Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
জয়ের সামনে এসেও সতর্ক শাস্ত্রী-বিরাট

স্বপ্নভঙ্গের অতীত কাহিনি না-ফেরানোর ডাক ভারতীয় শিবিরে

ঠিক সে রকমই একটা পরিস্থিতিতে মাথার উপর রামধনুর রং নিয়ে রবিবার অ্যাডিলেড থেকে বেরোলেন বিরাট কোহালি। মনে হল, বেশ ফুরফুরে মেজাজেই রয়েছেন। তবে ভীষণ সতর্ক। জয়ের কাছাকাছি এসেও ক্রিকেট কী রকম নির্মম ভাবে খালি হাতে ফেরাতে পারে, তা বহু বার দেখেছেন তিনি।

হুঙ্কার: অস্ট্রেলিয়ার ওপেনার হ্যারিসকে ফিরিয়ে দিয়ে মহম্মদ শামি। জয়ের গন্ধ পাওয়া কোহালির উচ্ছ্বাস। সঙ্গী ঋষভ। রবিবার। এএফপি, রয়টার্স

হুঙ্কার: অস্ট্রেলিয়ার ওপেনার হ্যারিসকে ফিরিয়ে দিয়ে মহম্মদ শামি। জয়ের গন্ধ পাওয়া কোহালির উচ্ছ্বাস। সঙ্গী ঋষভ। রবিবার। এএফপি, রয়টার্স

সুমিত ঘোষ
অ্যাডিলেড শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:৫০
Share: Save:

অ্যাডিলেড ওভালকে যে কেন বিশ্বের সব চেয়ে দর্শনীয় মাঠগুলোর একটা বলা হয়, তা বুঝতে গেলে পড়ন্ত বেলার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তখন ভাগ্য ভাল থাকলে রামধনুর রং আকাশে খেলা করবে আর তাতে ঐতিহাসিক এই মাঠকে আরও মায়াবী মনে হবে।

ঠিক সে রকমই একটা পরিস্থিতিতে মাথার উপর রামধনুর রং নিয়ে রবিবার অ্যাডিলেড থেকে বেরোলেন বিরাট কোহালি। মনে হল, বেশ ফুরফুরে মেজাজেই রয়েছেন। তবে ভীষণ সতর্ক। জয়ের কাছাকাছি এসেও ক্রিকেট কী রকম নির্মম ভাবে খালি হাতে ফেরাতে পারে, তা বহু বার দেখেছেন তিনি। এই অ্যাডিলেডেই চার বছর আগে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি খেলছিলেন না। কোহালি ছিলেন অনিয়মিত অধিনায়ক। দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে অসাধারণ রান তাড়া করছিল ভারত। একেবারে তীরে এসে তরী ডোবে। কোহালি আউট হয়ে যান। ভারতও ম্যাচ হেরে যায়।

জেতার জন্য ৩২৩ করতে হবে এমন টার্গেট নিয়ে খেলতে নেমে অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৪-৪। অর্থাৎ, এখনও ২১৯ রানের এভারেস্ট পেরোনো বাকি। অস্ট্রেলিয়াতেই এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন, যিনি বিশ্বাস করেন এই অবস্থা থেকে তাঁদের দল টেস্ট ম্যাচ জিতবে। প্রেস বক্সের ঠিক পাশেই রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার সব চ্যানেল এবং রেডিয়ো ধারাভাষ্যকারদের বক্স। সেই বক্সগুলোতে একেবারে চাঁদের হাট। অনায়াসে একটা বিশ্ব একাদশ বানিয়ে ফেলা যায়। অ্যালান বর্ডার, ইয়ান চ্যাপেল, গ্লেন ম্যাকগ্রা, শেন ওয়ার্ন, মিচেল জনসন, রিকি পন্টিং— কে নেই! বিকেলের দিকে অস্ট্রেলিয়ার যখন তিন উইকেট পড়ে গিয়েছে, তাঁদের সকলকে চায়ের টেবলে গোল হয়ে বসে থাকতে দেখা গেল। দেখে মনে হবে, টাইটানিক হিমশৈলে ধাক্কা খেয়েছে। ক্রাইসিস মিটিংয়ে বসেছেন কিংবদন্তিরা। সেখানে ওয়ার্নকে যথারীতি সব চেয়ে সোজাসাপ্টা আর আক্রমণাত্মক শোনাল। বর্ডার সব চেয়ে চুপচাপ। দেখে মনে হল, খুব হতাশ। আশাই সম্ভবত ছেড়ে দিয়েছেন। পরিসংখ্যান এবং ইতিহাস, সবই যে তাঁদের বিপক্ষে।

আরও পড়ুন: ওয়ার্নারদের জন্য খারাপ লাগছে কোহালির

অ্যাডিলেডে এত রান তাড়া করে অস্ট্রেলিয়া এক বারই জিতেছে। ১৯০২ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সব চেয়ে বেশি রান তাড়া করে এখানে জেতার নজির ওয়েস্ট ইন্ডিজের। সেই স্কোরটাও ২৩৯-৬, তিনশোর চেয়ে অনেক কম। একটাই তথ্য অস্ট্রেলীয় শিবিরে সামান্য বিশ্বাসের পারফিউম ছড়াতে পারে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শেফিল্ড শিল্ডের একটি ম্যাচে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া ৩১৩ রান তাড়া করে জেতে। আর ১৬৯ করে তাদের যিনি জিতিয়েছিলেন, সেই শন মার্শ লড়াই চালাচ্ছেন এবং ৩১ অপরাজিত। সঙ্গে প্রথম ইনিংসের টপ স্কোরার ট্রাভিস হেড। তবু স্বভাবসিদ্ধ সেই আগ্রাসী মেজাজে আর অস্ট্রেলীয়দের বলতে শোনা যাচ্ছে না যে, ওঁদের দিয়ে হবেই। বরং আতঙ্কিত চোখমুখ নিয়ে বর্ডার, ওয়ার্নরা আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন, সিরিজ হোয়াইটওয়াশের লজ্জা অপেক্ষা করে নেই তো?

আরও পড়ুন: ওয়ার্নের পরামর্শ, তৈরি করা হচ্ছে কুলদীপ অস্ত্রও

কেরি প্যাকার-উত্তর অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটকে ধ্বংসাবশেষ থেকে ফের নতুন করে গড়ে তোলেন এ বি। আর এখন তাঁদের অধিনায়ক কে? না, টিম পেন! যিনি প্রথম একাদশে জায়গা পেলেন কী করে, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার এক সাংবাদিক দুঃখ করে বলছিলেন, ‘‘একটা সময় ছিল যখন সব দেশ আগে অধিনায়ক বাছত, তার পরে বাকি দল। অস্ট্রেলিয়া কখনও সেই মতে বিশ্বাস করেনি। আমরা সব সময় আগে দল বেছেছি। তার পরে সব চেয়ে যোগ্য লোকের গলায় ক্যাপ্টেনের মেডেল পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই প্রথম বল-বিকৃতির ঘটনার জেরে অস্ট্রেলিয়াকে অধিনায়ক খুঁজতে বেরোতে হয়েছিল। বাজার ঘুরে আমরা পেনকেই পেয়েছি।’’ এঁদের মতে, অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে এমন অধিনায়কের আকাল আর কখনও দেখা যায়নি। এটা স্টিভ স্মিথরা ফিরলেও থেকে যাবে কারণ, শুরুতেই স্মিথ অধিনায়কত্ব করতে পারবেন না।

রকমসকম দেখে মনে হবে ভারতই এখন অস্ট্রেলিয়া। জায়গা পাল্টাপাল্টি হয়ে গিয়েছে। বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান তাদের অধিনায়ক। দিনের খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তরা তখনও তাঁদের প্রিয় অধিনায়কের জন্য দাঁড়িয়ে। কোহালি ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে মাঠের পাশ দিয়ে বেরোনোর মুখটাতে আসতেই আবদার শুরু হয়ে গেল— একটা অটোগ্রাফ দিয়ে যাও বিরাট। প্লিজ, একটা সেলফি তুলে দাও। এই আবদারগুলো তো রোজই করা হয় তাঁর কাছে। এখানে নতুন যেটা, তা হচ্ছে— কাল সকালে তাড়াতাড়ি ওদের শেষ করে দিও ক্যাপ্টেন। ১-০ এগিয়ে যাব আমরা।

অস্ট্রেলিয়ার মাঠে এসে ‘আমরা’র আওয়াজ এত উচ্চ স্বরে শোনা যাবে, কে ভাবতে পেরেছিল! কোহালি— তিনিও তো আগের দিনই অস্ট্রেলীয় সমর্থকদের একাংশের থেকে বিদ্রুপাত্মক ধ্বনি শুনেছিলেন। আর এ দিন খেলা চলাকালীন গ্যালারি থেকে এক বার পোস্টারও তুলে ধরল এক কিশোর— কোহালি, অ্যাডিলেড লাভ্‌স ইউ! সম্ভবত আগের দিনের বিদ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক।

সকলের আবদার মিটিয়ে কোহালি বেরিয়ে যাচ্ছেন নিরাপত্তা অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে। খেয়াল করা গেল, তিনি ইয়ারফোন লাগিয়ে এতক্ষণ অটোগ্রাফ আর সেলফি দিচ্ছিলেন। দেখে তক্ষুনি মনে হল, টেস্ট ম্যাচ সংক্রান্ত কোনও পূর্বাভাস শুনবেন না বলেই কান বন্ধ রেখেছেন। বিদেশের মাঠে টেস্ট জয়ের কাছাকাছি এসেও স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার যা ভয়ানক রেকর্ড তাঁর!

তিন বছর আগে গলে শ্রীলঙ্কাকে দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁরা নামিয়ে এনেছিলেন ৯৫-৫ স্কোরে। সকলে ধরে নিয়েছে, ভারত ড্যাং ড্যাং করে জিতছে। সেখান থেকে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেন চান্ডিমল। ভয়ঙ্কর কাউন্টার অ্যাটাক করেন তিনি ভারতীয় স্পিনারদের। ১৬৯ বলে ১৬২ অপরাজিত করে সে দিন ভারতীয় শিবিরে থরহরিকম্প ধরিয়ে দেন চান্ডিমল। তার পর জিততে গেলে ১৭৬ করতে হবে, এই অবস্থায় সাত উইকেট নিয়ে কোহালিদের শেষ করে দিয়ে যান রঙ্গনা হেরাথ।

কোহালি সে দিন ক্যাপ্টেন্সি জীবনের নির্মম শিক্ষাটা পেয়ে যান— শেষ হওয়ার আগে হয় না শেষ। এর পর দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইংল্যান্ডে তিনি গলের অ্যাকশন রিপ্লে দেখেছেন। কেপ টাউনে ২০৮ রানের টার্গেট পেয়েও জিততে পারেনি তাঁর দল। বার্মিংহামে ১৯৪ তুলতে পারেনি। দু’টোই ছিল সফরের প্রথম টেস্ট এবং কোহালিকে আজও যন্ত্রণা দেয়। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, দু’টো ক্ষেত্রেই প্রথম টেস্ট জিততে পারলে সিরিজ হেরে ফিরতে হয় না।

অ্যাডিলে়ডের স্টিভ স্মিথ এবং ডেভিড ওয়ার্নার-হীন অস্ট্রেলিয়া নিশ্চয়ই ফ্যাফ ডুপ্লেসির দক্ষিণ আফ্রিকা বা জো রুটের ইংল্যান্ড নয়। শন মার্শ যতই স্পিন ভাল খেলুন, পিচে তৈরি হওয়া ভয়ঙ্কর ক্ষত আর অশ্বিনের ছোবল থেকে রক্ষা পেলে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অঘটন ঘটবে। সবই ঠিক আছে। আবার নেপথ্যে গল, কেপ টাউন, বার্মিংহামের করুণ বাজনাও রয়েছে।

ঐতিহাসিক জয়ের গন্ধ পেয়েও অধিনায়ক কোহালির তাই কান বন্ধ। আর কোচ রবি শাস্ত্রীর গম্ভীর মন্তব্য, ‘‘টেস্ট ম্যাচের শেষ বল হওয়ার এখনও অনেক বাকি।’’ যদি শোনা যায় রবিবার মাঠ থেকে বেরিয়ে হোটেলে ফিরে গোটা দল একজোট হয়ে অতীতের স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস কাটিয়ে তোলার শপথগ্রহণ করেছিল, অবাক হওয়ার থাকবে না।

অ্যাডিলেডে রামধনুর রং উঁকি দিয়েছে, জয়ের ফুলঝুরি জ্বলা বাকি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE