Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Akram Khan

‘বেশ কয়েক বছর ধরেই মনে হচ্ছিল বিশ্বকাপ জিততে পারি’

কপিলের নেতৃত্বে ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জেতা ভারতীয় ক্রিকেটের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল। পোচেস্ট্রুমের জয়ও আগামী প্রজন্মকে তেমনই অনুপ্রাণিত করবে বলে মনে করছেন আক্রম। পাশাপাশি, এটাও জানাতে ভুলছেন না যে, গত কয়েক বছরে কী ভাবে এগিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট।

যুব বিশ্বকাপ জয় বাংলাদেশের ক্রিকেটে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে বিশ্বাস করছেন প্রাক্তন অধিনায়ক আক্রম খান।

যুব বিশ্বকাপ জয় বাংলাদেশের ক্রিকেটে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে বিশ্বাস করছেন প্রাক্তন অধিনায়ক আক্রম খান।

সৌরাংশু দেবনাথ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১২:০১
Share: Save:

এমন সকাল আগে কখনও দেখেনি পদ্মাপারের দেশ। বিশ্বজয়ী হওয়ার অনুভূতিই এতদিন অজানা-অচেনা ছিল। রবিবাসরীয় সন্ধ্যা সেই আক্ষেপ ভুলিয়েছে, এনেছে অনাস্বাদিত আনন্দের রেশ। আর সেই উল্লাসের সুরেই এসেছে প্রভাত।

আকবরের ব্যাটে যুব বিশ্বকাপ জয়ের এই মুহূর্তকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন সে দেশের প্রাক্তন অধিনায়ক আক্রম খান। যিনি এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)-এর ক্রিকেট অপারেশনস-এর প্রধান। সোমবার সকালে আনন্দবাজার ডিজিটালকে তিনি বললেন, “এটা অনেক বড় কৃতিত্ব। পাঁচ-ছয় বছর আগে থেকেই মনে হয়েছিল যে বিশ্বকাপ জেতার ক্ষমতা রয়েছে আমাদের। কিন্তু তা হচ্ছিল না। গত তিন-চারটে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে আমরা কখনও সেমিফাইনালে হেরেছি, কখনও কোয়ার্টার ফাইনালে হেরেছি। বাংলাদেশে ক্রিকেট মারাত্মক জনপ্রিয়। এই জয় কিন্তু আরও সাফল্যের দরজা খুলে দিল। আমার বিশ্বাস, আরও অনেক ক্রিকেটার বেরিয়ে আসবে এর পর।”

আরও পড়ুন: ঠান্ডা মাথার এই ‘ফিনিশার’-এর নেতৃত্বে নতুন অধ্যায় শুরু হল পদ্মাপাড়ের ক্রিকেটে​

আরও পড়ুন: বিষ্ণোইকে তখন তুলে নেওয়াই বড় ভুল হল

কপিলের নেতৃত্বে ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জেতা ভারতীয় ক্রিকেটের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল। পোচেস্ট্রুমের জয়ও আগামী প্রজন্মকে তেমনই অনুপ্রাণিত করবে বলে মনে করছেন আক্রম। পাশাপাশি, এটাও জানাতে ভুলছেন না যে, গত কয়েক বছরে কী ভাবে এগিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। তাঁর কথায়, “আমাদের মহিলা দল এর আগে এশিয়া কাপ জিতেছে। সিনিয়র দলও অনেক সাফল্য পেয়েছে।”

যদিও মাশরাফি মোর্তাজা, শাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবালদের কেরিয়ার যত বর্ণময়ই হোক না কেন, তাতে যত গৌরবজনক অধ্যায়ই থাক না কেন, বিশ্বজয়ীর তকমা নেই তাঁদের। শাকিবরা যেমন এখনও ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি, কোনও বিশ্বকাপের ফাইনালেই উঠতে পারেননি। চ্যাম্পিয়ন হওয়া তো দূর অস্ত্। সেখানে পারভেজ হোসেন ইমন, শরিফুল ইসলাম, রাকিবুল হাসান, অভিষেক দাসরা কেরিয়ারের শুরুতেই বিশ্বজয়ের গৌরবে আলোকিত। কোথায় টেক্কা দিলেন আকবর আলিরা? আক্রম নেপথ্য কারণ হিসেবে প্রস্তুতিতে জোর দিলেন। তাঁর ব্যাখ্যা, “আমাদের পরিকল্পনা খুব ভাল ছিল। প্রচুর ম্যাচ খেলেছি আমরা। দেশের বাইরেও প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছি। নিউজিল্যান্ডে গিয়ে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছি। আর আমরা কিন্তু একটা দল হয়ে উঠেছি। কোনও একজনের উপর নির্ভর করে থাকেনি, বরং একজোট হয়ে খেলেছি। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”

রবিবার অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে প্রথমে ব্যাট করে ১৭৭ তুলেছিল ভারত। যশস্বী জয়সওয়াল ছাড়া কোনও ব্যাটসম্যানই রান পাননি। শেষ সাত উইকেট পড়েছিল মাত্র ২১ রানে। তার মধ্যে আবার তিনজন রান আউট। ডাকওয়ার্থ-লুইস নিয়মে শেষ পর্যন্ত ২৩ বল বাকি থাকতে তিন উইকেটে জিতে যায় বাংলাদেশ। লেগস্পিনার রবি বিষ্ণোইয়ের চার উইকেট নেওয়া বিধ্বংসী স্পেল সামলে জিতিয়ে ফেরেন অধিনায়ক আকবর। ৪৩ রানে অপরাজিত থেকে হন ম্যাচের সেরাও।

কিন্তু ম্যাচের প্রথমার্ধেই কি হেরে গিয়েছিল প্রিয়ম গর্গের ভারত? আক্রমণের বিশ্লেষণ, “টস জেতা খুব জরুরি ছিল। আমরা প্রথম ১০ ওভারে একেবারে রান দিইনি। ২৩ রানে এক উইকেটে থামিয়ে রাখা গিয়েছিল ইন্ডিয়ার মতো শক্তিশালী দলকে। আমরা শুরু থেকেই দাপট দেখিয়েছি। বিশেষ করে ভারতের বিরুদ্ধে আমরা এখন ভাল খেলছিও। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং, তিন বিভাগেই উজাড় করে দিয়েছি আমরা। দেখুন, ভারত কিন্তু অতিরিক্তই দিয়েছে ৩৩ রান। সেখানে আমরা অনেক শৃঙ্খলাবদ্ধ বোলিং করেছি। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতোই খেলেছে ছেলেরা। আমার মনে হয়েছে, বিশ্বকাপটা আমাদের প্রাপ্যই ছিল।”

ক্রিকেট যতই টিমগেম হোক, বাংলাদেশ যতই দলগত পারফরম্যান্সের পতাকা তুলে ধরুক, তবু তার মধ্যেই ব্যক্তিগত ঝলকানি উঁকি মারে। বিশ্বজয়ের এই সৌরভেও কাদের ক্ষেত্রে আপনার মনে হচ্ছে বাকিদের পিছনে ফেলে লম্বা পথ এগোবেন? আক্রম এ বার সতর্ক, “কিছু ক্রিকেটার আছে, যাদের দেখতে খুব ভাল লাগে। যেমন মাহমুদুল হাসান জয় আছে। সেমিফাইনালে জেতাল ওই। আকবরও ফাইনালে খুব ভাল ব্যাট করল। পরিস্থিতি অনুসারে খেলল। বোলাররাও সারাক্ষণ চাপ রেখে গিয়েছে। পারভেজ হোসেন ইমনের প্রচেষ্টার কথাও ভোলা যাবে না। ভারতকে জিততে হলে বাংলাদেশের ইনিংসের দ্রুত আঘাত হানতে হত। কিন্তু, ওপেনিংয়েই আমরা পঞ্চাশ তুলে ফেলেছিলাম। তানজিদ হাসান আউট হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই ইমন বেরিয়ে গিয়েছিল চোট পেয়ে। যখন ও আবার ব্যাট করতে মাঠে ফিরল, তখন চাপ প্রচণ্ড। ওই সময় যে জুটিটা গড়েছিল ইমনের সঙ্গে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যা জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছিল। আমার মনে হয় এরা সকলেই ভবিষ্যতের তারকা। অবশ্য আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ওদেরকেও অনেক কষ্ট করতে হবে। তবেই পরের পর্যায়ে পৌঁছতে পারবে।”

গ্যালারির মতোই মাঠেও আগ্রাসী থেকেছেন আকবর আলির দল।

কিন্তু কোথাও কি অতিরিক্ত আগ্রাসন দেখিয়ে ফেললেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা? আক্রমের জবাব, “দেখুন, ভারত কিন্তু ফেভারিট ছিল ফাইনালে। ভারতের সিনিয়র দলই বলুন বা যুব দল বলুন, দুটো দলই সমান শক্তিশালী। এই ভারতীয় দলকেই কিন্তু ফাইনালে আগাগোড়া চাপে রেখেছিল বাংলাদেশ। এটা মানতেই হবে। যেটা দরকার ছিল, সেটাই করেছে আকবরের দল। আর দিনটা নিশ্চিত ভাবেই ভারতের ছিল না। ভারতকে হারানো আমাদের কাছে বিশাল বড় কৃতিত্ব, এটাও অস্বীকারের জায়গা নেই।”

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা রয়েছে। অনেক সাফল্য, অনেক ব্যর্থতা। আনন্দ-যন্ত্রণা মিলেমিশে রয়েছে। কিন্তু, তার মধ্যে ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ কোথায় জায়গা করে নেবে? আক্রম বললেন, “অনেক জয় রয়েছে। প্রত্যেক জয়েরই আলাদা মাহাত্ম্য রয়েছে। মহিলা দল এশিয়া কাপ জিতেছিল। আমরা বিশ্বকাপের শুরুর দিনগুলোয় পাকিস্তানকে হারিয়েছিলাম। অনেক সাফল্য আছে। কাউকে ছোট করা যায় না। কিন্তু অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জেতাও আমাদের প্রাপ্য ছিল। বড় বড় যে কীর্তি রয়েছে, তার মধ্যে এই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়াও উপরের দিকে থাকবে।” পাশাপাশি এটাও মানছেন যে, বিশ্বসেরার অনুভূতি আগে কখনও হয়নি। আর তাই এই অনুভূতি একেবারেই অতুলনীয়। বললেন, “তবে হ্যাঁ, এর আগে কিন্তু বিশ্বকাপ জিতিনি আমরা! এই তৃপ্তি আলাদা।”

ক্রিকেটার হিসেবেও আক্রম সুপরিচিত। আট টেস্টের সঙ্গে খেলেছেন ৪৪ একদিনের ম্যাচ। তার মধ্যে ১৫টিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশকে। ৫১ বছর বয়সি এখন প্রশাসকের পাশাপাশি টিভিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবেও বসেন। রবিবার মাঝরাত পর্যন্ত যেমন ছিলেন টিভি স্টুডিয়োতে। ফলে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের রূপান্তর খুব কাছে থেকে দেখছেন তিনি। তাঁর সময়ের সঙ্গে এখনকার বাংলাদেশ দলের তফাত কোথায়? ৫১ বছর বয়সির চটজলদি উত্তর, “আমরা কিন্তু এখনকার মতো এত সুযোগ-সুবিধা বা পরিকাঠামো পাইনি। যখন খেলতাম, তখন অন্য দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে পড়তাম ওখানেই। আমরা ক্রমশ উন্নতি করছি। তখন বাংলাদেশে একটাই স্টেডিয়াম ছিল। এখন আটটা স্টেডিয়াম রয়েছে। বিদেশ থেকে কোচ, ট্রেনার, ভিডিয়ো অ্যানালিস্ট আনছি আমরা। তাঁরা দলের সঙ্গে কাজ করছেন। ক্রিকেটাররা সেই সুযোগগুলো কাজে লাগাচ্ছে। এ ভাবে চলতে পারলে আমরা এশিয়ার সেরা তিন দলের মধ্যে চলে আসব।”

বোঝা গেল, বিশ্বকাপ জয় শুধু আগামী প্রজন্মকেই অনুপ্রাণিত করছে না। ভবিষ্যত তো বটেই, বর্তমানের কাছেও হয়ে উঠছে মোটিভেশনের জ্বলন্ত মশাল। এবং, প্রাক্তন ক্রিকেটারদেরও দেখাচ্ছে স্বপ্ন। এই না হলে বিশ্বজয়!

ছবি: এএফপি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE