অশ্বিন এবং হার্দিককে নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। ছবি: এএফপি।
সাউদাম্পটন টেস্ট শেষ হয়ে যাওয়ার পরে বাইশ গজের উপরে এক অফস্পিনারকে দেখা গেল।
তিনি ম্যাচের সেরা মইন আলি নন। ভারতের আর অশ্বিনও নন। তিনি অশ্বিনের পূর্বসূরি হরভজন সিংহ। বেশ খানিক্ষণ ধরে সেখানে এক বন্ধুকে নিয়ে অফস্পিনারের মতো বোলিং অ্যাকশন করে যেতে দেখা গেল তাঁকে। তিন তলার প্রেস বক্সে বসে দূর থেকেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, হরভজনের দৃষ্টি পিচের উপরে তৈরি হওয়া বিরাট ক্ষতের উপরে।
বন্ধুকে কী বলছিলেন হরভজন? যে, এ রকম ক্ষত তৈরি হওয়ার পরেও এই পিচে কী করে ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারলেন না অশ্বিন? যেখানে মইন আলি নিয়ে গেলেন নয় উইকেট, সেখানে অশ্বিনের দুই ইনিংস মিলিয়ে তিন উইকেট তাঁর জন্য খুবই খারাপ বিজ্ঞাপন হয়ে থাকল। বিশেষ করে দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর ৩৭.১ ওভার বোলিং করে মাত্র এক উইকেট নেওয়া সিরিজ ২-২ করার সম্ভাবনাকে তো ভাসিয়ে দিলই, নানা প্রশ্নও তুলে দিতে পারে।
হরভজন সুন্দর একটা ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন যে, অশ্বিনের অ্যাকশন ‘ওপেন চেস্টেড’। অর্থাৎ, ব্যাটসম্যানের দিকে বুক অনেকটা মুখোমুখি হয়ে থাকে। বোলারের আদর্শ অ্যাকশন হচ্ছে ‘সাইড অন’ অর্থাৎ ব্যাটসম্যান কাঁধটা বেশি দেখবে। হরভজনের বিশ্লেষণ, মইন আলির মতো ‘সাইড অন’ অ্যাকশনের স্পিনারদের পিচের ক্ষতকে ব্যবহার করার সম্ভাবনা অনেক বেশি। অস্ট্রেলিয়ার নেথান লায়নও সফল হতে পারতেন এই পিচে। হয়তো অ্যাকশনের কারণেই ফায়দা তুলতে পারলেন না অশ্বিন।
কিন্তু হরভজনের বিশ্লেষণও খুব ভাল জমিতে দাঁড় করাতে পারছে না ভারতের তারকা অফস্পিনারকে। প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা অনেকেই ব্যক্তিগত আলোচনায় সংশয় প্রকাশ করেছেন যে, উপমহাদেশের বাইরে অশ্বিনের উপরে কতটা আস্থা রাখতে পারে দল? অশ্বিন এখনও পর্যন্ত ৬২ টেস্টে ৩২৭ উইকেট পেয়েছেন। বোলিং গড় ২৫.৫৯। অসাধারণ রেকর্ড। কিন্তু দেশ ও বিদেশের তুলনা পাশাপাশি রাখলে প্রশ্ন ওঠা আশ্চর্যজনক নয়। দেশের মাঠে মোট ২৬ বার পাঁচ উইকেট শিকার রয়েছে তাঁর। বিদেশে রয়েছে মাত্র ৬ বার। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, এই ৬ বারের একটিও অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকায় নয়। বাংলাদেশে পাঁচ উইকেট পেয়েছেন এক বার, শ্রীলঙ্কায় তিন বার, ওয়েস্ট ইন্ডিজে দু’বার। অস্ট্রেলিয়ায় ছ’টি টেস্ট খেলে তাঁর উইকেট সংখ্যা ২১। বোলিং গড় ৫৪.৭১। ইংল্যান্ডে ছয় টেস্টে উইকেট ১৪। বোলিং গড় ৩২.৯২। দক্ষিণ আফ্রিকায় তিন টেস্টে সাত উইকেট। বোলিং গড় ৪৬.১৪।
ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে যেমন দেখা হয় উপমহাদেশের বাইরে গতি ও বাউন্সের পিচে কার কেমন রেকর্ড, স্পিনারদের মান নির্ধারণ করার ক্ষেত্রেও সেটাই মাপকাঠি। তিনি উপমহাদেশের চিরাচরিত স্পিনিং ট্র্যাকেরই শুধু বোলার, এই তকমা আরও জোরাল হয়ে দাঁড়াবে সাউদাম্পটনে ব্যর্থতার পরে। আরও গুরত্বপূর্ণ হচ্ছে, টিভি বিশ্লেষণে দেখিয়েছে, পিচের উপরে তৈরি হওয়া ক্ষতে তিনি বল ফেলতেই পারেননি। একমাত্র স্পিনারের এমন নিয়ন্ত্রণের অভাব দলকে ভুগিয়েছে।
পিচে যে ‘রাফ’ তৈরি হয়েছে, সেটা এতটাই প্রকট ছিল যে, তিন তলার প্রেস বক্সে বসেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। ইশান্ত শর্মা রাউন্ড দ্য উইকেট বল করার সময় সেটা তৈরি হতে শুরু করে এবং যত খেলা এগিয়েছে, ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। মইনের নয় উইকেটের আশি শতাংশ ক্ষতের উপরে ফেলে নেওয়া। তার মধ্যে রয়েছে ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেওয়া কোহালির উইকেট। মইনের বলগুলো ক্ষতের উপরে পড়ে কেউটের মতো ফণা তুলছিল। অশ্বিনের ডেলিভারিগুলো সেখানে থেকে গেল নির্বিষ হিসেবে।
যে কোনও ভারতীয় স্পিনারের কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো ছিল এই ক্ষত। প্যাভিলিয়ন প্রান্তে ডান হাতি ব্যাটসম্যানের একেবারে গুডলেংথ স্পটে যা তৈরি হয়েছিল। চিরকাল ভারতীয় পিচে চতুর্থ বা শেষ দিনে এমন দেখা গিয়েছে আর অনিল কুম্বলে, হরভজন সিংহ, বেঙ্কটপতি রাজুরা তার ফায়দা তুলে দেশকে একের পর এক ম্যাচ জিতিয়েছেন। কোনও ভারতীয় স্পিনারের এ রকম ‘ভারতীয়’ পিচে ব্যর্থ হওয়াটা সিরিজের সেরা বিস্ময়।
তার উপর আবহাওয়াও ছিল একেবারে ভারতীয় স্পিনারদের মন মতো। মাথার উপরে সারাক্ষণ খটখটে রোদ, গরমে পিচ আরও শুকিয়ে উঠছে, ফাটল ধরছে। কারও কারও মনে হচ্ছে, অন্তত চারটি ক্ষেত্রে এই টেস্টে চালকের আসনে বসার সুযোগ এসেছিল ভারতের সামনে। চারটিই তারা জলে ফেলে দেয়। এক) প্রথম ইনিংসে ৮৬-৬ হয়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। সেখান থেকে স্যাম কারেনরা ২৪৬ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যান তাঁদের স্কোরকে। দুই) দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ড ১২২-৫ হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে ২৭১ তোলে তারা। তিন) ভারতের প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট যখন পড়ে স্কোর ১৮১। এর পর হার্দিক পাণ্ড্য এবং অশ্বিন উইকেট ছুড়ে দিয়ে যান। অশ্বিন রিভার্স সুইপ মারতে গিয়ে আউট হন আর হার্দিক দিয়ে যান ক্যাচ প্র্যাক্টিস। চার) চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়া করতে নেমে ওপেনাররা যদি ভাল শুরু দিতে পারতেন, ফের ভাল জায়গায় চলে আসতে পারত ভারত। কিন্তু ভারত প্রথম তিন উইকেট হারায় ২২ রানে।
এক জন তরুণ অলরাউন্ডার, নানা সমালোচনা আর তর্ক-বিতর্ক উপেক্ষা করে যাঁকে টানা চারটি টেস্টে খেলিয়ে গিয়েছে টিম ম্যানেজমেন্ট। অন্য জন দলের সিনিয়র ক্রিকেটার। ফিটনেস নিয়ে সংশয় থাকা সত্ত্বেও সেরা স্পিন-অস্ত্রের উপরে আস্থা রাখা হয়েছিল।
হারের ময়নাতদন্তে বসে মনে হচ্ছে, ওভালে ডন ব্র্যাডম্যানের ইতিহাস ছোঁয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েও যে বুদবুদের মতো হারিয়ে গেল, তাতে প্রধান দুই খলনায়ক হয়ে থাকলেন এঁরাই। স্যাম কারেন এবং ইংল্যান্ডের নীচের দিককার ব্যাটিং বারবার ভাল জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে দলকে। সেখানে হার্দিক-অশ্বিনদের ব্যাটেও কোনও রানই নেই। গোটা সিরিজ ধরে যা ভোগাল ভারতকে। ওভালে দু’জনকে নিয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত শাস্ত্রী-কোহালিদের টিম ম্যানেজমেন্ট নেয় কি না, সেটাই দেখার। তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া যাক, ভারতীয় ক্রিকেটে অতীতে দায়িত্বজ্ঞানহীন শট খেলার জন্য বসিয়ে দেওয়ার উদাহরণ আছে। এই দু’জনের কারও থেকেই তিনি কম বড় ক্রিকেটার বা তারকা ছিলেন বলে তো মনে হয় না— কপিল দেব!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy