Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

হারের বদলা নিয়ে বাবার কথা রাখলেন জেমাইমা

ভারতীয় দলের হয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অভিষেক ম্যাচেই নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৪৫ বলে ৫৯ রান করেছেন জেমাইমা।

প্রতিবেশী: সচিনের বাড়িতে যখন আমন্ত্রিত জেমাইমা। অ্যালবাম থেকে।

প্রতিবেশী: সচিনের বাড়িতে যখন আমন্ত্রিত জেমাইমা। অ্যালবাম থেকে।

দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
মুম্বই শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৮ ০৪:০২
Share: Save:

মুম্বইয়ের ক্রিকেট-পাঠশালায় পৃথ্বী শ-এর সহপাঠী তিনি। পৃথ্বীর মতো ভারতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যও। সেই জেমাইমা রদ্রিগেজ এখন মহিলাদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে খেলছেন হরমনপ্রীত কৌর-এর দলের হয়ে।

ভারতীয় দলের হয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অভিষেক ম্যাচেই নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৪৫ বলে ৫৯ রান করেছেন জেমাইমা। রবিবার খেলতে নামছেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সেই মহারণের আগে ভারতীয় সময় শনিবার গভীর রাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে বান্দ্রার বাড়িতে এসেছিল বাড়ির ছোট মেয়ের ফোনটা। রবিবার সকালে বান্দ্রার বাড়িতে বসে সেই তথ্য দিলেন পেশায় শিক্ষক জেমাইমার বাবা ইভান রদ্রিগেজ। শোনাচ্ছিলেন তাঁর ১৮ বছর দু’মাসের মেয়ের বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নেওয়ার কাহিনি। বলছিলেন, ‘‘মেয়ে ফোন করে আশীর্বাদ চাইছিল পাকিস্তান ম্যাচের আগে। ওঁকে মনে করিয়ে দিয়েছি, গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দেশের মাটিতে ভারতীয় মহিলারা হেরে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের কাছে। সেই বদলা নিতে হবে রবিবার। পঞ্চাশ রানের কম করে আউট হওয়া চলবে না। দেশের জার্সি পরার সুযোগ কিন্তু সকলে পায় না। তুমি সেখানে দেশের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। কাজেই ভুল শট নেওয়া তোমার সাজে না। দলের দেওয়া দায়িত্ব পালন করে মাঠ ছেড়ো।’’ জেমাইমা ১৬ রান করলেও ভারত কিন্তু পাকিস্তানকে হারিয়ে দিল সহজেই।

সচিন তেন্ডুলকরের বান্দ্রার বাড়ির সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশি জেমাইমারা। এক দেওয়ালের ব্যবধান। এ দিন সকালে জেমাইমাদের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, গোটা পরিবার গোয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারণ জানতে চাইলে ইভান বলেন, ‘‘স্পনসর পেয়ে গিয়েছিলাম বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ গিয়ে মেয়ের খেলা দেখার। কিন্তু ভিসা পাইনি। মেয়ে বাড়িতে নেই। ব্যস্ততা কম। তাই গোয়ার হোটেলে বসেই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দেখব আজ।’’

ইভান আর লবিতা শোনাচ্ছিলেন, তাঁদের মেয়ের ক্রিকেটার হিসেবে উঠে আসার গল্প। ওঁদের কথায়, ‘‘দু’বছর বয়স থেকেই মেয়েটা পুতুলের বদলে প্লাস্টিকের বল নিয়ে খেলত। তিন বছরের জন্মদিনে ওর ঠাকুর্দা একটা ব্যাট কিনে দেয়। সেই থেকেই মেয়ের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার ইচ্ছা বেড়ে যায়।’’

ইভানও কলেজ জীবনে ক্রিকেটার হতে চাইতেন। কিন্তু পারিবারিক সমস্যার জেরে বেশি দূর এগোতে পারেননি। বিয়ের পরে স্ত্রী লবিতার সঙ্গে শুরু করেন নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কোচিং সেন্টারে পড়ানোর ব্যবসা। সেই অর্থেই মেয়েকে ক্রিকেটার তৈরি করেছেন।

মেয়ের উত্থ্বান প্রসঙ্গে তাঁর বাবা এর পরেই বলেন, ‘‘আমার দুই ছেলে এলি ও এলক। ওরা ক্রিকেট কোচিং সেন্টারে অনুশীলন করত পৃথ্বী শ-র সঙ্গে। দুই দাদার সঙ্গেই আমার মেয়ে বাড়িতে ক্রিকেট খেলত প্রথমে।’’ ২০০৮ সালে বান্দ্রার ক্লাবে ট্রায়াল হচ্ছিল, সেখানে দাদাদের সঙ্গে ট্রায়াল দিতে যান ছোট্ট জেমাইমাও। কিন্তু মেয়ে বলে তাঁকে ডাকা হচ্ছিল না। জেমাইমার বাবা শেষমেশ সে দিন ট্রায়াল দেখতে আসা সচিনের গুরু রমাকান্ত আচরেকরের কন্যা কল্পনার কাছে আবেদন করেন। কল্পনা আয়োজকদের অনুরোধ করলে ট্রায়ালে নামতে পারেন জেমাইমা। ভারত-পাক ম্যাচের সকালে ইভান বলছিলেন, ‘‘সে দিন কল্পনা ম্যাডাম না থাকলে আজ হয়তো আমার মেয়ের বিশ্বকাপ খেলাই হত না।’’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘ছাত্র পড়ানোর রোজগার থেকেই ঘরে বোলিং মেশিন কিনে মেয়েকে বাড়িতে অনুশীলন করিয়েই রপ্ত করিয়েছি কভার ড্রাইভ, ব্যাকফুট ড্রাইভ, হুক, পুল, স্কোয়ার কাট। এই কঠোর অনুশীলনের সুফল, এখন আমার মেয়ে উইকেটের চারিদিকেই শট নিতে পারে।’’

বোঝা যায়, পৃথ্বী শ’-এর বাবার মতোই জেমাইমার জীবনে তাঁর বাবার প্রভাব অনেকটাই। ইভান বলছিলেন, ‘‘মেয়ে মহারাষ্ট্রের অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯ হকি দলেও খেলেছে। কিন্তু নিজে ভারতের জার্সি পরতে চাইতাম। না হওয়া স্বপ্ন পূরণ করতে ওকে ক্রিকেটে ঠেলে দিই। আজ আমি গর্বিত বাবা।’’

ঘরোয়া ক্রিকেটে গত কয়েক মরসুম ধরেই রানের বন্যা বইছে জেমাইমার ব্যাটে। কিন্তু গত বিশ্বকাপে ভারতীয় দলে সুযোগ না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন জেমাইমা। সে প্রসঙ্গে তাঁর বাবা বলছেন, ‘‘ওর পছন্দের ক্রিকেটার ধোনি। ওঁর বায়োপিক দেখিয়ে সে দিন বলেছিলাম, নজরে পড়ার জন্য যে দিকে নির্বাচকরা বসেছেন, সে দিকে ধোনি জোরে মারছিল। তুইও এ বার হয় রেকর্ড গড় বা রেকর্ড ভাঙার চেষ্টা কর। মাঠে নেমে দেড়শো বল খেলতেই হবে প্রতি ম্যাচে। তা হলেই ডাক পাবি ভারতীয় দলে।’’ এর পরেই স্মৃতি মন্ধানার রেকর্ড ভেঙে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দ্বিশত রানের সেই ঐতিহাসিক ইনিংস খেলেন জেমাইমা।

সচিন তেন্ডুলকর আগে পাশের বাড়িতে থাকতেন। জেমাইমা কোনও দিন পরামর্শ পেয়েছেন তাঁর কাছে? ইভান এ বার বলেন, ‘‘আমার ছেলে এলক আর সচিনের ছেলে অর্জুন দারুণ ভাল বন্ধু। ভারতীয় ‘এ’ দলের হয়ে জেমাইমা যে বার দক্ষিণ আফ্রিকায় যায়, তখন সচিন ওকে বাড়িতে ডাকে। জানতে চায় টেনশন হচ্ছে কি না। জেমাইমা মাথা নাড়তেই ‘মাস্টার’ বলেন, তার মানে তুই খেলাটার উপর ফোকাসড রয়েছিস। মেয়ে এর পরে দক্ষিণ আফ্রিকার পিচের ব্যাপারে জানতে চাইলে সচিনের পরামর্শ ছিল বল ব্যাটে আসবে। বাকিটা তোর ইতিবাচক মন আর চেষ্টার যোগফল। সেটা ঠিক হলে রান পাবিই। রবিবারের পাকিস্তান ম্যাচের আগে সেই কথাগুলোও মনে করিয়ে দিয়েছি জেমাইমাকে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE