেন। পরবর্তী কালে যার নামকরণ হয় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। আর শশাঙ্ক মনোহর বর্তমান আইসিসি প্রধান হিসেবে সেই প্রতিযোগিতা তুলে দেওয়ার প্রস্তাবে সিলমোহর দিয়ে দিলেন।
আইসিসি প্রধান হয়ে লন্ডনে নিয়ামক সংস্থার দফতরে বসেই ডালমিয়া আবিষ্কার করেছিলেন, কোষাগারে পড়ে আছে মাত্র একুশ হাজার পাউন্ড। তত দিনে ভারতীয় ক্রিকেটে বাণিজ্যিক বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন তিনি। এ বার ঝাঁপালেন আইসিসি-কে রক্ষা করার জন্য। ভারতীয় স্পনসরদের সঙ্গে কথা বলে বিশ্বকাপের নক-আউট সংস্করণ বাজারে আনলেন তিনি। মিনি বিশ্বকাপ নামে বাংলাদেশে চালু হওয়া সেই প্রতিযোগিতা প্রথম বছরেই দারুণ সফল। জোয়ার এল আইসিসি কোষাগারেও। শোনা যায়, তিন বছরের মধ্যে কয়েক হাজার পাউন্ড থেকে আইসিসি-র কোষাগারে জমা হয়েছিল ৭ মিলিয়ন পাউন্ড (ভারতীয় মুদ্রায় ৬৫ কোটি)।
গত বছর ইংল্যান্ডে হয়েছিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। কোহালির ভারত ফাইনালে হারে পাকিস্তানের কাছে। ২০২১ সালে পরবর্তী প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা ছিল ভারতে। আর ভারতীয় বোর্ড কর্তারা ঠিক করে রেখেছিলেন, প্রয়াত ডালমিয়াকে শ্রদ্ধা জানাবেন ইডেনে ফাইনাল করে। কিন্তু হঠাৎই আইসিসি বলতে শুরু করে, পঞ্চাশ ওভারের নয়, এই প্রতিযোগিতা হবে কুড়ি ওভারের। অর্থাৎ নজিরবিহীন ভাবে ২০২০ এবং ২০২১ পরপর দু’বছর হবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। কলকাতায় বসে বৃহস্পতিবার আইসিসি ঘোষণাই করে দিল, ডালমিয়ার চালু করা প্রতিযোগিতা আর হবেই না। দু’বছর অন্তর আয়োজন করা হবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। চার বছর অন্তর হবে পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ। এ ছাড়া হবে টেস্টের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ।
আইসিসি-র দাবি, সর্বসম্মত এই সিদ্ধান্ত। সভায় উপস্থিত ভারতীয় বোর্ডের প্রতিনিধিরাও নাকি আপত্তি জানাননি। বোর্ডের অনেক কর্তা কিন্তু ঘোষণা শুনে ফুঁসছেন। শীর্ষস্থানীয় এক বোর্ড কর্তা বৃহস্পতিবার রাতে বললেন, ‘‘অকল্যান্ডের বৈঠকে ঠিক হয়েছিল, ২০২১ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হবে ভারতে। তখন কেউ বলেনি, এটা পঞ্চাশ থেকে কুড়ি ওভারের হয়ে যাবে। এখন কী করে কুড়ি ওভারের করে দেওয়া যায়?’’
এমনিতে ভারতীয় বোর্ডে এই মুহূর্তে ডালমিয়া যুগের মতো প্রশাসকেরা আর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নন। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত কমিটি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস (সিওএ) এখন বোর্ড চালাচ্ছে। আগের সেই ডালমিয়া-সুলভ দৌত্যে গুরুত্বপূর্ণ লড়াই জেতানোর কেউ নেই। তবু চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সহজে মেনে নেওয়া হবে বলে মনে হয় না। ফের বিশেষ সাধারণ সভা ডাকার কথা বলতে শুরু করেছেন অনেক সদস্য। প্রয়োজনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বয়কটের চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবিও জানাচ্ছেন কেউ কেউ।
আবার আইসিসির একাংশকেও পাল্টা হুঙ্কার দিতে শোনা যাচ্ছে যে, ‘‘ভারত যদি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিয়ে বিদ্রোহের জেরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ করতে না-চায়, খুব ভাল কথা। সে-ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশে তা করা হবে।’’ ভারত সরকার আয়করের ছাড় দিচ্ছে না বলে ধুয়ো তুলে এখান থেকে প্রতিযোগিতা সরিয়ে নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে।
বিস্ময়ের হচ্ছে, খোদ নিয়ামক সংস্থাই টেস্ট বা পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটকে গৌণ করে দিয়ে টি-টোয়েন্টিকে প্রাধান্য দিতে শুরু করল! তুলে দেওয়া হল মহিলাদের টেস্ট ক্রিকেট! মানে ঝুলন গোস্বামী বা মিতালি রাজদের কখনও আর টেস্টের আঙিনায় দেখা যাবে না। ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের নতুন বিস্ময় জেমাইমা রদ্রিগেজ কখনও টেস্ট খেলার সুযোগই পাবেন না। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কি বিভিন্ন দেশের কিংবদন্তি মহিলা ক্রিকেটারদের সঙ্গে আলোচনা করেছে আইসিসি? তেমন কোনও খবর নেই।
আইসিসি-র অধীন ১০৪টি ক্রিকেট দেশকে নজিরবিহীন ভাবে টি-টোয়েন্টি স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া হল। খেলার প্রসারের জন্য এই সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই। চিন বা হংকং অথবা মার্কিন মুলুকেও ছড়িয়ে পড়তে পারে ক্রিকেট। আবার আশঙ্কাও থাকছে যে, টেস্ট ক্রিকেট যাতে আরও তাড়াতাড়ি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে, সেই ইঞ্জেকশন দিয়ে দিল আইসিসি-ই!
কেউ স্বীকার করতে না-চাইলেও অনুমান করা হচ্ছে, ক্রিকেট সম্প্রচারকারী সংস্থার ইচ্ছাতেই তুলে দেওয়া হচ্ছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। তারা টি-টোয়েন্টি বেশি করে চায়। টেস্ট বা পঞ্চাশ ওভারের খেলা দেখিয়ে পয়সা উঠছে কোথায়? কলকাতার বৈঠকে উপস্থিত এক জন বলছিলেন, ‘‘এমসিসি পর্যন্ত ইংল্যান্ডে দশ ওভারের প্রতিযোগিতাকে অনুমোদন দিচ্ছে! দশ বলের ওভারকে সবুজ সঙ্কেত দিচ্ছে। কী অবস্থা!’’
আইপিএলের দেশ ভারত কি সত্যিই টি-টোয়েন্টি নিয়ে প্রতিবাদ করতে পারে? নাকি বলা উচিত— দৈত্য সৃষ্টি করেছ, এখন তোমাকেই তো গিলতে আসবে, ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy