Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বুম বুম বুমরার গতির তুফান, এক উইকেট দূরে ট্রেন্ট ব্রিজ জয়

ঘণ্টায় নব্বই মাইল গতিবেগে একটার পর একটা বল ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যানদের মুখের পাশ দিয়ে, নাকের পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। জিমি অ্যান্ডারসনের দু’বার আঘাত লাগল। ভয়ঙ্কর বাউন্সার থেকে শেষ মুহূর্তে মাথা বাঁচালেন কয়েক বার।

একের পর এক ব্যাটসম্যানকে পরাস্ত করলেন যশপ্রীত বুমরা। ছবি: রয়টার্স।

একের পর এক ব্যাটসম্যানকে পরাস্ত করলেন যশপ্রীত বুমরা। ছবি: রয়টার্স।

সুমিত ঘোষ
নটিংহ্যাম শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৮ ০৩:৫৯
Share: Save:

সদ্য প্রয়াত অজিত ওয়াড়েকর দেখলে নিশ্চয়ই খুশি হতেন। তাঁদের দিকে লাল বলের মিসাইল ধেয়ে এসেছে দিনের পর দিন। নিজেদের ক্রিকেটজীবনে যেটা পাননি, সেটা এখন ঘটছে। স্পিনের দেশ ভারত এখন গতির আগুনে ঝলসে মারছে প্রতিপক্ষদের।

এক-এক বার জানতে ইচ্ছা করছে, হ্যারল্ড লারউড দেখলে কী বলতেন? কয়লার খনিতে কাজ করা তিনি চিরকাল যে ক্রিকেটের দুয়োরানির সন্তান থেকে গেলেন! নিজের দেশই লারউডকে নির্বাসিত আর একঘরে করে দিয়েছিল। তাঁর অপরাধ? ডন ব্র্যাডম্যান নামক চিরশ্রেষ্ঠকে বডিলাইন বোলিং করা!

নটিংহ্যাম থেকে ঘণ্টা দু’য়েক দূরে হবে লারউডের ছোটবেলার বাসভূমি। বডিলাইনের পরে সেখানে থেকে চলে যেতে বাধ্য হন। বিশ্ব জুড়ে ক্রিকেটের সমস্ত প্রতিষ্ঠান তাঁকে আন্তর্জাতিক ক্রিমিনালের তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। অসহায় এবং সমাজ থেকে ব্রাত্য ফাস্ট বোলারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন শুধু জ্যাক ফিঙ্গলটন। যে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বডিলাইন বোলিং করায় নিজের দেশ গৃহচ্যূত করেছিল, সেখানেই ফিঙ্গলটনের সহায়তায় আশ্রয় পেয়েছিলেন লারউড।

এলবিডব্লিউ: দ্বিতীয় নতুন বলে যশপ্রীত বুমরার বাজিমাত। প্রথম শিকার শতরানকারী জস বাটলার। ছবি: রয়টার্স।

বডিলাইন নায়কের (বদনাম পাল্টে খলনায়ক বলা বন্ধ হওয়ার সময় হয়েছে) কি এখনও মাঝেসাঝে ঘরের মাঠের আকাশে ঘোরাফেরা করতে ইচ্ছা করে? যদি মঙ্গলবার ট্রেন্ট ব্রিজের মাথার উপরে এসে থাকে লারউডের আত্মা, তা হলে নিশ্চয়ই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল। ভারতের মতো স্পিনের দেশও এখন চার ফাস্ট বোলারে আক্রমণ শানাচ্ছে! যে বোলিংটা করার জন্য তাঁকে সমাজ থেকেই বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল, সেই বডিলাইন বোলিংই এখন বুমরা, শামি, ইশান্তদের অস্ত্র।

ঘণ্টায় নব্বই মাইল গতিবেগে একটার পর একটা বল ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যানদের মুখের পাশ দিয়ে, নাকের পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। জিমি অ্যান্ডারসনের দু’বার আঘাত লাগল। ভয়ঙ্কর বাউন্সার থেকে শেষ মুহূর্তে মাথা বাঁচালেন কয়েক বার। ক্রিস ওকসকে যে বলে আউট করলেন যশপ্রীত বুমরা, সে রকম ডেলিভারি ব্র্যাডম্যানকে বডিলাইন সিরিজে করতেন লারউড। দ্বিতীয় নতুন বল হাতে বুমরা যে ভয়ানক স্পেল করলেন এ দিন, তা অগ্নিযুগের ওয়েস্ট ইন্ডিজে দেখা যেত।

ট্রেন্ট ব্রিজের কমেন্ট্রি বক্সে আছেন মাইকেল হোল্ডিং। তাঁর মন্তব্য? ‘‘ভারতের এই ছেলেরা শুধু জোরে বল করে না, খুবই জোরে বল করে। প্রত্যেকে ঘণ্টায় ৯০ মাইল গতিবেগে বল করার ক্ষমতা রাখে।’’ কে বলছেন? না, মাইকেল হোল্ডিং! যাঁর দুরন্ত গতির বাউন্সারে কত বার রক্তাক্ত হতে হয়েছে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের। এক বার আঘাত লেগে এমনই পরিস্থিতি হয়েছিল যে, ভারত অধিনায়ককে আট উইকেট পড়ার পরে ডিক্লেয়ার করে দিতে হয়।

বোল্ড: বুমরার বলে ছিটকে গেল বেয়ারস্টোর স্টাম্প।

ট্রেন্ট ব্রিজের এই টেস্টে নাটকীয় মোড় আর ঘাত-প্রতিঘাতের অভাব নেই। দুর্দান্ত সব মোচড় দেখা গিয়েছে চার দিন ধরে। টি-টোয়েন্টির এমন রমরমার যুগেও টেস্ট ক্রিকেটের রোম্যান্সের পক্ষে দারুণ বিজ্ঞাপন। প্রথম দিন টস হেরে ব্যাট করতে নেমে শিখর ধওয়নের আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে ভারতের মনোবল ফিরে আসা। তার পরে বিরাট কোহালি এবং অজিঙ্ক রাহানের দুর্দান্ত পার্টনারশিপে সম্মানজনক স্কোর। ইংল্যান্ড ব্যাট করতে নামলে সকলকে অবাক করে দিয়ে মাত্র একটা সেশনে তাদের অলআউট হয়ে যাওয়া। দ্বিতীয় ইনিংসে ফের ভারতীয়দের দুর্দান্ত ব্যাটিং। লর্ডসে যে দলটাকে ন্যাতানো আর সর্বস্ব হারানো মনে হচ্ছিল, তাঁদেরই অপ্রত্যাশিত ভাবে ফিরে আসা। হার্দিক পাণ্ড্যর পাঁচ উইকেট এবং হাফ সেঞ্চুরি। কোহালির দুই ইনিংস মিলিয়ে ২০০ রান। চেতেশ্বর পূজারার ফর্মে ফেরা। এ দিন যখন সবাই ধরে নিয়েছে, চা-পানের মধ্যে ইংল্যান্ড হারছে তখন জস বাটলার এবং বেন স্টোকসের অভাবনীয় প্রতিরোধ। ছাব্বিশতম ওভারে ৬২-৪ হয়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। কুক আউট, রুট আউট, জেনিংস আউট। সেখান থেকে বাটলার এবং স্টোকস খেলে দিলেন তিরাশিতম ওভার পর্যন্ত। আশি ওভার হওয়া মাত্র কোহালি নতুন বল নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আবার পেন্ডুলাম ঘুরতে শুরু করল। ছয় ওভারের মধ্যে চার উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচে ফিরে এল ভারত। তবু বৃহত্তর ক্যানভাসে ট্রেন্ট ব্রিজের জয়কে হয়তো বেশি করে মনে রাখতে হবে স্পিনের দেশের গতির চকমকি তৈরি করার জন্য। মনে হচ্ছিল, নতুন বার্তাই যেন দিয়ে রাখছে কোহালির দল— তোমাদের যদি দু’জন পেসার থাকে আমাদের আছে চার জন!

কট-বিহাইন্ড: বুমরার বাউন্সাের কিপারকে ক্যাচ ওকসের।

১৯৭১-এ তাঁর নেতৃত্বে ইংল্যান্ডে যখন ওভাল টেস্ট জিতছে ভারত, ওয়াড়েকরের হাতে কোনও পেস বোলারই ছিল না। আবিদ আলি, একনাথ সোলকার, সুনীল গাওস্করদের হাতে নতুন বল তুলে দিয়ে ওয়াড়েকররা অপেক্ষা করতেন কখন বলের পালিশ উঠবে আর বেদী, প্রসন্ন, চন্দ্রশেখর, বেঙ্কট এসে স্পিনের ধাঁধায় প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করবেন। তিন নতুন বল বোলারের মধ্যে সোলকার ছিলেন সব চেয়ে ভাল। ইংল্যান্ডের আবহাওয়ায় তাঁর বল সুইং করত। ওভালের সেই ঐতিহাসিক টেস্টে প্রথম ইনিংসে তিন উইকেটও নিয়েছিলেন তিনি। তবু একনাথ সোলকার বলতে দুরন্ত গতিতে ছুটে আসা কোনও বোলার নয়, সকলের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে দাঁড়িয়ে থাকা এক শিকারী ফিল্ডারের মুখ। ব্যাটের সামনে সোলকারের ক্যাচের জাদুও তো ছিল স্পিনারদের উইকেট তোলার জন্যই! না হলে ২৭ টেস্টে সোলকারের উইকেট সংখ্যা ১৮। বোলিং গড় ৫৯.৪৪। ওয়াড়েকরের দলের মধ্যে সব চেয়ে জোরে বোলারের গতি খুব বেশি হলে ঘণ্টায় ৭০ মাইল ছিল। কোহালির এই দলে সব চেয়ে মন্থর বোলার হার্দিক পাণ্ড্যর গতি দেখেও চমকে উঠছেন বিশেষজ্ঞরা। তিনিও ঘণ্টায় ৯০ মাইল বেগে বল করে দিতে পারেন। সারাক্ষণ হোল্ডিং, ডেভিড গাওয়ার, কুমার সঙ্গকারারা তা নিয়ে আলোচনা করে গেলেন।

ওভালের সেই ঐতিহাসিক টেস্টে ওয়াডে়করের স্পিনাররা নেন ১৫ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে চন্দ্রশেখরের একারই ছিল ছয় শিকার। আর ট্রেন্ট ব্রিজে মঙ্গলবার পর্যন্ত পড়া ইংল্যান্ডের ১৯ উইকেটের সব ক’টাই ভারতীয় পেসারদের তোলা। প্রথম ইনিংসে হার্দিকের ছিল পাঁচ উইকেট, চোট থেকে ফিরেই দ্বিতীয় ইনিংসে বুমরার দখলে পাঁচ শিকার। চতুর্থ দিনের পিচে স্পিনার অশ্বিন পুরো সুস্থ না থাকায় নিজের ছন্দে বোলিংই করতে পারলেন না। উইকেটও পাননি। তাতেও জয় থেকে মাত্র এক উইকেট দূরে ভারত। ট্রেন্ট ব্রিজের নাটক যেন শেষ হয়েও হল না শেষ। পাঁচ ওভারের উপরে টিকে থাকলেন অ্যান্ডারসন এবং রশিদ। বুমরা টেস্টেও ‘নো বল’ করলেন!

সাংঘাতিক কোনও প্রলয় ঘটে ট্রেন্ট ব্রিজ বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার পূর্বাভাস নেই। তাই ধরে রাখা যায়, সিরিজ ২-১ হচ্ছেই। গ্যালারিতে উঠতে শুরু করেছে ‘গনপতি বাপ্পা মোরিয়া’ ধ্বনি। প্রেস বক্সের পাশের স্ট্যান্ডেও জোরে বাজছে পঞ্জাবি গান। সব মিলিয়ে ইংল্যান্ডে উপস্থিত ‘ইন্ডিয়ান সামার’। বৃহত্তর বার্তাও পৌঁছে গিয়েছে ক্রিকেট বিশ্বে। দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়ান্ডারার্সের পরে ইংল্যান্ডেও বুমরা, শামিদের বোমাবর্ষণ অব্যাহত। ঘূর্ণির দেশের হাতিয়ার এখন গতি।

আগুনের মোকাবিলা করো আগুন দিয়ে— তাঁর অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিনের নকশা মেনে কবে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন লারউড! তখন বডিলাইন বলে গোটা দুনিয়া ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। এখন ব্রহ্মাস্ত্র বলে সকলে কুড়িয়ে নিচ্ছে! এমনকি স্পিনের দেশ ভারতও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cricket Jasprit Bumrah Trent Bridge Test
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE